মেছো বাঙালির পাতে কোপ,মৎস্য দপ্তরের পুনর্গঠন তবু অধরা

নতুন গতি নিউজ ডেস্ক: বিয়ে বাড়ী হোক বা কোন শুভ কাজ; অসুখ হলে বা আনন্দের দিনে বাঙালির পাতে মাছ চাই -ই চাই। হ্যা, এক বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা অনুযায়ী, মাছে-ভাতে বাঙালিরা সবচেয়ে বেশি প্রকারের মাছ ভক্ষণ করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভোজনরসিক বাঙালির পাতে মাছের কোপ এক ভয়াবহ চেহারা নিচ্ছে; করোনার প্রভাবে ভবিষ্যতে মাছ আর বাঙালির পাতে আসবে কি না সে নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

    কিন্তু মাছ প্রেমী বাঙালির থালা থেকে অদৃশ্য কোন ‘চিল’ মাছ নিয়ে চলে যাচ্ছে? এমন প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক এবং তার উত্তরটাও একটু খুঁজলেই পাওয়া যায়।এককালে মাছ উৎপাদনে শীর্ষে থাকা বাংলাকে পিছনে ফেলে প্রায় দ্বিগুণ এগিয়ে গেছে অন্ধ্রপ্রদেশ। যেখানে ২০১৮ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ মাছ উৎপাদন করেছে ৩৪.৫০ লক্ষ টন, সেখানে বঙ্গের মাছ উৎপাদন টেনেটুনে ১৭.৪ লক্ষ টন। এমনকি মাছ উৎপাদন হারে বঙ্গের চেয়ে অনেক এগিয়ে উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড ও বিহারের মত সীমিত জলসম্পদ সম্পন্ন রাজ্য গুলি! শুধু তাই নয়, বেসরকারী আরতদারদের রমরমায় আমার আপনার পছন্দের মাছ গুলোর দাম এতই বেড়েছে যে তা আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। অন্য দিকে আবার দেশি মাগুর, পাবদা, চিতল, সরপুঁটি, মহাশোল, ভেটকি প্রভূত সুস্বাদু মাছ গুলোও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে বিপন্ন। করোনা আবহে বা নিম্নচাপের প্রভাবে সমুদ্রে মাছ ধরানিষিদ্ধ থাকায় সামুদ্রিক মাছেও ভাটা পড়েছে। ফলস্বরূপ আমাদের হজম করতে হচ্ছে বাইরে থেকে আসা ফর্মালিনে (সংরক্ষক বিষ) ডোবানো পুরোনো মাছ বা কখনও বাজারে গিয়েও মাছ না পেয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে! ১৫৮ কিমি উপকূল রেখা এবং প্রায় ৪ লক্ষের মত মৎস্যজীবি থাকা সত্ত্বেও মাছ উৎপাদন বা জোগানে বাংলার কেন এমন হাল? কারণ টা কী জানেন? কারণটা হলো পশ্চিমবঙ্গের মৎস্য দপ্তরের দুর্বল পরিকাঠামো। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা যাক।

    কখনও কী শুনেছেন কোনো বৃত্তি মূলক শিক্ষায় শিক্ষিত নিম্নপদস্থ সহায়ক পদ থেকে কেউ পদোন্নতি পেয়ে মেডিক্যাল অফিসার হয়েছে বা ভেটেরিনারি অফিসার হয়েছে বা কৃষি অফিসার হয়েছে? শোনেন নি তো? কিন্তু মৎস্য দপ্তরে (পশ্চিমবঙ্গ সরকার) এমনটাই হয়।
    ব্লক স্তরে ফিশারি এক্সটেনশন অফিসার ( F.E.O.) পদে নিম্নপদস্থ বৃত্তি মূলক ডিগ্রী প্রাপকদের পদোন্নতি দেওয়া হয় ৪০% পদে আর মৎস্য বিজ্ঞানে চার বছরের প্রফেশনাল ডিগ্রী বি.এফ.এস.সি ( B.F.Sc.- ব্যাচেলার অফ ফিশারিজ সাইন্স) যা ইউ.জি.সি (U.G.C.) অনুমোদিত এবং আই.সি.এ.আর (I.C.A.R.) স্বীকৃত তা হয় বঞ্চিত। ফলস্বরূপ ছাগল দিয়ে লাঙল চাষ করতে গিয়ে আজ বাংলা ও বাঙালির প্রিয় ও সহজলভ্য মাছ হয়ে উঠেছে দুর্লভ ও দুর্মূল্য।

    মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনই এক সংকটের আভাস পেয়ে ৬- জন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও তৎকালীন মুখ্য সচিবকে নিয়ে গঠন করেন “স্পেশাল টাস্ক ফোর্স অন ফিশারিজ”। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে জমা পড়ে তার রিপোর্টও। যার রিপোর্ট মোতাবেক- মৎস্য দপ্তরকে অবিলম্বে কৃষি দপ্তর ও প্রাণী সম্পদ বিকাশ দপ্তরের সমতুল্য গঠন পরিকাঠামো প্রদান এবং যোগ্য স্থানে যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োজিত করার জন্যে অতিসত্ত্বর মৎস্য দপ্তরের পুনর্বিন্যাস করতে হবে।

    কিন্তু রাজ্যের মৎস্য দপ্তর টাস্ক ফোর্সের সেই সমস্ত সুপারিশকে অবজ্ঞা করায় বাংলার মৎস্য সম্পদ তথা লক্ষাধিক মৎস্য চাষীদের জীবন আজ সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ২০১৮ সালে মৎস্য দপ্তরের পুনর্গঠন সংক্রান্ত রিপোর্ট তলব করলেও রাজ্যের মৎস্য দপ্তর বরাবরের মত চির নিদ্রায় মগ্ন থেকেছে। ২০১৭ সালে বাংলার প্রফেশনাল মৎস্য বিজ্ঞান পড়ুয়াদের (বি.এফ.এস.সি.) আন্দোলনের ফলে, মৎস্য দপ্তর পুনর্গঠনের জন্যে দুটি কমিটি গড়লেও, দপ্তরের আমলা, কর্তাদের চরম উদাসীনতায় তার পূর্ণাঙ্গ ও যোগ্য সম্মত রিপোর্ট আজও নবান্নে পৌঁছল না।

    তাই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত টাস্ক ফোর্সের সুপারিশকে কার্যকর করতে, মাছে ভাতে বাঙালির পাতে তাজা মাছ ফিরিয়ে দিতে এবং বি.এফ.এস.সি ডিগ্রীর প্রাপ্য সম্মান আদায় করতে, পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীরা নামে এক লড়াইয়ে যার পোষাকি নাম ” নীল অভিযান”। ২০১৫ সালে ১৬ দিন, ২০১৭ সালে ২২ দিন ক্যাম্পাসে অবস্থান বিক্ষোভ ও অনশন আন্দোলন করে আশানুরূপ কোন ফল না হওয়ায় বাংলার সরকার অধীনস্থ একমাত্র কারিগরী মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের পড়ুয়ারা গত ১৭ ই ডিসেম্বর,২০১৯ থেকে ৯৪ দিন ফ্যাকাল্টি লক-আউট করে আন্দোলন শুরু করে যা সাম্প্রতিক কালের সর্ব দীর্ঘ ছাত্র আন্দোলন। শুধু তাই নয়, পোষ্টকার্ডে হাত কেটে নিজেদের রক্ত দিয়ে বি.এফ.এস.সি ডিগ্রীর সম্মান রক্ষার (save B.F.Sc.) আর্তি জানিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে পড়ুয়ারা কালীঘাট ও নবান্নে চিঠি পাঠান। পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্র শ্রী সায়ন্তন ভট্টাচার্য ও মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের বর্ষসেরা ছাত্রী সায়ারী চক্রবর্তী মৎস্য দপ্তরের অবিলম্বে পুনর্গঠন করার দাবীতে মূল অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে গত ২রা জানুয়ারী,২০২০ স্বর্ণ পদক ফিরিয়ে দেন। মৎস্য দপ্তরকে জাগিয়ে তুলতে খোদ কলকাতার বুকে অজয়নগর ও শ্যামবাজারে দুটি পদযাত্রা করেন মৎস্য বিজ্ঞান পড়ুয়ারা। বাইরের রাজ্য যেমন মুম্বাই, কর্ণাটক, মধ্য প্রদেশ, কেরালার প্রফেশনাল মৎস্য বিজ্ঞান পড়ুয়ারা (বি. এফ. এস.সি.) বাংলার নীল অভিযানের প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন রাজ্যের মাছ চাষে উন্নতির জন্য। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র প্রতিনিধিরা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মৎস্য দপ্তরের পুনর্গঠন নিয়ে আবারও তাঁর সদিচ্ছা প্রকাশ করেন।

    এপ্রসঙ্গে মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের পড়ুয়া শৈলেশ মহাপাত্র জানান, “করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটায় আমরা এখন ক্যাম্পাসে আন্দোলন করতে না পারলেও ফেসবুক, টুইটার ও ইমেইলে আমাদের ডিজিট্যাল আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দাবী অর্থাৎ টাস্ক ফোর্স অন ফিশারিজ -এর সুপারিশ মোতাবেক অবিলম্বে মৎস্য দপ্তরের পুনর্গঠন সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের নীল-অভিযান চলবে।”

    শুধুমাত্র সেকেলে প্রথা অনুসরণ করে মাছ চাষে আর উন্নতি সম্ভবপর নয়; চাই উন্নত প্রযুক্তি, যাতে প্রান্তিক মাছ চাষীরা নিত্য নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মাছের উৎপাদন বাড়াতে পারে। উপরন্তু মৎস্য দপ্তরের পরিকাঠামোতে পরিবর্তন এলে, উৎপাদিত মাছ এবং মৎস্য জাত দ্রব্য অন্য দেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগও পাবে রাজ্য সরকার যা দিয়ে সরকারের “ভাঁড় -এ মা ভবানী” সম কোষাগার পূর্ণ হওয়ার সম্ভবনা থাকে। কিন্তু এই সবের জন্য মৎস্য দপ্তরের পুনর্গঠন আশু জরুরী আর তবেই হয়ত বাংলা মাছ চাষে তার পুরোনো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারবে।

    এত কিছুর পরেও মৎস্য দপ্তরের পুনর্গঠন তথা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের টাস্ক ফোর্স অন ফিশারিজ (২০১৩)- এর বাস্তবায়ন আজও অধরা। উচ্চ মাধ্যমিকে ৮৫-৯৫% নম্বর পেয়ে, একে অপরকে টেক্কা দিয়ে পড়তে আসা বি.এফ.এস.সি. স্নাতকদের ভবিষ্যতই বা কি? কে বা কাদের চক্রান্তে মৎস্য দপ্তরের পুনর্বিন্যাসে এত গড়িমসি হচ্ছে? কেন আমন্য হচ্ছে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ? এসবের উত্তরের মধ্যেই রয়েছে বাঙালির পাতে মাছ পাওয়ার আশা।