শহীদ সেনা স্মরণে বিধবা স্ত্রী

মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ, নতুন গতি, চাঁচল:

    আমি সালমা শফিক ঘুরি অর্থাৎ শহীদ ক্যাপ্টেন শফিক ঘুড়ির স্ত্রী। আমার বয়স তখন ১৯,সবে ডানা মেলে পাখির মতো পৃথিবীতে বিচরণ করার পালা ঠিক তখনই আমাকে সংসারের মায়া জালে জড়িয়ে পড়তে হয়।সনামধন্য ক্যাপ্টেন শফিক ঘুরির সাথে ১৯৯১ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেপরি।প্রথম দিকে নিজেকে মানিয়ে নিতে আমার কম কষ্ট হয়নি?

    নিজেকে মানাতে মাঝে মাঝে ব্যর্থ হয়ে যেতাম এই ভেবে যে প্রিয়জনকে ছেড়ে একাকী কতইনা রাত অশ্রুসিক্ত অবস্থায় কাটাতে হবে।কিন্তু ক্যাপ্টেন শফিক ঘুরির অর্থাৎ আমার প্রান প্ৰিয় স্বামীর বোঝানোর ক্ষমতা ছিল অসীম।খুব সহজেই মানুষকে কথা দিয়ে বশীভূত করতে পারতেন,তেমনটা আমার সময় বেশি করে হত।যখনই আমি তাঁর উপর কোন বিষয়ে ক্ষুদ্ধ থেকেছি ঠিক তখনই আমাকে মানিয়ে নিতেন।

    লোকটা যেন কেমন অদ্ভুত ছিল, কখনও চিন্তিত দেখিনি।সেই সময় এখনকার মত এত ফোন ব্যাবহারের হুরূক লাগেনি,তাই ফোনে কথা বলার জন্য আমাকে ঘন্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় কাটাতে হত। যখনই তাঁর গলার স্বর শুনতে পেতাম তখনই আমি রোমাঞ্চিত হতাম,এতটাই উৎফুল্ল হয়ে পরতাম যে শরীর নাচতে লাগত। কিন্তু কখনো নাচা হয়নি কারণ ফোনে একটু আওয়াজ শুনার জন্য পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ও প্রতিবেশীরা হাজির হত।

    আমরা চিঠি লিখতাম একে অপরকে।কখনো কখনো এই গুলো আমার প্রাণ প্রিয় স্বামীর স্মৃতির মলম হিসেবে কাজ করতো যা এখনও করে। সে সারপ্রাইজ খুব পছন্দ করতো তাই আমিও সেটা ষোলো আনা দেওয়ার চেষ্টা করতাম।তাঁর ব্যাগের ভিতরে চিঠি, চুটকি ,বিভিন্ন অবাক করা সামগ্রী রেখে দিতাম।সে সেগুলো পেয়ে আমাকে সারপ্রাইজ হয়ে চিঠিতে বা ফোনে জানাতে ভুলতো না। তিনি নির্ভয়ে ত্রিপুরা, পাঞ্জাব ও শ্রীনগরের মত দুঃসাহসিক স্থানে কর্তব্য পালন করেছেন গর্বের সাথে। আমিও অনেক শক্ত ও সাহসী মহিলায় পরিণত হয়েছিলাম, তাঁর বীরত্বের দৃশ্য পরীক্ষিত করে।

    আমি নিজে ও নিজ ছেলে-মেয়েদের অভ্যস্ত করে নিয়েছিলাম তিনি ব্যতীত। একটুও কখনো আমার ছেলে মেয়েদের বুঝতে দিনী তাদের বাবার অভাব।আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাঁর কাছে প্রথম হল তার মাতৃভূমি হিন্দুস্থান দ্বিতীয় স্থানে পরিবার।তবুও কখনো একটুও আক্ষেপ হয়নি।তিনি তাঁর দেশের জন্য কঠোর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এবং আমি তাঁর স্মৃতি-ছায়া নিয়ে সংসার ধর্ম অটুট রেখেছিলাম।

    ১৯৯৯ সালে তিনি শ্রীনগরে ফিল্ড পোস্টিং এ কর্মরত। শ্রীনগরের পরিস্থিতি তখন খুবই গরম।এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে শ্রীনগর যে ক্যাপ্টেনও নিজ পরিবার নিয়ে থাকতে পারবে না।তাই আমি ২০০১ সালের ২৮ সে জুন ব্যাঙ্গালোর চলেগেছিলাম।সেখানেই তাঁর সঙ্গে শেষ বারের মত কথা হয়েছিল।তিনি ফোনে বলেছিলেন যে তিনি গভির জঙ্গলে মিলিটারি অপেরাশন-এ আছেন।তিনি করুন সুরে নিজ ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তা হয়ে উঠেনি কারণ অনেক শব্দ করে তাদের কাজিনদের সাথে খেলছিল তারা।আমি তাঁকে বলে ছিলাম বেসমেন্টে এসে ফোন করতে।কিন্তু আর কথা বলা হয়ে উঠেনি।এই অনুশোচনা আজও সাইক্লোন বেগে হৃদয়কে নাড়িয়ে যাচ্ছে ।বার বার প্রশ্ন উঠছে মনে যে কেন আমি তখনই তাঁর সন্তানের সঙ্গে কথা বলালাম না?

    ২০০১ সালের ১ম জুলাই ঠিক সন্ধ্যা ৬.৩০ তে একদল আর্মি তাঁদের স্ত্রী সাথে করে হাজির হল আমার মায়ের বাড়িতে।বেশ কিছু দিন ধরে মায়ের বাড়িতে ছিলাম।তাঁদের মধ্যে একজন মহিলা হটাৎ করে বসে বললেন যে শফিক ঘুরি আর কখনো ফিরবে না, তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন।আমি তৎক্ষনাৎ ভাবলাম হয়তো ভুল শুনলাম কিন্তু তিনি আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দিলেন এই বলে যে তাঁরা সকাল থেকে তাঁকে ফোন করার চেষ্টা করছেন।আমার সাথে যোগাযোগ হয়নি কারণ মায়ের বাড়ির ফোন তখন অসংযুক্ত ছিল।মেজর শফিক ঘুরি ‘অপেরাশন রক্ষক'(Operation Rakshak)-এ শহীদ হয়েছেন।এই খবর শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম ,ভূমিকম্পের কম্পন, আগ্নেয়গিরির লাভার উত্তপ্তা অনুভব করলাম।পায়ের নীচের মাটি মুহুর্তের জন্য সরে গিয়েছিল।পরের দিন বিমান বন্দরে জতীয় পতাকা মোড়ানো বাক্স বন্দি আমার প্রিয়-কে নিয়ে আসতে গেছিলাম।আমার প্রাণ প্ৰিয় স্বামীকে দেখে কান্না চেপে রাখতে পারিনি সেদিন।কিন্তু সেদিন আর আমার বীরযোদ্ধা স্বামী আমাকে একবারের জন্যেও স্ট্রং হতে বলেনি।

    সেই দিনই আমি তাঁর রক্তে রাঙানো উনিফর্ম ও বেসামরিক পোশাক বাক্স বন্দি পেয়েছিলাম।আমি আর একবারও সেগুলো পরিষ্কার করিনি কারণ আমি চাইনি তাঁর সাথে জুড়ে থাকা অনুভূতিগুলো মিলিয়ে যাক।তাঁর টাকা ভর্তি ওয়ালেট এখনো সাজানো, তাঁর চিঠিগুলো আমার নিত্যদিনের পাঠ্যবিষয়-এই স্মৃতি গুলো আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন জোগাচ্ছে।আমি আমার সন্তানদের মা ও বাবা দুটোই হয়েছি তবুও তাদের বাবার জন্য ঝরিত অশ্রু থামাতে পারিনি।আজ আমি শহীদ আর্মিদের পরিবার ও মেয়েদের সাবলম্বী করার জন্য কর্ণাটকে কর্তব্যরত।

    শফিক ঘুরি যখন শহীদ হন তখন আমার বয়স ২৯ বছর মাত্র।প্রথমদিকে ভেঙে পড়লেও পরবর্তীতে অনেক মানুষ সাহায্য করেছেন আগে বাড়তে।তিনি স্বশরীরে না থাকলেও তাঁর উপিদেশাবলি ,ভালবাসা ও দেশের প্রতি অপরাজেয় শ্রদ্ধা সর্বদা আমার পরিবার ও দেশের প্রতি ছিল, আছে এবং থাকবে।