| |
|---|

খান আরশাদ,বীরভূম:-
শহরের চাকচিক্যের বাইরে গিয়ে জেলার গ্রামীণ জনপদেও দুর্গাপূজা এখন কেবল আর নিছক ধর্মীয় উৎসব নয়। সামাজিক বার্তা দেওয়া ও শিক্ষামূলক উদ্যোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে বহু মণ্ডপ। এবারে সেই তালিকায় নজর কেড়েছে বীরভূমের রাজনগরের গড়দরজা গ্রামে ড্রামাটিক ক্লাবের সর্বজনীন দুর্গাপূজা। তাঁদের এবারের থিম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘সহজ পাঠ’। এই থিমের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা দুটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন— স্কুল ছুট শিশুদের সচেতন করা এবং বিভিন্ন রাজ্যে বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিদের হেনস্থার প্রতিবাদ জানানো।
বর্ণময় মণ্ডপে ‘সহজ পাঠ’-এর ছোঁয়া। ড্রামাটিক ক্লাবের সদস্যরা মণ্ডপটিকে কার্যত একটি শিক্ষাঙ্গনের রূপ দিয়েছেন। মণ্ডপ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী ‘সহজ পাঠ’ বইয়ের বিভিন্ন চিত্র ও অংশ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতিকৃতি বিশেষ স্থান পেয়েছে। মণ্ডপ সজ্জায় ব্যবহৃত হয়েছে ‘সহজ পাঠ’-এর প্রচ্ছদ এবং বাংলার বর্ণমালা— অ-আ-ক-খ সহ বিখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসুর আঁকা বিভিন্ন চিত্র। বর্ণমালা ও চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি দিয়ে তৈরি এই মণ্ডপটি এক অসাধারণ দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে, যা সহজেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
স্কুল ছুটদের জন্য উদ্যোক্তাদের বিশেষ আবেদন তাঁদের মূল লক্ষ্য বর্তমান সময়ে বেড়ে চলা স্কুল ছুট (ড্রপ আউট) সমস্যা। তাঁদের বক্তব্য, বর্তমান সময়ে কিছু শিশু বিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। সমাজের এই জরুরি সমস্যা মোকাবিলায় ড্রামাটিক ক্লাব অভিনব পন্থা নিয়েছে।
ক্লাবের সজল গড়াই, প্রবীর কর্মকার, তাপস পাল, চন্দন গড়াই, শ্যামল কর্মকার, বাবুলাল কর্মকার প্রমুখ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা বিশেষভাবে এলাকার অভিভাবক ও সাধারণ মানুষকে অনুরোধ করছেন, তাঁরা যেন তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের এই মণ্ডপে নিয়ে আসেন। মণ্ডপের আকর্ষণীয় থিমের মাধ্যমে শিশুরা যেন বিভিন্ন অক্ষর ও বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। বর্ণময় এই পরিবেশ শিশুদের মনে বিদ্যালয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি করবে বলে তাঁরা মনে করছেন। উৎসবের আনন্দ এবং শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ, এই দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক নতুন বার্তা দিতে চাইছে রাজনগরের এই ক্লাব।
বাঙালি হেনস্থার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ এই মণ্ডপের থিমের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলা ভাষা বলার জন্য বাঙালিদের ওপর ঘটে চলা হেনস্থার প্রতিবাদ জানানো।
‘সহজ পাঠ’ হল বাংলা ভাষার ভিত্তি, বাঙালীর আবেগ এবং বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিচ্ছবি। এই থিমের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের গর্ব। নিজেদের মাতৃভাষা নিয়ে গর্ববোধ করা এবং ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সওয়াল করাই এই থিমের অন্যতম লক্ষ্য। তাঁরা মনে করেন, বাঙালির নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্যকে মণ্ডপে তুলে ধরার মাধ্যমে এই ধরনের জাতিগত বা ভাষাগত হেনস্থার বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
রাজনগরের গড়দরজা গ্রামের ড্রামাটিক ক্লাবের এই উদ্যোগ স্থানীয় মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে, কেবল বিনোদন নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই সার্বজনীন দুর্গাপূজা।


