ভারতরত্ন ড: এ.পি.জে. আব্দুল কালামের নামাঙ্কিত সম্মাননা পেলেন জঙ্গলমহলের স্কুলের শিক্ষক সুব্রত মহাপাত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা,নতুন গতি, মেদিনীপুর: নতুন দিল্লির ইন্ডিয়ান সলিডারিটি কাউন্সিল থেকে সম্মাননা পেয়ে জঙ্গলমহলকে গর্বিত করলেন শিক্ষক সুব্রত মহাপাত্র।শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মিশাইল ম‍্যান ভারতরত্ন ড.এ পি জি আব্দুল কালামের নামাঙ্কিত সম্মাননা পেলেন, ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপু্র-২ নম্বর ব্লকের বেলিয়াবেড়া কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতি উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক সুব্রত মহাপাত্র। তাঁকে এই সম্মাননা প্রদান করেছে নতুন দিল্লির” ইন্ডিয়ান সলিডারিটি কাউন্সিল”।এই কাউন্সিল মূলতঃ শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং ব্যবসা – বাণিজ্যের ক্ষেত্রে” উৎকর্ষতার” জন্য এই সম্মাননা প্রদান করে থাকে।

    কিছুদিন আগে ডাকযোগে আসা ইন্ডিয়ান সলিডারিটি কাউন্সিলের চিঠি থেকে সুব্রতবাবু জানতে পারেন তিনি এবছর এই সম্মাননা পেতে চলেছেন। পরবর্তী কালে করোনা জনিত পরিস্থিতির কারণে “ভার্চুয়াল ” অনুষ্ঠানের মাধ্যমে “ভারতরত্ন” কালামের নামাঙ্কিত এই সম্মাননা প্রদান করা হয়। সম্মাননা হিসেবে সুব্রতবাবুকে একটি মানপত্র ও একটি স্মারক প্রদান করা হয়েছে। যা ইতিমধ্যেই সুব্রতবাবুর কাছে এসে পৌঁছেছে।
    শিক্ষাক্ষেত্রে মূলতঃ গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সুব্রতবাবুকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। প্রথমতঃ বেলিয়াবেড়া স্কুলে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধের লক্ষ‍্যে পঞ্চম ও একাদশ শ্রেণীতে ভর্তির সময় ছাত্রীদের অভিবাবকদের ” কাছ থেকে অঙ্গীকার পত্র” প্রদান বাধ‍্যতামূলক করা হয়েছে। । “১৮ বছরের আগে আমার কন্যার বিবাহ দেবো না এবং তাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ প্রদান করবো ” এই সারমর্মকে সামনে রেখে অঙ্গীকার পত্র গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগ ছিল সম্পূর্ণভাবে সুব্রত বাবুর মস্তিষ্ক প্রসূত। উনি ২০১৭ সাল থেকে বিদ‍্যালয় প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালু করেছেন এই অভিনব উদ্যোগ। ঝাড়গ্রাম জেলায় বিদ‍্যালয় স্তরে তিনিই সর্বপ্রথম বাল্য বিবাহ রোধে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। যা সরকারীস্তরে বহুল প্রশংসিত হয়েছে এবং রোল মডেল হিসেবে জেলার সমস্ত স্কুলে চালু করার জন্য জেলা শিক্ষা দফতর ভাবনা চিন্তা চালাচ্ছেন।

    দ্বিতীয়তঃ গোপীবল্লভপুর- ২ নম্বর ব্লকে সরকারী ডিগ্রি কলেজ স্থাপনের অন্যতম মূল মূল উদ্যোক্তা সুব্রতবাবু। আদিবাসী অধ্যুষিত এই ব্লকের অনেক ছাত্রছাত্রীই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস‍্যার পড়তো নিজের ব্লকে কনো কলেজ না থাকার কারণে। দূরবর্তী কলেজে গিয়ে পড়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে অনেক ছাত্র ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন ভঙ্গ হতো। এই অকালে ঝরে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে সুব্রতবাবুরা ২০১২ সাল থেকে গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকে কলেজ শুরুর দাবীতে লড়াই শুরু করেন। অবশেষে সেই লড়াই জয়ী হয়,২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঘোষণা করেন, বেলিয়াবেড়াতেই সরকারী ডিগ্রি কলেজ স্থাপনের কথা। এর মাঝে রয়েছে হার না মানা এক সংগ্রামের ইতিহাস।যার নেতৃত্বে ছিলেন শিক্ষক সুব্রত মহাপাত্র। সুব্রতবাবুর এই প্রচেষ্টাকে ওই ব্লকের আপামর জনসাধারণ কুর্ণিশ জানিয়েছেন। এরফলে এলাকার ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ সুবিধা হয়েছে।
    তৃতীয়তঃ গোপীবল্লভপুর-২ নং ব্লকে পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রথম “কন্যাশ্রী” লাইব্রেরী ও রিডিং রুম” স্থাপনের অন্যতম সহযোগী উদ্যোক্তা হলেন সুব্রতবাবু। ব্লক প্রশাসনে ও সুব্রতবাবুদের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে এই লাইব্রেরী।এই লাইব্রেরী শুরুর প্রথম থেকেই সুব্রতবাবুই এই লাইব্রেরীর কনভেনর। এই পাঠাগারে অষ্টম শ্রেণী থেকে স্নাতকস্তর পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের সহায়িকা বই, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির বই,নানান ম্যাগাজিন, নাটক,,গল্প, উপন্যাস সহ দেশ বিদেশের নানান বই রয়েছে এই লাইব্রেরীতে। জঙ্গল মহলের উপর লেখা নানান বইও রয়েছে। বর্তমানে প্রায় প্রায় ১৫ হাজার বই রয়েছে এই লাইব্রেরীতে। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লাইব্রেরীর পরিকাঠামোগত উন্নতির জন্য প্রায় ৩৩ লক্ষ টাকা দিয়েছেন।
    সুব্রতবাবু জানান, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অনেক ছাত্রছাত্রীই আর্থিক কারণে নানা বই কিনতে পারে না এবং অনেকেই টিউশান নিতে পারে না। তাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে চলেছে এই লাইব্রেরী।


    এছাড়াও শিক্ষামূলক ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থবাহী অনেক কাজের পাশাপাশি, পুলিশ, প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে তিন তিনটে নাবালিকার বিয়ে আটকে , তাদের পুনরায় স্কুলের আঙিনায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন সুব্রতবাবু। জঙ্গলমহলের কিছুটা পিছিয়ে থাকা এই গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকের শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে সুব্রতবাবুর বিভিন্ন প্রচেষ্টা গুলিকে সম্মান জানিয়েয় সুব্রতবাবুকে এই সম্মাননার জন্য নির্বাচিত করেছে ইন্ডিয়ান সলিডারিটি কাউন্সিল।

    উল্লেখ্য যেসমস্ত “ব্যক্তিত্ব” এই সম্মাননা পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এয়ার ইন্ডিয়া লিমিটেডের প্রাক্তন ম‍্যানেজিং ডিরেক্টর ডি এস মাথুর, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ভি. আর. মেহেতা, শেহনাজ গ্রুপের চেয়ারম্যান শেহনাজ হুসেন প্রমুখ বিশিষ্ট জনেরা। এছাড়া এর আগে এই সম্মাননা পেয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ভাদুতলা বিবেকানন্দ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ড.অমিতেশ চৌধুরী। সম্মাননা পেয়ে কেমন অনুভূতি হচ্ছে, জানতে চাইলে সুব্রতবাবু বলেন, ” সম্মাননা পেয়ে ভালো লাগছে।আরও অনেক দায়িত্ব বেড়ে গেল। পাশাপাশি এই সম্মাননা আমাকে আগামীদিনে আরো নতুন কিছু করার অনুপ্রেরণা জোগাবে।”