বীরভূমের বিস্মৃতপ্রায় এক মহান শিক্ষাব্রতী মুকুন্দবিহারী সাহা

সৈয়দ মইনুদ্দীন হোসেন,নতুন গতি, বীরভূম:-

    জন্মভূমি বীরভূম না হলেও কর্মভূমি বীরভূম। বীরভূম তাঁর যৌবনের কর্মক্ষেত্র বার্ধক্যের বারানসি। জন্মসাল সঠিক জানা না গেলেও রামপুরহাট হাই স্কুলের রেকর্ড অনুযায়ী ১৮৯০ সালকে তাঁর জন্মসাল বলে ধরে নেওয়া হয়।তবে কেউ কেউ ১৮৮৮ সালের কথাও বলেন।যেমন আমরা বীরভূম গর্ব জে এল ব্যানার্জীর সঠিক জন্মতারিখটি আজও জানতে পারলাম না। অবিভক্ত বাংলার এক অখ্যাত গ্রাম ঢাকা থেকে প্রায় ৩৫ মাইল দূরে সিঙগেয়ারে তাঁর জন্ম।অধুনা বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ শহরের স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করার পর সম্পন্ন ব্যবসায়ী বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে ব্যবসা করুক। উচ্চশিক্ষার পরিবর্তে পাটের ব্যবসার দিকে কোনো ঝোঁক ছিল না ছেলের।চলে এলেন কলকাতায়। কলকাতার ঝামাপুকুরের একটা মেসে থেকে কলকাতায় পড়াশোনা। প্রথমে স্কটিশচার্চ কলেজ পরে ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সসম্মানে এম এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, আাচার্য সুনীতি কুমারের সহপাঠী সেই ছেলেটির নামই মুকুন্দবিহারী সাহা।
    বাল্যকালে দাদু তাঁকে রসিকতা করে খাঁটি ঢাকাইয়া ভাষায় বলেছিলেন “তামাক সাজ্তে পারস্ না,ইংরেজি পড়বা কেমনে”? পরবর্তীতে সময়ে যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন তাঁরা জানেন অম্বুরি তামাকের গড়গড়া আর ইংরেজি দুটোই ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। যাক সে কথা, আসলে রামপুরহাট পরবর্তী তুম্বুনির জীবনে তিনি ছিলেন ছাত্রদের সকলের দাদু।তুম্বুনি গ্রাম সংলগ্ন সকল আদিবাসীদের কাছে তিনি ছিলেন দাদু।তিনি আজ নেই তবু আমাদের কাছেও তিনি দাদূ।তাই একটু রসিকতা দিয়েই শুরু করলাম দাদুর কথা।
    মুকুন্দবিহারী সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ভাবধারায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।মিশনের সাধুদের কাছে যেতে লাগলেন। সান্নিধ্যলাভ করলেন ঠাকুরের সর্বক্ষণের সঙ্গী এবং রামকৃষ্ণ কথামৃত লেখক শ্রী মহেন্দ্র গুপ্তের।যিনি শ্রীম নামে সর্বাধিক পরিচিত। পরে শ্রীশ্রী সারদা মায়ের কাছে দীক্ষা নিলেন।মা তাঁকে শিক্ষা দিলেন ঠাকুরের সেই অমৃতবাণী ” কর্মই ধর্ম”। জনগণের সেবার মধ্যেই নিহিত আছে ধর্মের ভাব,যে ধর্মে কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই,সংকীর্ণতা নেই,জাতপাতের বালাই নেই।তিনি তাঁর আদর্শ পুরুষ ‘শ্রীম’ এর কাছে থেকে প্রেরণা পেলেন।শিক্ষাবিস্তার কে দেশসেবার আদর্শ হিসাবে গ্রহন করলেন।

    রামপুরহাটে মুকুন্দবিহারী সাহা-
    রামপুরহাট শহরে একটি উচ্চবিদ্যালয় ছিল দীর্ঘদিন ধরেই।সেই ১৮৮৬ থেকেই।স্কুলটি ছিল বাজারের পাশেই ব্রাহ্মসমাজের আশ্রম সংলগ্ন বিশাল চত্বরে। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন সেকালের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব বৈষ্ণব সাহিত্যের সুপণ্ডিত নীলরতন মুখোপাধ্যায়। যেকোন কারণে হোক এই বিশিষ্ট মানুষটির সাথে বীরভূম গর্ব দেশনায়ক বাগ্মী অধ্যাপক জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবল বিরোধ দেখা দেয়।বিরোধ এমন জায়গায় পৌঁছায় যে জে. এল. বন্দ্যোপাধ্যায় একটি নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বসেন।সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে কলকাতা থেকে নিয়ে আসেন যুবক মুকুন্দবিহারীকে।দুটো স্কুল একসঙ্গে চলতে থাকে।পরবর্তীতে মিস্টার ব্যানার্জ্জীর সাথে নীলরতন মুখোপাধ্যায়ের বিরোধের নিষ্পত্তি হয়ে যায়।দুটো স্কুলের পরিচালকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তের ফলে স্কুল দুটি আবার একসাথে মিলিত হয়ে যায়। তখনকার এস ডি ও সাহেবও স্কুল দুটিকে একসাথে মিলিয়ে দেওয়ার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে নীলরতন মুখোপাধ্যায় অবসর নেওয়ায় হেডমাস্টার হয়েছেন প্রফুল্ল কুমার চট্টোপাধ্যায়। সম্মিলিত স্কুুলের প্রধান শিক্ষক তিনিই থাকলেন আর মুকুন্দ বাবু হলেন রেকটর।
    শিক্ষক মুকুন্দ বাবু ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। ছাত্রদের ভালবেসেছেন, স্নেহ করেছেন আবার শাস্তি দিতেও পিছপা হননি কোনদিন। তিনি ছিলেন বিদগ্ধ পণ্ডিত। ইংরেজির মতো দুরূহ বিষয় ছাত্রদের কাছে প্রাঞ্জলভাবে বোধগম্য করে তুলতেন।তিনি ছিলেন কর্মবীর। ১৯২০ সালে খানবাহাদুর মদেশ্বর হোসেনের দেওয়া জায়গায় যখন বর্তমান হাইস্কুলের বিল্ডিং হচ্ছিল তখন তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করেছেন।মানুষের কাছে স্কুল বিল্ডিংয়ের জন্য সাহায্য চেয়েছেন।ছাত্রদের তিনি নিজের সন্তান মনে করতেন।নিজের বেতনের সঞ্চিত অর্থ গরিব ছাত্রদের পরীক্ষার ফি দিতে সাহায্য করতেন।বই কিনে দিতেন।মানুষের দুঃখকষ্ট তিনি সইতে পারতেন না।প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় তিনি ছাত্র শিক্ষকদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ত্রাণকার্যে। মানুষ তাঁকে দেখেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা থেকে পালিয়ে আসা অসহায় মানুষের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে। হাইস্কুলের মাঠে তাদের তাবুগুলোতে আহার আর বস্ত্র নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। মেদিনীপুরের বানভাসি মানুষের সাহায্যে গোটা রামপুরহাট এলাকা ঘুরে বেড়াতেন অর্থ সাহায্যের জন্য। নিজের পদাধিকার ভুলে গিয়ে গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষাপাত্র হাতে দান চাইতেন।অসহায় মানুষের পাশে থাকার জন্য সরকার তাঁকে রায়সাহেব উপাধি দেন।তাঁর কর্মজীবনের প্রায় শেষদিকে রামপুরহাটের জন্য এক মহান কাজ তিনি করে গেছেন। ১৯৫০ সালে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি রামপুরহাটে গড়ে তোলেন রামপুরহাট কলেজ। না একথা আমি বলবো না যে তিনি একাই কলেজের প্রতিষ্ঠা করেন।সেসময় রামপুরহাটের অনেক সহৃদয় মানুষের চেষ্টায় গড়ে উঠেছিল এই কলেজ। তবে উদ্যোগের পুরোভাগে মুকুন্দবিহারী সাহা।তিনি রামপুরহাট হাই স্কুলের মতোই রামপুরহাট কলেজের জন্য দানশীল জমিদার খানবাহাদুরের কাছে জমি চান।মুকুন্দবিহারীর কথা ঠেলতে পারেননি তিনি।বর্তমান হাইস্কুলের মতো কলেজের জমিও তাঁরই দান।তখনকার রামপুরহাটের বনেদি পরিবারের সকলেই কলেজ গড়তে অর্থ দান করেন।অনেকেই জানেন না রামপুরহাট কলেজের প্রথম সেক্রেটারী ছিলেন শিক্ষাবিদ মুকুন্দবিহারী সাহা।

    দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর রামপুরহাট হাইস্কুলে শিক্ষকতা করে ১৯৫১ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন রেকটর সাহেব।ভাবলেন বাকী জীবনটা আদিবাসী সাঁওতালদের সঙ্গে থেকে তাদের সেবায় নিয়োজিত হবেন। সবুজ পাহাড় সংলগ্ন সুঁড়িচুয়া এ্যারোড্রামের পাশাপাশি তুম্বুনি নামক গ্রামে প্রায় পনেরো বিঘা জমি একটি খড়ের ঘর ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার সেন্ডা গ্রামের শ্যামাপদ মুখার্জি মহাশয়ের। তিনি সহজেই সেই জমি রেকটর সাহেবকে দান করে দিলেন।সেই জনশুন্য রুক্ষ ছায়াহীন প্রান্তরে মুকুন্দবিহারী গড়ে তুললেন তাঁর আশ্রম।আদিবাসী গ্রামবাসীদের সেবায় মনপ্রাণ নিবেদন করলেন। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের আদর্শে প্রভাবিত, প্রিয় মানুষ মহেন্দ্র গুপ্ত(শ্রীম) আর সারদা মায়ের মন্ত্রশিষ্য বুঝেছিলেন দীনদরিদ্র বঞ্চিত অবহেলিত মানুষের সেবাই ঈশ্বর আরাধনার একমাত্র পথ।এই গভীর উপলব্ধি নিয়েই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন তাঁর স্বপ্নের শিক্ষাপীঠ।শ্যামবাবুর দানকে অমর করে রাখতে জায়গাটার নাম দিলেন শ্যামপাহাড়ী।শুরু হল কর্মবীরের নতুন কর্মক্ষেত্র,স্থাপিত হল শ্যামপাহাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়,দাতব্য চিকিৎসার ব্যবস্থা ও ঔষধ বিতরণকেন্দ্র।ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন আবাসিক উচ্চবিদ্যালয়,বেসিক স্কুল,বেসিক ট্রেনিং কলেজ, ছাত্রদের হোস্টেল, বিরাট ডাইনিং হল আর উপাসনাগৃহ।তাঁর স্বপ্নের রামকৃষ্ণ শিক্ষাপীঠে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের ছাত্ররা পড়তে এল।পরবর্তী সময়ে তাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুনামের সাথে বিভিন্ন পেশায় যোগদান করলেন।দাদুর স্বপ্ন সার্থক হল।শহর থেকে দূরে এক নিভৃত জায়গায় দাদু শুধুমাত্র তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্বারা আর ত্যাগের বিনিময়ে যে পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন তা ভোলার নয়।তাঁর স্বপ্নের শিক্ষাপীঠে এসেছেন বেলুড় মঠের সাধু মহারাজ স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দজী,রাজ্যপাল হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমম্ত বসু তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়,ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো স্বনামধন্য মনীষীরা। দেশবরেণ্য আই সি এস বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্রী ব্রজকান্ত গুহ ছিলেন শিক্ষাপীঠের সভাপতি। এখানে এসে আশ্রমে কতদিন থেকে গিয়েছেন তিনি।হাইকোর্টের জজের আসনও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি।দাদুর স্বপ্নকে সফল করতে তাঁর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।অবদান ছিল দাদুর প্রাক্তন সব গুণী ছাত্রদের।

    মহান ঈশ্বর যেন অসংখ্য মানুষের সেবা করবার জন্যই তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। শিক্ষাপীঠের প্রয়াত শিক্ষক কবি সত্যসাধন চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিতে লিখেছিলেন – “কবিবন্দিত সেইসব পাগল এবং প্রেমিকদেরই একজন তিনি যাঁরা যুগে যুগে -কালে কালে তাঁদের আলোকোজ্জ্বল জীবন থেকে এক অপার্থিব দ্যুতির দ্বারা এই পৃথিবীকে আলোকিত করে গেছেন।”
    এই অসামান্য মানুষটির প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই আমরা দেখতে পাব তিনি পৃথিবী নামক এই গ্রহে এসেছিলেন এক অলৌকিক আলোয় তাঁর প্রাণের প্রদীপটি জ্বালিয়ে নিয়ে।
    দুর্ভাগ্য আমাদের এই মানুষটিকে বীরভূম মনে রাখেনি।বীরভূমের কবিসাহিত্যিক বা গবেষকরা তাঁকে নিয়ে এক কলম লেখেননি।অবাক হতে যখন দেখি মাননীয় জেলাশাসকের সম্পাদনায় বীরভূমি বীরভূম নামক গ্রন্থেও তাঁর সম্পর্কে দু’লাইন লেখা নেই।দোষ বীরভূমের নয়,যে শহরে এবং শহরাঞ্চলে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর জনসেবায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি সেই রামপুরহাটও তাঁকে মনে রাখেনি।বড় অবহেলিত তিনি।রামপুরহাট শহরে আজ কত সভা কত সেমিনার। তাঁকে নিয়ে একটা সেমিনারও হতে দেখিনি।
    চিরকুমার মুকুন্দবিহারী সাহা সংসারী হননি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ছিল তাঁর সংসার।অগণিত ছাত্রছাত্রী তাঁর সন্তান। ১৯৬২ সালের ১৪ই মার্চ এই কর্মবীরের জীবনাবসান হয়।রামপুরহাটের একজন এস ডি ও সাহেব তাঁর জন্য বলেছিলেন ” A saint without the yellow garb”। সত্যি তিনি ছিলেন প্রকৃত সন্যাসী।আজ মাস্টারমশাই নেই কিন্তু তাঁর অমর কীর্তি রামকৃষ্ণ শিক্ষাপীঠের প্রতিটি ধূলিকণায় বিরাজ করছে।কেউ মনে না রাখলেও,স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে ছেড়ে গেলেও তাঁর সৃষ্টি তাঁকে অমর করে রাখবে চিরকাল…..