ঝড় বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেও উদযাপিত হল বঙ্গা ও বাহা পরব

ডঃ শান্তনু পাণ্ডা, পশ্চিম মেদিনীপুর : ১৭\৪\২০২১ ও ১৮\৪\২০২১ বাংলার ৩ ও ৪ বৈশাখ ১৪২৮ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়গপুর গ্রামীন ১ নং ব্লকের শ্যামরাই পুর, আম্বা পশ্চিম(জগাই) গ্রামে প্রাকৃতিক বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করেই সারারাত ব্যাপী নাচ গান ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হল আদিবাসী কোড়া সমাজের ‘বাহা বঙ্গা’ ও ‘বাহা পরব’ই উৎসব। বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় দশ হাজার মানুষ উপভোগ করেন বঙ্গা ও বাহা পরব উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেই সাথে সাঁওতালি সম্প্রদায়ের নিজস্ব গান ও নাচের তালে দর্শক ও শ্রোতাদেরও কোমর দোলাতে দেখা যায়। অনুষ্ঠান শুরু পূর্বমূহুর্তে ঝড় বৃষ্টি হোয়ার জন্য মানুষের জমায়েত কমে গিয়ে ছিল রাত যত গড়িয়েছে ততই সমাজের সকল স্তরের লোকজনের জমায়েত বেড়েছে।অনুষ্ঠান মঞ্চ ও এলাকা পরিপূর্ণ ছিল পুরুষ ও মহিলাদের সক্রিয় অংশ গ্রহণে।

     

    অনুষ্ঠান মঞ্চের সামনে ছিল বাহাগাছ (কলাগাছ) খুব উচ্চতা বিশিষ্ট যার মাথায় ছিল ছাতা ও গোড়ায় ছিল পুজোর উপকরন । উড়িশ্যা, বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুর থেকেও সাঁওতালি ও কোড়া জনজাতির শিল্পী সম্প্রদায়েরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. অরূপ মজুমদার, বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও গবেষক। ড .শান্তনু পাণ্ডা, অধ্যাপক ও গবেষক। পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী কোড়া উপজাতি সমাজ কল্যান সংগঠনের রাজ্য কমিটির সদস্য দিনেশ মুদী ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সহ সম্পাদক সঞ্জীব মুদী। এছাড়া কোড়া উপজাতি সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বাবু মুকুন্দ মুদি, বাবু লক্ষ্মীরাম মুদি, বাবু মিতুন মুদি, মাই ভারতি মুদি, বাবু গণেশ সিং, বাবু যহন সিং, বাবু দুর্গা সিং, বাবু ভানু মুদি(মাস্টার) প্রমুখ।

    অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশিষ্ট দর্শক ও শ্রোতাদের থেকেই জানা যায় যে- আদিবাসী কোড়া সমাজে বিভিন্ন পূজা পার্বণের মধ্যে বাহা বঙ্গা ও বাহা পরব একটি অন্যতম উৎসব। বাহা হল আদিবাসী কোড়া সমাজে প্রকৃতির সৃষ্টি ফুল ও ফলের পূজো। অর্থাৎ আদিবাসী কোড়া ভাষায় ‘বাহা’ কথাটির অর্থ হল ফুল এবং এই বাহা বা ফুল বলতে বোঝায় শাল গাছের ফুল। বনে পাতা ঝড়ে যাওয়ার পর আবার নতুন রুপে সজ্জিত ফুল ও ফলে যখন বনজঙ্গল ভরে উঠে বসন্ত কে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে এই উৎসব। যা আদিবাসী সমাজের জীবনের যাত্রার প্রধান ধারক ও বাহক এই বাহা ও বঙ্গ উৎসব। কোড়া আদিবাসীরা হল প্রকৃতির পূজারি, তারা প্রকৃতির সৃষ্টি এই ফুল ও ফল নিজেদের খাওয়ার এবং ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগানোর জন্য সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর বা মারাং বঙ্গার কাছে প্রার্থনা করেন,- হে.. ধরাম বঙ্গা, গরাম বঙ্গা, বসমতা(অতেবঙ্গা) সাক্ষীকারি দেবতা হিসাবে সিঙ্গি বা সিং বঙ্গা(সূর্য দেবতা) এবং বেলা চাঁন্দুব(চন্দ্র দেবতা)কে পূজোর মাধ্যমে সৃষ্টির সমস্ত দেবতাদের স্বরন করা হয়।

    আদিবাসী কোড়া সমাজের মানুষদের বিশ্বাস এই জগৎ ও বিশ্ব ব্রহ্মান্ড ঈশ্বর বা মারাং বঙ্গার সৃষ্টি, তাই কোন কিছুই তার অনুমতি ছাড়াই নেওয়া বা গ্রহণ করা এই সর্ব শক্তি মান ঈশ্বর বা মারাং বঙ্গাকে অবজ্ঞা করা।এই ঈশ্বর বা মারাং বঙ্গা আমাদের জন্য সব সৃষ্টি করেছে…..তাই কোন কিছু নেওয়া বা গ্রহণের আগে ঈশ্বর বা মারাং বঙ্গার অনুমতি নেয় কোড়া সমাজের মানুষজনেরা। তাই কোড়া সমাজের মানুষজনের বিশ্বাস সব কিছুই আমাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এই ব্রহ্মান্ডে।এই বাহা বঙ্গা বা বাহা পূজো যতক্ষণ না হয় আদিবাসী কোড়া সমাজে কেউ বনের নতুন পাতা ও ফল বা বং ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকেন। তাই এই বাহা বঙ্গা বা বাহা পূজোর মাধ্যমে আদিবাসী কোড়া সমাজে বাহা পরব প্রকৃতির উৎসবটি পালিত হয় খুব ধূমধামে।

    গ্রামের ছেলে মেয়ে মহিলা বুড়ো বুড়ি সব স্তরের মানুষজনেরা এই বাহা বঙ্গা বা বাহা পুজোতে সামিল হয় এবং একে অপরের সঙ্গে ভাব বিনিময় হয়। প্রকৃতির সৃষ্টি ভারসাম্য ও প্রকৃতির সৃষ্টিকে সম্মান জানাতে আদিবাসী কোড়া সমাজে যুগ যুগ ধরে এই বাহা বঙ্গা ও বাহা উৎসব পালন করে আসছে।

    খড়গপুর গ্রামীণ ব্লক-১ এর বাহা বঙ্গা উৎসবটি আয়োজন করে ছিলেন “জগাই গরাম বুডি কোড়া সমিতি”। গত শনিবার বাংলা ৩ রা বৈশাখ সকাল থেকে বাহা বঙ্গা বা বাহা পূজোর মাধ্যমে এই পূজোটি শুভ সূচনা হয় গ্রামের মাঝি হাড়াম হাত ধরে।

    প্রথাগত আদিবাসী বর্নাঢ্য প্রভাত ফেরির মাধ্যমে তুলে ধরা হয় কোড়া সমাজের প্রাচীন সামাজিক রীতি নীতির-রিবাজমান সংস্কৃতি। সন্ধ্যে থেকে সমাজের গুণীজনদের সম্মান জ্ঞাপন ও দরিদ্র মানুষদের বস্ত্র বিতরন, এছাড়াও আদিবাসী কোড়া সমাজের সংস্কৃতি, গান, ও বাহা পরবের নাচ সারা রাত্রি ব্যাপী চলতে থাকে। এলাকার সম্মানীয় বিধায়ক দীনেন রায় মহাশয় প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত থাকলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ভোটের ব্যস্ততার কারণে উপস্থিত হতে পারেননি। তিনি অনুষ্ঠানের সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করে কমিটিতে বিশেষবার্তা দিয়েছেন।

    সাঁওতালি সমাজ থেকে বিশিষ্ট গায়ক হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন উড়িশ্যার মিস পয়রানী সরেন, মিস জবারাণী হেমব্রম, মিস্টার লক্ষ্মীরাম কিস্কু এবং বর্ধমান থেকে বাবু নিখিল টুডু মহাশয়।

    কোড়া জনজাতির সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করতে সন্ধ্যা থেকেই অনুষ্ঠান মঞ্চে হাজির ছিলেন নৃতত্ত্ব ও ভাষা গবেষক ড. অরূপ মজুমদার মহাশয়। তিনি অনুষ্ঠানের সার্বিক সাফল্য কামনা করে উপজাতি সমাজের ভাষা যাতে হারিয়ে না যায় সে কথা তুলে ধরেন। ড. মজুমদার সম্পাদিত ‘কোড়া রচিত’ বইটি মঞ্চ থেকে কোড়া জনজাতির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের হাতে তুলে দেওয়া হয় ।

     

    এই প্রসঙ্গেই ড. মজুমদার বলেন যে- ‘প্রকৃতির উপাসক ও গাছ প্রেমী কোড়া জনজাতির মতোই সমাজের সকল স্তরের লোকজনকে বৃক্ষ রোপন ও তাকে সংরক্ষণ করতে হবে। নইলে নগরায়ণ সভ্যতায় পরিবেশের ভারসাম্য অতিরেই নষ্ট হবে। অধ্যাপক ও নৃতত্ত্ব গবেষক ড. শান্তনু পাণ্ডা মহাশয় ও গবেষণার কারণেই সারারাত ব্যাপী অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন । ড. শান্তনু পাণ্ডা উল্লেখ করেন যে- ‘কোড়া জনজাতি সহ সমস্ত জনজাতির ভাষা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার মান উন্নয়ন এর জন্য সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।’ ড. পাণ্ডা তুলে ধরেন উপজাতিদের সার্বিক উন্নয়নের কথা। শিক্ষা ও সাস্থ্য যাতে নষ্ট না হয় এবং ছেলে মেয়েরা যাতে বিপথে না যায় বা নেশাগ্রস্ত না হয় সে কথা তুলে ধরেন ড. পাণ্ডা।