বাবুর, ফারগানা উজবেকিস্তান ও তাঁর সাহিত্য, কলমে মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস

সাকিব হাসান,বারুইপুর: জহিরউদ্দীন মুহম্মদ জালালউদ্দীন বাবুর মাতুল কুলের দিক থেকে মোঙ্গল বীর চেঙ্গিজ খানের চতুর্দশ ও পিতৃকুলের দিক থেকে তাইমূর লঙ্গের পঞ্চম অধঃস্তন ছিলেন৷ প্রশ্ন হল চেঙ্গিজ তো মুসলিম ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্ববিধ্বংসী দুশমন৷ তাহলে তাঁর অধঃস্তন বাবুর ছিলেন হানাফি মজহবভুক্ট কট্টর সুন্নী মুসলমান—এটা কীভাবে সম্ভব হল?

    চেঙ্গিজের মুসলিমবিশ্ববিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে প্রবল বিক্ষুব্ধ তাঁর দ্বিতীয় পুত্র চুগতাই খান বুঝেছিলেন শত শত বছরের সাধনালব্ধ অমূল্য সভ্যতা-সংস্কৃতির ধ্বংসসাধন মানবজাতিকেই ধ্বংস করে দেবে৷ তিনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন৷ পবিত্র ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এক নতুন বংশধারার পত্তন করেন৷ তিনি হয়ে উঠেছিলেন নিষ্ঠাবান মুসলমান৷
    তাঁর বংশধারা চুগতাই খানাত নামে সুপ্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে৷ তিনি ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি ধারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ তিনি এমনই প্রজারঞ্জক ও জনপ্রিয় শাসক হয়ে ওঠেন যে, তাঁর শাসনাধীনের মানুষেরা নিষ্ঠাবান মুসলিম হয়ে ওঠেন৷ শুধু তাই নয়; তাঁর রাজ্যের প্রচলিত তুর্কি ভাষা “চুগতাই তুর্কি” নামে প্রসিদ্ধ হয়ে ঔঠে৷ তাঁর রাজ্যের সংস্কৃতি চুগতাই সংস্কৃতি নামে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে৷ রাজ্যের অনেক কিছুর সঙ্গে চুগতাই নাম জুড়ে যায়৷ উল্লেখ্য যে, বাবুর এবং তাঁর বংশধরদের মাতৃভাষা ছিল চুগতাই তুর্কি৷ বাবুর তাঁর আত্মজীবনী “তূজুক-ই-বাবরী”লেখেন তাঁর মাতৃভাষা চুগতাই তুর্কিতে৷ বলাবাহুল্য, আজও তিনি চুগতাই তুর্কি ভাষার শ্রেষ্ঠতম কবি এবং সাহিত্যিক৷ দেশের নামানুসারে বর্তমানে ওই ভাষাটির নাম উজবেক ভাষা৷
    অতি অদ্ভুত এবং মজার ব্যাপার হল বাবুর ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বলে ভারত তথা বিশ্ব ইতিহাসে সুপরিচিত হলেও তিনি তাঁর জন্মভূমি, বর্তমান উজবেকিস্তানে উজবেক ভাষার বহুমুখী প্রতিভাধর কবি এবং সাহিত্যিক রূপে সম্মানিত৷ ও দেশে বাবুরের সাহিত্যিক মর্যাদা আমাদের দেশের রবীন্দ্রনাথের মতো৷ ও দেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত তাঁর রচনাবলি ওই ভাষার প্রামাণ্য রচনা ও সাহিত্য হিসেবে অতীব মর্যাদার সঙ্গে পড়ানো হয়৷ বহুভাষাবিদ ও বিষয়বিদ মণীষী বাবুর
    =========================
    বাবুর এক হাতে মসি এবং আরেক হাতে অসি নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন৷ আরো বিস্ময়কর ব্যাপার যে, তিনি তার সার্থক এবং বিস্ময়কর সদুপযোগ ঘটিয়েছিলেন৷ মসি দিয়ে যুগান্তকারী সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তো অসি দিয়ে ভুবন জয় করেছেন৷
    বাবুরের আত্মজীবনী পড়লে বোঝা যায় তিনি এক বিস্ময়কর মণীষার অধিকারী ছিলেন৷
    তিনি ছিলেন একাধারে ভাষাবিদ পণ্ডিত, ভূগোলবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, কাব্য-সাহিত্য বিশারদ, সমরতত্ত্ববিদ লিপি বিশারদ, ধর্মতত্ত্ববিদ ইত্যাদি৷ তাঁর পত্রাবলি অত্যন্ত উচ্চমানসম্পন্ন সাহিত্য৷ পুত্র হুমায়ূনকে লেখা তাঁর পত্রাবলিতে একজন আদর্শ পিতা, মণীষী এবং উপদেশকরূপে প্রতিভাত হন৷
    তিনি একাধিক ভাষা জানতেন৷ নিজের মাতৃভাষা ছাড়াও তিনি উত্তম রূপে আরবি-ফারসি ভাষা জানতেন৷ ওই যুগে আরবি ছিল প্রধানত জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ফারসি ভাষা কাব্যিক ও সাহিত্যিক উৎকর্ষতায় আকাশ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল৷ বাবুর ইচ্ছা করলে তাঁর আত্মকথা ফারসিতে লিখতে পারতেন কিন্তু তিনি তা না করে মাতৃভাষা চুগতাই তুর্কি ভাষায় লিখেছিলেন৷ ওই সময় চুগতাই সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে অত্যন্ত Poor ছিল৷ জনৈক চুগতাইভাষী বিশিষ্ট পণ্ডিত তাঁকে ঠিকই চিনেছিলেন এবং তাঁকে মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং বাবুর সেই পরামর্শ শিরোধার্য করে ওই ভাষাতেই সাহিত্যচর্চা করেন এবং তাকে উচ্চস্তরের সাহিত্যচর্চার বাহন করে তুলেছিলেন এবং তিনি ওই ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি রূপে অজরঅমরঅক্ষয়অব্যয় হয়ে আছেন৷
    লিপিবিশারদ বাবুর
    =============
    এশিয়া-আফ্রিকার আরব বলয়ের দেশগুলি সহ সমগ্র মধ্য এশিয়ার অনেকগুলো দেশগুলি ইসলাম গ্রহণ করার পর ওই দেশগুলিতে ভাষাসাহিত্যের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটে যায়৷ অনেকগুলো দেশ কালান্তরে আরবি মাতৃভাষারূপে গ্রহণ করে৷ যারা তা করে নি, তারা তাদের প্রচলিত ভাষার অতীত লিপিগুলি বদল করে আরবি লিপি গ্রহণ করে৷ অতিরিক্ত ধ্বনির ক্ষেত্রে আরবির সঙ্গে মিলিয়ে নতুন নতুন লিপি উদ্ভাবন করে৷ ইরান সহ মধ্য এশিয়ার ক্ষেত্রে এ কথা সমানভাবে সত্য৷ বাবুরের মাতৃভাষা চুগতাই তুর্কির ক্ষেত্রে এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য৷ উত্তরাধিকার সূত্রে বাবুর ওই ভাষা-লিপিই পেয়েছিলেন৷ এই ভাষা ছিল ব্যাপকভাবে আরবি-ফারসি প্রভাবিত৷ লিপি ও ধ্বনিবিশারদ বাবুর ওই ভাষার আদি লিপি মূল ধ্বনি সহ সংস্কার করে তাকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু ভাষাভাষী সমাজ তা মেনে নেয় নি; বরং প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন৷ পরে, বাবুর দুঃখ করে বলেছিলেন, মানুষ তার ভাষার লিপিকেও ধর্মগ্রন্থের মতো পবিত্র মনে করে৷ কোনো অবস্থাতেই তার পরিবর্তন স্বীকার করেনা৷
    উপসংহার
    =======
    তাইমুরী ঘরানার ঊজ্জ্বল রত্ন বাবুর এক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী ছিলেন৷ স্বদেশে-স্বভূমে তিনি মহান কবি ও সাহিত্যিক বলে সম্মানিত কিন্তু সেখান থেকে হাজার মাইল দূরের ভারতৈ তিনি মহিমান্বিত মোগল সাম্রাজ্য৷ যে রাজবংশ ভারতে কয়েক শ’ বছর স্থায়ী হয়৷ এই রাজবংশ পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশকে সমকালীন সময়ের চৈয়ে কয়েক শ’বছর এগিয়ে দিয়ে গিয়েছেন—যে ঋণ উপমহাদেশবাসী কোনোদিন শোধ করতৈ পারবে না!