প্রত্যাশা মত‌ই ঝড় উঠল প্রচারে, উত্তর থেকে দক্ষিণ: ভাষন দ্বৈরথে মমতা-মোদী

জাকির হোসেন সেখ, ৩ এপ্রিল, নতুন গতি: আজ বুধবার। বাংলায় এক‌ই সাথে শুরু হল ক্ষমতাসীন দুই দলের দুই প্রধান সেনাপতির নির্বাচনী প্রচার। একজন কেন্দ্রের বিজেপি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জোড়া সভার প্রথমটা ছিল শিলিগুড়ির নৌকাঘাট মোড়ের কাছে কাওয়াখালির মাঠে। দ্বিতীয় সভা ব্রিগেডে। অন্যদিকে
কোচবিহারের দিনহাটায় ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভা। এছাড়া দুপুর ১২ টা থেকে অভিষেক ব্যানার্জির সভাও ছিল কোচবিহার জেলার শীতলকূচি বিধানসভা এলাকার গোঁসাইয়ের হাট হাইস্কুল মাঠে। মোদী মমতার ভাষন দ্বৈরথে কার্যতঃ যা আড়ালে চলে গেল আজ।

    তৃণমূল এবং বিজেপি দুটো দলই যে উত্তরবঙ্গ দিয়েই তাদের হেভিওয়েট প্রচার শুরু করল, তার কারণ অবশ্য ৭ দফার ভোটে আগামী ১১ এপ্রিল থেকে যে প্রথম দফার ভোট শুরু হচ্ছে, তাতে উত্তর বঙ্গের কোচবিহার আর আলিপুরদুয়ার আসন দুটো দিয়েই বাংলায় প্রথম ভোট পর্ব শুরু হচ্ছে।

    নরেন্দ্র মোদীর শিলিগুড়ির সভার থেকে অবশ্য আগ্রহ বেশি ছিল সকলের ব্রিগেডের সভাকে ঘিরে। যদিও ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে নতুন কিছু না বলে শিলিগুড়ির সভায় রাখা বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করেছেন মোদী।
    শিলিগুড়িতে জনসভা সেরে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ ব্রিগেডের জনসভায় ভাষণ দেয়ার কথা থাকলেও বিকেল ৪ টের পরেই তিনি ব্রিগেডে পৌঁছান।

    এমনিতেই রাজ্য বিজেপির প্রথম ব্রিগেড সভা ছিল এটা। এর আগে বার বার ব্রিগেডে সভা করার কথা বলেও কোনও না কোনও কারণে তা বানচাল করতে হয়েছে। সেই হিসাবে ব্রিগেডের এই সভা লোকটানার ব্যাপারে বড্ড বেশি ঝুঁকিপূর্ণও ছিল। গতকাল বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সেকথা স্বীকারও করেছেন। নতুন গতির পক্ষ থেকে ব্রিগেড সভার আগাম হালহকিকত জানতে
    গিয়ে গতকাল চমকিত‌ও হতে হয়েছে এই প্রতিনিধিকে। কারণ, গোটা ‌ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের চারভাগের তিনভাগ ফাঁকা রেখে মাত্র একভাগ নিয়ে দর্শকদের জন্য জার্মান হ্যাঙার তৈরি করা হয়েছিল। ড্রোন ক্যামেরায় ছবি তুললে বিশাল মাঠের মাঝখানে ছোট ছোট কয়েকটা দোচালা ঘর বলে মনে হবে। ব্রিগেডের বাকি বিশাল অংশ ফাঁকা পড়ে ছিল। অর্থাৎ ব্রিগেড ভরানো তো দুরের কথা, শুধুমাত্র ব্রিগেডের এক চতুর্থাংশে জার্মান হ্যাঙার পদ্ধতিতে শামিয়ানা টাঙানো ব্রিগেড ভরাতেও যত লোক আসার দরকার, তত লোক না এলেও সেটা ধরা যেতনা। সেই ব্রিগেড সমাবেশ থেকেই মোদী কি বলেন, তাই নিয়ে সাধারণ মানুষের থেকে সংবাদ মাধ্যমের আগ্রহই ছিল বেশি। বিকেল ৪টের পরে মোদী আসার সময় পর্যন্ত ২৫০০ মানুষের ততক্ষণে খিদের জ্বালায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে।

    নরেন্দ্র মোদীর শিলিগুড়ির সভাও যে খুব সুবিধের হয়েছে বলা যাবে না। সংবাদ মাধ্যমের যাই আগ্রহ থাকুক না কেন, সভায় মোদি পাহাড় নিয়ে কী বার্তা দেন, তা নিয়েই এলাকাবাসীর আগ্রহ থাকলেও নাগরিকত্ব আইনে গোর্খাদের কোনো অসুবিধা হবে না বলে আশ্বাস দেয়া ছাড়া তেমন কিছুই বলেননি মোদী। এছাড়াও সভায় আশানুরূপ ভীড় না হ‌ওয়ার কারণ ছিল, দার্জিলিঙে যে মোর্চার ওপর ভর করে বিজেপি গত দু’‌বার জিতেছিল, সেই মোর্চাই এবার দ্বিধাবিভক্ত। যদিও আশানুরূপ আক্রমণাত্মক বক্তব্যটা মোদী ঠিকই রেখেছেন।

    শিলিগুড়ির সভা শুরু হয়েছিল সকাল সাড়ে ১১টায়। সেখানে মোদির বেলা ১টা নাগাদ ভাষন দেয়ার কথা থাকলেও তিনি ১.৩৫ মিনিট নাগাদ বক্তব্য শুরু করেন। ভারতমাতা কি জয় স্লোগান দিয়ে বাংলায় সকলকে শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানিয়ে ভাষণ শুরু করেন। তারপর হিন্দিতে বলেন, ‘এই ভীড়‌ই বলে দিচ্ছে এবার দিদির নৌকা ডুবছেই। এই চৌকিদার বড় বড় টক্কর নিতে পারছে আপনাদের জন্যই। অন্য রাজ্যে যে গতিতে কাজ হয়েছে, সেই গতিতে এই রাজ্যে কাজ হয়নি।
    আসলে উন্নয়নের স্পিড ব্রেকার হচ্ছেন দিদি। গরিব শেষ হয়ে গেলেই রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে দিদির। দিদি আয়ূষ্মান ভারত করতে দিচ্ছেন না।’
    চিটফান্ড নিয়েও মমতাকে আক্রমণ করেন মোদী। বলেন, মন্ত্রী থেকে বিধায়ক, দিদির সব সঙ্গীসাথিরা গরীবের টাকা লুঠ করেছে।’
    সন্ত্রাসকে পিছনে ফেলে নির্ভয়ে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সব থেকে বড় কথা, নির্বাচন কমিশনের নিষেধ থাকা সত্বেও সেনাদের নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে ছাড়েননি। একসময় পুল‌ওয়ামা সহ এয়ারস্ট্রাইক ও পাকিস্তান প্রসঙ্গ তুলে ‘পাকিস্তানকে আঘাত করা হলে ব্যাথা লাগে দিদির’ বলেও তীব্র ব্যঙ্গ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সব মিলিয়ে ১.৩৫ মিনিট থেকে ২টো পাঁচ মিনিট পর্যন্ত আধঘন্টার‌ও বেশি সময় ধরে বক্তব্য রাখেন মোদী।

    অন্যদিকে বিকেল ৪টে নাগাদ কোচবিহারের দিনহাটায় মমতার সভা শুরুর আগেই ব্রিগেডে মোদীর ভাষণ শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করা হলেও একটা সময়ে এক‌ই সাথে চলতে থাকে বক্তব্য। ব্রিগেড থেকে মোদী আর দিনহাটা থেকে মমতা। তখন লাইভ সম্প্রচার করতে থাকা সংবাদ চ্যানেল গুলো এক‌ই সাথে দুজনকেই সাউন্ড মিউট করে করে দেখাতে থাকে।

    শিলিগুড়ির জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে ইস্যুগুলি তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছিলেন, দিনহাটা থেকে প্রত্যেকটিরই পালটা দেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী।মোদীর শিলিগুড়ির সভায় বলা ‘স্পিড ব্রেকারে’র বদলায় দিনহাটার সভা থেকে তাঁকে ‘এক্সপায়েরি বাবু’ বলে ভারত ছাড়া করার করার ডাক দিয়েছেন মমতা। কোচবিহারের দিনহাটায় নির্বাচনী জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে এক্সপায়েরি বাবু বলে কটাক্ষ করেছেন মমতাও। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন পাল্টা জবাব দিয়ে। আওয়াজ তুলেছেন দিল্লি বদলের। মানুষের কাছে আহ্বান জানালেন, এবার আপনাদের ভোট দিল্লিতে বদল আনবে, দেশকে বাঁচাবে।
    প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মিথ্যাবাদী আখ্যাও দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন, কথায় কথায় মিথ্যা বলেন মোদী। বাংলায় এসে গতবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন চা বাগান খুলে দেবেন, এবার আবার চা বাগানের জন্য ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন। কোন মুখে চা বাগানের শ্রমিকদের পাশে থাকার বার্তা দেন মোদী, প্রশ্ন তোলেন মমতা।
    মোদী সরকারকে টুকলির সরকার বলেও কটাক্ষ করেন তিনি। বলেন, নিজেরা কিছু সৃষ্টি করতে পারেন না, স্লোগান পর্যন্ত চুরি করেন। আর প্রকল্প তো চুরি করেনই। স্বচ্ছ ভারত থেকে শুরু করে আয়ুস্মান ভারত, সবই টুকলি। এই চৌকিদার টুকলি আর মিথ্যা ছাড়া কিছুই শেখেনি।

    মমতা বলেন, প্রতি মিটিংয়েই ওরা বলছে আমার আয়ুস্মান হল না। কেন তোমার প্রকল্পে ৪০ শতাংশ টাকা দেব। তোমার আগেই আমি নিজে করে দিয়েছি স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প। তুমি তো আমার প্রকল্প চুরি করেই ওই আয়ুস্মান করেছো। এখন শুধু বড় বড় কথা, মানুষকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। যোগ্য জবাব দেবে বাংলার মানুষ। তারপর মমতা বলেন, ‘কোনওদিন শুনেছেন হ্যাঙারে মিটিং হয়? ভুরি ভুরি টাকা খরচ করে হ্যাঙার তৈরি করা হয়েছে। তার ভিতরে মিটিং হচ্ছে। টাকার হাঙর যারা মিটিং করে হ্যাঙারে। নির্বাচনের পর ওই হ্যাঙারেই তাদের ঢুকে যেতে হবে বলে কটাক্ষ করেন মমতা। বাংলার সঙ্গে পাঙ্গা নিয়ে কোনও লাভ নেই। আগে দিল্লি সামলা, বাংলার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। সবাইকে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান মমতা। জোড়াফুলে ভোট দিয়ে বিজেপিকে ভারত ছাড়া করার ডাক দেন তিনি।
    মোদীকে বিতর্কে বসার আহ্বান‌ও জানান ফের। প্রয়োজনে একই মঞ্চে পাবলিক মিটিংয়েও তিনি বিতর্কে রাজি। সাহস থাকলে আমার প্রশ্নের মুখোমুখি হোন। আবারও বলছি, একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আপনি প্রশ্ন করবেন, আমি উত্তর দেব। তারপর আমি প্রশ্ন করব, আপনি উত্তর দেবেন। দেখতে চাই কত মিথ্যা বলতে পারেন আপনি। আমার কাছে সব কিছুর প্রমাণ আছে।