বাংলাদেশের ভালুকায় গড়ে উঠা কুমিরের খামার

 

    নতুন গতি বাংলাদেশ ব্যুরো : বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ভালুকায় বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছে কুমিরের খামার। ২০০৪ সালে ভালুকা উপজেলার উথুরায় ব্যবসায়ী মোস্তাক আহম্মেদ ও মেজবাউল হকের উদ্যোগে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড নামে কুমিরের এই ফার্ম গড়ে তোলা হয়। ২০১৯ সালে ২৫১টি কুমিরের চামড়া জাপানে রফতানি করা হয়েছে। প্রতিটি চামড়ার মূল্য ধরা হয়েছে ৫শ ডলার করে। এই প্রকল্পে বর্তমানে ২৫ জন কর্মচারী কাজ করেন।

    মূলত মোস্তাক আহম্মেদ ও মেজবাউল হক ভ্রমণপিপাসু ছিলেন। চাকরি ও লেখাপাড়ার সুবাধে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। তখনই উদ্যোক্তা হয়ে কুমির চাষ শুরু করেন। তারাই দেশে প্রথম কুমির চাষ শুরু করেন। এই প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ডা. আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ জানান, ব্যক্তি উদ্যোগে ১৫ একর জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় এই কুমিরের প্রকল্প। ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া থেকে প্রায় সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে আনা হয় ৭৫টি কুমির। যার মধ্যে ছিল ১৫টি পুরুষ কুমির।

    কুমিরগুলোকে বিশেষভাবে তৈরি পুকুরে ছেড়ে দেশীয় আবহাওয়ায় লালনপালনে মানানসই করে তোলা হয়। বর্তমানে এই ফার্মে কুমিরের সংখ্যা ছোট বড় মিলিয়ে ৩ হাজার একশর মতো।প্রথমদিকে আবহাওয়া ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে ৫ থেকে ৭টি ব্রিডার কুমির মারা যায়। এসব কুমিরদের বাঁচিয়ে রাখা, ডিম পাড়া, ডিম সংরক্ষণ এবং তা থেকে বাচ্চা ফোটানোসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংশয় দেখা দিলেও অল্পদিনের মধ্যে আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে ওঠে।

    ব্যবস্থাপক আরিফ আরও জানান, কুমিরের চামড়া, মাংস, হাড় ও দাঁত চড়া মূল্যে বিক্রি হয় আন্তর্জাতিক বাজারে। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ২০১০ সালে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম ৬৯টি হিমায়িত কুমির রফতানি করা হয়। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে জাপানে মোট ১ হাজার ৫০৭টি কুমিরের চামড়া রফতানি করা হয়েছে। প্রতিটি কুমিরের চামড়া ৫-৬শ ডলার মূল্যে রফতানি করা হয়। ২০২১/২২ সাল নাগাদ প্রতি বছর কুমিরের ১ হাজার চামড়াসহ মাংস রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে বলে জানায় ফার্ম কর্তৃপক্ষ।

    কুমির চাষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস হতে পারে উল্লেখ করে ব্যবস্থাপক আরিফ বলেন, এটি সৃষ্টি করতে পারে অনেক কর্মসংস্থান। বাংলাদেশ বনবিভাগ নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য যুগোপযোগী ও সহায়ক নীতিমালা তৈরি করেছে। যা নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করবে। কেউ কুমির চাষে আগ্রহী হলে তাদের সার্বিক সহযোগিতার কথাও জানান আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ।

    তিনি জানান, সাধারণত ৮ থেকে ১০ বছর বয়সে কুমির ডিম পাড়া শুরু করে। বর্ষাকালে বছরে একবার একই সময়ে গড়ে ৪৫ থেকে ৬০টি ডিম দিয়ে থাকে কুমির। মোট ডিমের ৮০ শতাংশ থেকে বাচ্চা পাওয়া যায়। বাণিজ্যিকভাবে সাধারণত লোনা পানির প্রজাতির কুমিরের চাষ করা হয়। এই প্রজাতির কুমির সাধারণত ঘাস, লতাপাতা জড়ো করে বাসা তৈরি করে ডাঙ্গায় ডিম দেয়। কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাতে ৮০ থেকে ৮৫ দিন সময় লাগে। এক জোড়া কুমিরের জন্য সাধারণত ৮০ বর্গমিটার জায়গা লাগে।

    ৩ বছর বয়সের কুমিরের চামড়া রফতানি করা যায়। রফতানিযোগ্য কুমিরকে ডিম ফোটানোর পর থেকে বিশেষভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত পুকুরে লালন পালন করা হয়। চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার আগে কুমিরকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে অজ্ঞান করে জবাই করা হয়। তারপর প্রশিক্ষিত শ্রমিক দিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়। চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার পর লবণ দিয়ে চিলিং রুমে মজুত রাখা হয়। কুমিরের খাবারের জন্য এই ফার্মের নিজস্ব ব্রয়লার মুরগির খামার, মাছের পুকুর, ডিম ফোটানোর জন্য অত্যাধুনিক ইনকিউবেটর, কুমিরের বাচ্চার জন্য বিশেষভাবে তৈরি হ্যাচারি, পৃথক শেড, চামড়া প্রসেসিং জোন, চামড়া মজুত রাখার জন্য চিলিং রুম, ব্রিডার পুকুর রয়েছে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার পর এক বছর বয়স পর্যন্ত কুমিরকে প্রতিদিন খাবার দিতে হয় একবার করে। এক বছর বয়স থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত কুমিরকে সপ্তাহে ৫ দিন করে খাবার দিতে হয়।২ বছর থেকে ৩ বছর বয়স পর্যন্ত কুমিরকে সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন খাবার দিতে হয়। ব্রিডার কুমিরকে সপ্তাহে ১ দিন খাবার দিতে হয়।

    ছোট কুমিরকে গরু ও মুরগির মাংসের কিমা এবং মুরগির মাথা দেয়া হয়। ব্রিডারে কুমিরকে বয়লার মুরগি, গরুর মাংস ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ দেয়া হয়। বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞ ড. শেখ মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ বলেন, কুমির ব্যবসা ঝুঁকিমুক্ত। দেশে ইতোমধ্যে দুটি কুমির খামার গড়ে উঠেছে। তবে ব্যবসায়ীরা যদি আজকে বিনিয়োগ করে কালকেই মুনাফা চান তাহলে এ ব্যবসায় সুবিধা করতে পারবেন না। বেশি পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসায় লেগে থাকতে হবে। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা একেএম রুহুল আমিন বলেন, দেশে কুমির চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার কুমির চাষিদের নানাভাবে উৎসাহিত করছে। কেউ শর্ত মেনে আবেদন করলে পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেয়া হবে। তবে অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় কুমির চাষ একটু ভিন্ন। এতে পুঁজি বেশি লাগলেও দীর্ঘ মেয়াদী এ ব্যবসায় ক্ষতির সম্ভাবনা খুবই কম। আন্তার্জাতিক বাজারে চামড়ার কদর থাকায় প্রতি বছরই বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে খামারিরা চামড়া রফতানি করছেন। ভবিষ্যতে কুমিরের মাংসও রফতানি হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন রুহুল আমীন।