| |
|---|
ইলিয়াস মল্লিক: যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে সম্প্রতি নিউরোসার্জারি ও ফেসিয়াল প্লাস্টিক সার্জারির যৌথ প্রয়াসে স্পাইনাল টিউমার চোখের কোটরের পথ দিয়ে অপসারণ করা হয়েছে—পৃথিবীতে এই প্রথম। এই যুগান্তকারী অস্ত্রোপচারের প্রধান চিকিৎসক ছিলেন ডা. মোহামেদ এ.এম. লাবিব ও ভারতীয়-আমেরিকান প্লাস্টিক সার্জন ডা. কাল্পেশ ভাখারিয়া।
রোগী কার্লা ফ্লোরেস (২০) কিশোরী বয়স থেকেই মাইগ্রেন ও বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। শুরুতে কোনো চিকিৎসক পরিষ্কারভাবে সমস্যা ধরতে না পারলেও, এক পর্যায়ে CT ও MRI স্ক্যানে ধরা পড়ে কার্লার ঘাড়ে (স্পাইনাল কর্ড) এবং ব্রেনস্টেমে দুটি বিরল ধরনের কর্ডোমা টিউমার। ব্রেনস্টেমের টিউমার দু’বার অপারেশন করে সরানো হলেও, স্পাইনাল কর্ডে (C1, C2 লেভেলে) থাকা টিউমার অপসারণ ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, মুখ বা ঘাড় দিয়ে এখানে পৌঁছানো কঠিন এবং প্যারালাইসিস, স্নায়ুবিক ক্ষতি, রক্তক্ষরণ এমনকি মৃত্যু প্রবল ঝুঁকি ছিল।
স্বাভাবিক অপারেশন পদ্ধতি ছেড়ে ডা. লাবিব অভিনব এক পদ্ধতি বেছে নেন: চোখের কোটরের ভেতর দিয়ে টিউমারের কাছে পৌঁছানো! এই পদ্ধতির থিওরি পরীক্ষার জন্য ক্যাডাভার নিয়ে দুবছর ধরে তিনি গবেষণা করেছিলেন এবং এটির নাম দেন “তৃতীয় নাসারন্ধ্র” (“Third Nostril”)। শল্যচিকিৎসার আগে দলবল নিয়ে বার বার রিহার্সাল, প্ল্যানিং ও সিমুলেশন করেন।অনন্য ও ঝুঁকিপূর্ণ এই অপারেশন শুরু হয় চোখের নীচের পাতল ঝিল্লি দিয়ে, মুখের ভিতরেও কাট দিয়ে। এরপর চোখের কোটরের নীচের অংশ ও গণ্ডাস্থি একটু সরিয়ে, সাইনাসের পথে সোজা ঘাড়ের মেরুদণ্ডে পৌঁছানো হয়। চোখের পেশীগুলো অক্ষত রাখা হয়। সেখান থেকে ডা. লাবিব বিশেষ যন্ত্র দিয়ে ধীরে ধীরে টিউমার অপসারণ করেন। অপারেশনের সময় রোগীর মুখ, ঘাড় বা চোখের বাইরে কোনো কাটাছেঁড়ার দাগ থাকে না—এটি একটি মিনিমালি ইনভেসিভ, এন্ডোস্কোপিক অস্ত্রোপচার, যার স্থায়ী দাগও থাকবে না। পুরো অপারেশন শেষ করতে ১৯ ঘণ্টা সময় লেগেছে দলকে।
অপারেশন শেষে প্লাস্টিক সার্জন ডা. কাল্পেশ ভাখারিয়া চোখের নিচের অংশ পুনর্নির্মাণ করেন টাইটানিয়াম প্লেট দিয়ে, গণ্ডস্থি পুনর্নির্মাণ হয় রোগীর নিজের হিপের হাড় দিয়ে। পরবর্তীতে কার্লাকে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি ও প্রোটন রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়েছে এবং গ্রীবার মেরুদণ্ড দুটি (C1, C2) ফিউশনের মাধ্যমে স্থির রাখা হয়েছে।
এই অস্ত্রোপচারের আগে চোখের কোটর (Transorbital Approach) দিয়ে ব্রেন বা সাইনাসে টিউমার অপসারণ করা হয়েছে, কিন্তু মেরুদণ্ডের টিউমার অপসারণ একেবারে অভিনব। এ ধরনের দুর্বিনীত রোগে অস্ত্রোপচার ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুঝুঁকি প্রকট। তাই এই সাফল্য নিঃসন্দেহে মেডিকেল সায়েন্সে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। এখানে শুধু একজন বিচক্ষণ সার্জনের কৃতিত্ব নয়, নিউরোসার্জারি, ফেসিয়াল প্লাস্টিক সার্জারি, ENT, রেডিওওনকোলজি, রিহ্যাবিলিটেশন—সকলের অভূতপূর্ব সমন্বয়ের ফল। এই সাফল্য ভবিষ্যতে আরো দুর্বিনীত স্পাইনাল টিউমারের চিকিৎসায় নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।
ভারতীয় মহাকাশচারী শুভাংশু শুক্লার সফল প্রত্যাবর্তনের পর, ডা. কাল্পেশ ভাখারিয়ার এই যুগান্তকারী সাফল্য আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। এইসব অর্জন শুধু ভারতবাসীর মনোবল বৃদ্ধি করেনি, বরং গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে। ভারতীয়রা বিশ্বমঞ্চে একের পর এক সাফল্য অর্জন করছে—এটি ভারতের চিরন্তন মেধা, একাগ্রতা ও পরিশ্রমের ফল। জ্ঞানবিজ্ঞানে ভারতের এই উত্থান অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে আগামী প্রজন্মও অনুপ্রাণিত হয়। আজকের এই সাফল্য শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানকেই নয়, ভারতের সকল প্রান্তের নবীন ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক ও স্বপ্নদ্রষ্টাদেরও আলোকিত করুক
কার্লা ফ্লোরেসের একটি টিউমার ছিল যা তার মেরুদণ্ডের কর্ডকে শ্বাসরোধ করে ফেলছিল। এটি চোখের নড়াচড়ার জন্য একটি স্নায়ুর উপরও চাপ দেয়, যার ফলে তার বাম চোখ ভেতরের দিকে ঘুরে যায়। (ছবি:মারভিন জোসেফ/দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট)


