নকল সারের পর, নকল বীজআলুঃ মেমারির হিমঘরে স্থানীয় চাষীদের উত্তেজনা

এম. কে. হিমু, মেমারি, ৭ নভেম্বর ২০২২: এক সপ্তাহের মধ্যে মেমারিতে দু-দুবার নকল কারবার। লাভবান ব্যবসায়ীরা, ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ চাষীরা। সম্প্রতি মেমারি রসুলপুরে তিরুপতি হিমঘরের আলু নষ্টের ঘটনায় আলু চাষীদের ক্ষতির ঘা এখনও শুকোয়নি। এরই মাঝে গত শনিবার ২৯ অক্টোবর পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারির দেউলিয়া আলিপুরে ইফকোর প্যাকেটে নকল সার পাচার করা হচ্ছিল বলে সন্দেহ হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। তারা গাড়ি দুটিকে আটক করে মেমারি থানায় খবর দেয়। মেমারি থানায় দিলে পুলিশ গাড়ি দুটিকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পাশাপাশি দু’টি গাড়ির চালককে গ্রেফতার করে পুলিশ। ধৃতরা সারের বৈধ কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি বলে পুলিশসূত্রে জানা যায়। ঘটনার তদন্ত করছে মেমারি থানার পুলিশ।

     

    আর এক সপ্তাহ পরে আর এক শনিবার ৫ নভেম্বর বৈকালে মেমারি ১ ব্লকের অন্তর্গত আমাদপুর অঞ্চলের গলাই দড়ি বটতলা স্থিত শিবদুর্গা হিমঘরে স্থানীয় বীজ আলুর বস্তা থেকে পঞ্জাবে বিভিন্ন কোম্পানীর বীজ আলুর বস্তায় ভরা হচ্ছিল বলে অভিযোগ করেন বেশ কিছু স্থানীয় আলুচাষীরা। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় আলুচাষীরা সন্দেহ করছে, পাঞ্জাবের বীজ আলু হিসেবে বাজারে বিক্রি করার উদ্দেশ্যেই এই অনৈতিক কাজ করা হচ্ছিল।

     

    শনিবার সন্ধ্যায় এলাকার অজস্র আলুচাষী এই ঘটনার খবর পেয়ে শিবদুর্গা হিমঘরে জমায়েত হয়ে হিমঘর মালিকপক্ষকে বিক্ষোভ দেখায়। জানা যায় আলু প্যাকেটজাত করার সময়, এক ব্যক্তিকে পাকড়াও করা হয়, ব্যক্তির নাম শ্রীকান্ত সরেন। অন্যদিকে শিবদুর্গা হিমঘরে মালিক জয়দেব কুন্ডু জানান তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে, যদি এরকম কিছু ঘটে থাকে তাহলে তিনি তার ব্যবস্থা নেবেন।

     

    শনিবার সন্ধ্যায় চাষীদের বিক্ষোভের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছায় মেমারি থানার পুলিশ। পুলিশ মালিক পক্ষ ও উপস্থিত চাষীদের সাথে কথা বলে আশ্বাস দেন ঘটনার তদন্ত হবে এবং মেমারি ১ ব্লক আধিকারিক ও এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টকে খবর দেওয়া হবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য।

     

    সোমবার সকালে মেমারি ১ ব্লক আধিকারি ড. আলি মহম্মদ ওয়ালিউল্লাহ, মেমারি ১ এডিএ আধিকারিক দেবশ্রী দত্ত মোদী,  জেলা এগ্রিকালচার মার্কেটিং অফিসার প্রণবেশ ঘোষ, মেমারি ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বসন্ত রুইদাস ও সহসভাপতি সেখ মোয়াজ্জেম সহ মেমারি থানার পুলিশ আধিকারিকরা শিবদুর্গা হিমঘরে পৌঁছায়।

     

    সেখানে শনিবার সন্ধ্যায় যে ৪২টি পাঞ্জাবের মার্কাযুক্ত বীজআলু সহ বস্তা পুলিশ চিহ্নিত করে রেখেছিল সেগুলি মালিকপক্ষ ও চাষীদের সামনে খুলে পরীক্ষা করে দেখলেন এবং অভিযোগকারী চাষীদের সাথে ও শিবদুর্গা হিমঘরের আর এক মালিক কৌশিক কুন্ডু সহ প্রশাসনিক আধিকারিকরা আলোচনায় বসেন।

    আলোচনা চলাকালীন স্থানীয়চাষীরা বিক্ষোভ দেখায় অভিযুক্তকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

     

    শিবদুর্গা হিমঘরের আর এক মালিক কৌশিক কুন্ডু এব্যপারে সংবাদমাধ্যমের কাছে কোন মন্তব্য করতে চাননি তিনি শুধু বলেন তদন্ত হোক সব সত্য সামনে আসবে। তাদের আরও অনেক হিমঘর আছে, মেমারির পুরাতন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী তারা এই ধরনের অনৈতিক কাজ তারা করতে পারেন না। তবে যারা দোষী তাদের শাস্তি হোক আইন মাফিক।

     

    মেমারি ১ ব্লক আধিকারিক ডক্টর আলী মোঃ ওয়ালীউল্লাহ চাষীদের বলেন এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টে লিখিত অভিযোগ ও তার কপি বিডিও, এডিএ, মেমারি থানা, পঞ্চায়েত সমিতিতে জমা দিতে। আগামী বুধবার বিডিও অফিসে মালিকপক্ষ, ব্যবসায়ী বরুণ মন্ডল ও চাষীদের নিয়ে বৈঠক করা হবে এবং তদন্ত করা হবে। সমগ্র ঘটনাটিকে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে উপযুক্ত শাস্তি অবশ্যই দেওয়া হবে।

    এদিন বিকালে ২৪ জন স্থানীয় চাষীদের স্বাক্ষর সহ এক অভিয়োগ পত্র জমা দেন মেমারি ১ ব্লক এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টে ও বিডিও অফিসে।

     

    এক অভিযোগকারী চাষী শেখ গিয়াসউদ্দিন জিরো পয়েন্টে প্রতিনিধিকে বলেন চাষীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঋণ নিয়ে আলু চাষ করেন।  ভালো ফলনের আশায় উত্তম বীজ আলু ক্রয় করেন। বীজ আলু ক্রয় করার সময় তারা বস্তার মার্কা দেখে আলু কেনেন আর এইভাবে খোদ মেমারির বুকেতে যদি স্থানীয় আলু বীজকে পাঞ্জাবের মার্কাযুক্ত বস্তায় ভরে বিক্রি করা হয় তাহলে যে চাষী এই বীজ আলু কিনবেন তাকে ঠকানো হবে। চাষীদের স্বার্থে এই চক্রের হাদিস করে প্রশাসনকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। শিব দুর্গা হিমঘরে স্থানীয় আলুর পাঞ্জাবের কোম্পানীর বীজ আলু চালু প্যাকেটে ভরা হচ্ছে আর হিমঘর কর্তৃপক্ষ কিছু জানেন না এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত।

     

    আলুবীজ কেনার সময় সাধারণত চাষীরা বস্তার গায়ে লেখা লোগো দেখেন। বাজারের ভাষায় যাকে বলে ‘মার্কা’। মূলত পঞ্জাবের পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত সংস্থার ব্র্যান্ড বা মার্কাগুলির দিকেই চাষীদের নজর থাকে। মার্কা ছাড়াও বস্তার গায়ে আঁকা ছবি বা পরিচিত লোগোর দেখেও তা কেনেন চাষিরা। তবে সে লোগো যে নকল, তা বহু ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে না। বিশেষসূত্রে জানা যায়, রাজ্যে আলুবীজের এই জালিয়াতরা বেশ আঁটঘাট বেঁধেই কাজ শুরু করেন। ভিনরাজ্যে পাঠানোর নাম করে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে আলু কেনা হয়। তা রাখা হয় রাজ্যের সীমানার জেলাগুলোর হিমঘরে। এর পর নামী কোনও বীজ সংস্থার বস্তা হাতিয়ে হিমঘরের আলু ভরা হয়। বস্তাবন্দি আলুবীজ পঞ্জাবের নম্বরের ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয় আশপাশের বীজের বাজারগুলিতে। এর পর চড়া দাবে তা চাষীদের বিক্রী করা হয়।

     

    নকল বীজআলু থেকে নকল সারের কারবার গোটা দেশ সহ রাজ্যে চলছে রমরমিয়ে। যদিও জালিয়াতি রুখতে কেন্দ্র ও রাজ্যের সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রশাসন উদ্যোগী হলেও তাদের বুড়ো আঁঙুল দেখিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনফার লোভে নকল কারবার করে চলেছে। অন্যদিকে সাধারণ চাষীরা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চাষ করে চলেছে অন্নদাতা হিসাবে। কিন্তু এই নকল সার, নকল বীজ কিনে কম ফলনের ফলে চোখের জলে ভাসছে চাষীর পরিবার – এর দায় কে নেবে?