|
---|
নিজস্ব সংবাদদাতা : দেশে একমাত্র পোলো বল ও সরঞ্জাম প্রস্তুত করে এখনও টিকে রয়েছে পাঁচলা দেউলপুরে একটি পরিবার। ‘বাগ পোলো’ প্রস্তুতকারক সুভাষচন্দ্র বাগ বলেন, ঠাকুরদা, বাবা, কাকা শুধুমাত্র বল তৈরি করতেন। তা প্রায় শতাধিক বছর আগের কথা। প্রায় ৪০-৪৫ বছর আগে সুভাষচন্দ্র বাবুর উদ্যোগে তৈরি হয় পোলো স্টিক। বলের চাহিদা কমতে শুরু করে। বল তৈরির পাশাপাশি স্টিক তৈরির দিকে আগ্রহ বাড়ান তিনি। সুভাষচন্দ্র বাগ নিজেকে টিকিয়ে রাখার তাগিদে লড়াই করে চলেন। বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন বল তৈরির সঙ্গে স্টিক বা অন্যান্য সরঞ্জাম কীভাবে তৈরি করা যায়। নানা পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করে নতুনভাবে অধ্যায় শুরু করেন তিনি। শুরুতে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে চলতে হয় তাকে, তাছাড়া স্টিকের চাহিদা সেভাবে ছিল না। ভারতীয় পোলো খেলোয়ারও বিদেশ থেকে খেলার সরঞ্জাম ও স্টিক আমদানি করত। সুভাষ বাবুর কথায়, আজ থেকে ২ থেকে ৩ দশক আগে থেকে একটু একটু করে শুরু হয় ‘বাগ পোলো’ কোম্পানির স্টিক এর চাহিদা। বর্তমানে দেশের বাইরে সর্বত্র আর্জেন্টিনা ব্রাজিল সহ অন্যত্র খেলোয়াড়দের চাহিদা মতো পৌঁছে যাচ্ছে ‘বাগ পোলো’ কোম্পানির তৈরি বল, স্টিক।
হাওড়া বা পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত কাঠ, বেত, কাঁচামাল দিয়েই তৈরি হতো স্টিক। এখন স্থানীয় কাঁচামালের গুণগতমান ভালো না হওয়ায় রাজ্যের বাইরে থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। সুভাষ বাবু জানান, ক্রমশ দেশ-বিদেশে চাহিদা বাড়ছে তাদের প্রস্তুত করা স্টিকের। কারন বিদেশি স্টিক বিক্রি হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা প্রতি পিস। সেখানে ‘বাগ পোলো’ কোম্পানির তৈরি স্টিক ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় মিলছে। কম দামে গুণগত মান ভালো হওয়ায় খেলোয়াড়দের বেশি পছন্দ বাগ পোলো-র স্টিক। দেশের একমাত্র পোলো বল ও স্টিক প্রস্তুত পাঁচলা দেউলপুরে৷ সারা বিশ্বের প্রতিযোগিতার মঞ্চে দেশের একমাত্র পোলো স্টিক, বল সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক পাঁচলা দেউলপুর গ্রামের বাগ পোলো। বর্তমানে পোলো খেলা আমাদের দেশে খুব বেশি প্রচলন না থাকলেও এক সময়ে ইংরেজদের হাত ধরে শুরু হয় বাংলা সহ দেশজুড়ে প্রচলন ছিল। ১৮৬০ সাল নাগাদ ক্যালকাটা পোলো ক্লাব প্রতিষ্ঠা এবং ব্রিটিশদের হাত ধরে পোলো খেলার প্রচলন শুরু হয়। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে পোলো খেলার সরঞ্জাম নিয়ে এসে ভারতে ঘোড়ায় চড়ে পোলো খেলা শুরু করে ব্রিটিশরা। সেই সময়ে অর্থাৎ উনিশ শতকের আগে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতায় যাওয়াটা এত সহজ ছিল না।হাতেগোনা কয়েকজন কর্মসূত্রে বা একান্ত প্রয়োজনে কলকাতায় যেতেন বা যোগাযোগ রাখতেন। সেরকমই হাওড়া পাঁচলা ব্লকের দেউলপুর গ্রামের বাসিন্দা বিপিন বিহারী বাগ এর একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্মসূত্রে থাকতেন কলকাতায়। সরাসরি ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার। মাঝে মধ্যেই পাঁচলা দেউলপুর গ্রামে বিপিন বাবুর কাছে আসতেন তিনি। বন্ধুর গল্পকথায় বিপিনবাবু জানতে পারেন ব্রিটিশদের পোলো খেলার গল্প। তিনি আরও জানতে পারেন ব্রিটিশরা পোলো খেলায় এক ধরনের বল ব্যবহার করেন, সেই বল যদি ভারতবর্ষে পাওয়া যায় তাহলে ভালো হত ব্রিটিশদের। বার বার আমদানি করতে হত না বল। একথা শুনে বিপিনবাবু পোলো বল দেখতে চান বন্ধুর কাছে। দেখার পর তার আদলে কয়েকটা বল তৈরি করে বন্ধুর মারফত ব্রিটিশদের কাছে পাঠান। সেই বল ব্রিটিশরা খেলার পর দারুন আনন্দ পান। ব্রিটিশরা পোলো খেলার জন্য বেচে নেন দেউলপুরের বাঁশের গোড়া থেকে তৈরি পোলো বল। সেই থেকে বিপিনবাবুর হাত ধরে দেউলপুর গ্রামে গড়ে ওঠে বল তৈরির কারখানা।হাওড়া জেলায় সেই সময় ব্যাপকভাবে পাওয়া যেত বাঁশ গাছ। আর সেই গাছের গোড়া থেকেই বল তৈরি করতেন বিপিনবাবু। ধীরে ধীরে বিপিন বাবুর কাছে শিখে অন্য পরিবারও বল তৈরি করতে শুরু করেন। ব্রিটিশদের হাত ধরে প্রথমে সেই বল ইংল্যান্ডে যেত। সেখান থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ত।এক সময় পৃথিবী বিখ্যাত ছিল দেউলপুর গ্রামে তৈরি হওয়া পোলো বল। দেউলপুরে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ টি পরিবার পুরোপুরি যুক্ত ছিল এই পেশার সঙ্গে। সেই সময় ভালোই চলছিল, কালক্রমে কয়েক দশক চলার পর বাঁশের তৈরি পোলো বলের চাহিদা কমতে থাকে। প্লাস্টিক বলের চাহিদা বাড়ে। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে প্রায় প্রতিটি পরিবার পোলো বল প্রস্তুত করা থেকে সরে দাঁড়ায়। কারণ কাঠের তৈরি পোলো বলের চাহিদা একেবারে কমে যায়। আর্জেন্টিনার তৈরি প্লাস্টিক বল জায়গা করে নেয়, পোলো খেলোয়াড়দের মন জয় করে। বর্তমানে সর্বাধিক আর্জেন্টিনা বা অন্যান্য দেশের তৈরি প্লাস্টিক বলেই খেলা হয়। খুব নামমাত্র খেলা বা প্র্যাকটিস করতে কাঠের বল বিক্রি হয়।