বাংলাদেশের ঢাকার ঐতিহ্যের বাখরখানি

 

    নতুন গতি বাংলাদেশ ব্যুরো : তোমরা বাখরখানি এনে দাও আমাকে। আমি বাখরখানি খাব’- এ আবদারটি পুরান ঢাকার একটি শিশুর। প্রতিদিন সকাল হলেই তার এ আবদারটি রক্ষা করতে হয়। বাখরখানি শুধু শিশুদেরই নয়, বড়দের কাছেও সমান প্রিয়। বাঙালির প্রায় আড়াই’শ বছরের প্রিয় খাবার বাখরখানি। ঐতিহ্যবাহী এ খাবারটি ঢাকার আদি বাসিন্দাদের কাছে জনপ্রিয়। বিশেষ করে সকালের নাশতা হিসেবেই এর কদর বেশি। এটি এখন শুধু ঢাকার আদি বাসিন্দাদের কাছে নয় এ বাখরখানি মফস্বল শহরগুলোতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
    বাংলাদেশের ঢাকা নগরীর অনেক কিছুই আজ হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে সেদিনের সেই পুরনো সময়। মসলিন, কালীবাড়ি গলির মোড়ের বাতিওয়ালার বাতি। হারিয়েছে অনেক স্মৃতি। তবু ঐতিহ্য হয়ে এখনও টিকে আছে ঢাকার পুরনো অনেক পথ, পুরনো দালান আর পুরনো সব খাবার। তারই মধ্যে বাখরখানি অন্যতম। অনেক খাবারের মধ্যেও বাখরখানি যেন এক আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে আছে। স্বাদের কথা বিচার করলে এর তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে পাওয়া যাবে না।

    বাখরখানির আদি কথা সম্পর্কে জানা যায়, বাখরখানি নামটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঢাকার ইতিহাস। আঠারো শতকের কথা। ঢাকার নায়েব নাজিম মীর লুৎফুল্লাহ্ ওরফে দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খাঁর জামাতা ছিলেন মির্জা আগা বাকের। নবাব সিরাজদ্দৌলার অনুরক্ত বাকের ছিলেন বুজর্গ উম্মেদপুর ও সালিমাবাদ পরগনা দুটির জমিদার। আগা সাদিক ছিলেন তার পুত্র।

    জনশ্রুতি অনুযায়ী, আগা বাকের ও তার স্ত্রী খানি বেগমের নামানুসারেই মচমচে এ রুটির নাম রাখা হয় ‘বাখরখানি’, যা থেকে পরে লোকমুখে এর প্রচলিত নাম হয়ে যায় বাখরখানি। নবাব পরিবারের বাবুর্চিরাই এ বাখরখানির আবিষ্কারক।

    স্যার সলিমুল্লাহ্ থেকে শুরু করে নবাব ও নবাব পরিবারের সদস্য ছিলেন বাখরখানির ভক্ত। সকালের নাশতায় গোশত ও বাখরখানি না হলে চলত না তাদের। প্রথম নবাব পরিবারের প্রিয় খাবার হিসেবে থাকলেও পরে এর বিস্তৃতি ঘটে এলাকাবাসীর মধ্যে। সেই থেকে আজও আছে বাখরখানির চাহিদা। তবে এর চল আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে। কমে গেছে সকালের নাশতায় মাংস, চা কিংবা মিষ্টির সঙ্গে বাখরখানি রুটির প্রচলন। কমে গেছে এর তৈরি ও বিক্রিত। ভাঙা দোকান আর পুরনো চুলায় তবু এখনও তৈরি হয় বাখরখানি।

    কথা হল পুরান ঢাকা নাজিমউদ্দিন রোড, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতীবাজার ও লালবাগের কিছু বাখরখানি কারিগর এবং দোকান মালিকের সঙ্গে। ‘ফরিদ মিয়ার এক নম্বর বাখরখানি’ পুরান ঢাকার একটি দোকান। নাজিমউদ্দিন রোডে এর অবস্থান। মালিকের নাম ফরিদ মিয়া। এ দোকানে কাঠের বাক্সের ভেতর বাখরখানি রাখা হয়। এখানে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হয়। বাখরখানির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এক প্রবীণ ব্যক্তির নাম লালবাগের হাজী করিম।

    তিনি বেঁচে নেই। বাখরখানি পেশার খুব নাম ছিল তার। এখনও সেরা দোকানের নাম এলে সবাই তার দোকানের কথা বলেন। লালবাগ চৌরাস্তা থেকে হরনাথ ঘোষ রোডের দিকে গেলে সারি সারি দোকানের ভিড়েও হাজী করিমের বাখরখানি দোকানটি নজর এড়ায় না। প্রায় ৬২ বছরের ঐতিহ্য রয়েছে এটির। এখন অবশ্য ছোট পরিসরের দোকানটি শুধু শোরুম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। হাজী করিমের বংশধররা তাদের পৈতৃক পেশাটিকে আজও আঁকড়ে রেখেছেন। ‘আমার বাবা যে সিলসিলা জারি করে গিয়েছিলেন আমি তা ধরে রাখতে পেরেছি। আমার ছেলে পেরেছে। আমার নাতিরাও পারবে’- গর্ব করেই বললেন হাজী করিমের যোগ্য উত্তারাধিকারী কামাল হোসেন। তিনি বলেন, বাবা হাজী করিম সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পায় আশির দশকের প্রথমদিকে হজ্ব থেকে আসার পর। সৌদি আরবে মুজাহিরদের কাছে তিনি হয়ে যান ‘বাঙালি রুটিওয়ালা’। কামাল হোসেনের ছেলে রাণীও বেশ গর্ববোধ করেন পিতামহকে নিয়ে। আমাদের সহায়-সম্পত্তি, পড়াশোনার খরচ, বোনদের বিয়ে সবই হয়েছে বাখরখানির ব্যবসা থেকে। সারা ঢাকায় হাজী করিম রুটিওয়ালা এক নামে পরিচিত। এখনো আমার দাদার নামেই আমাদের পরিচয়।

    মো. সিদ্দিক মিয়া। প্রায় ৪০ বছর ধরে বাখরখানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কাজী আলাউদ্দিন রোডে তার দোকান। বাপ-দাদাকে দেখেছেন বাখরখানি রুটি তৈরি করতে। সেই থেকে দেখতে দেখতে তিনি এ কৌশল শিখে বাপ-দাদার ব্যবসার হাল ধরেছেন। পুরান ঢাকার সবাই কাকডাকা ভোর হতেই রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে বাখরখানির দোকানের ঝাঁপি খুলতে না খুলতে হাজির হয়। তাদের কারও হাতে মগ থাকে। উদ্দেশ্য চা ও বাখারখানি কেনা। কেউ কেউ আবার মিষ্টিও কেনেন। সকালে চা কিংবা মিষ্টি এবং বাখরখানি সহযোগে ভালোই নাশতা হয়ে যায় তাদের।

    সময় পাল্টে গেছে, এসেছে নানা পরিবর্তন, বদলে গেছে ঢাকার খাবার তালিকা, নির্মাণ প্রক্রিয়া ও কাবার মেন্যু। কিন্তু এসব পরিবর্তনের সঙ্গে বদলায়নি প্রাচীন খাবার বাখরখানি। পুরান ঢাকাবাসীর উদ্দেশ্যে বছরে মাঝে মধ্যে বাখরখানির ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কিংবা মনে রাখার জন্য জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে দিনব্যাপী বাখরখানির প্রদর্শনী বা উৎসব হয়ে থাকে। এখন ঢাকার বাহিরেও মফস্বল শহরগুলো বাখরখানি পাওয়া যায়। এভাবেই বাখরখানি টিকে আছে সবার মনে।