চুরাশি বছরেও নিজের হাতে গ্রামের বাড়ির দুর্গাপুজো করলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, অসুস্থ শরীর নিয়ে চণ্ডীপাঠও সারলেন

সানওয়ার খান, নতুন গতি: কথায় আছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব। শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই নয় বিশ্বের নানা প্রান্ত জুড়ে বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ দুর্গোৎসব তার প্রভাব বিস্তার করেছে। যে যেখানেই থাকুক উৎসবের এই কটা দিন সবাই একত্রিত হয়। যে যেকোন পেশায় থাকুক না কেন। সমাজের উঁচু-নিচু ,বর্ণ ,গোত্র গরিব, ধনী সকলে একসাথে একত্রিত ভাবে বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ তথা প্রাণের উৎসবে মেতে ওঠে। শহরের রাজপথ থেকে অলিগলি, শহর থেকে শহরতলী, গ্রাম এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেও একই সাথে অদ্ভুত এক কালের নিয়মে অদ্ভুত এবং এক অদ্ভুত রীতিতে দুর্গোৎসবের দিনগুলিতে শুরু হয় মাতৃবন্দনা শুরু হয় অঞ্জলি, একই সাথে বেজে ওঠে লক্ষ্য লক্ষ্য ঢাক কাশর। এ যেন এক অদ্ভুত শক্তির খেলা। শুধু দেশে নয় দেশের বাইরেও এই একই নিয়মে একই সঙ্গে শুরু হয় অঞ্জলি বেজে ওঠে ঢাক। সত্যিই হয়তো এই জন্যই বাঙালির দুর্গোৎসব শুধুমাত্র বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবই নয় এই উৎসব গোটা বিশ্বের অন্যতম এক প্রাণের উৎসব।

    আর এই প্রাণের উৎসবে বীরভূমের মিরাঠি গ্রামে নিজের জন্মভিটে তে উপস্থিত থেকে নিজ দায়ীত্বে পুজো সারলেন ভারতবর্ষের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, তিনি ভারতরত্নে সম্মানিত তিনি ভারতবর্ষের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্বের পদও সামলেছেন। তবে বীরভূমের মিরাঠি গ্রামে মুখার্জি বাড়ির দুর্গা পুজোতে সত্যিই এক অন্য রূপে ধরা দিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। পশ্চিম বাংলার বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম মিরাঠি। আমাদের গাড়ি প্রথমে শান্তিনিকেতনে পৌঁছালো। শান্তিনিকেতন থেকে আরো আঠেরো কিলোমিটারের ও একটু বেশি বীরভূমের মিরাঠি গ্রাম। একের পর এক ফাঁকা প্রান্তর, আশেপাশে বহুদূর পর্যন্ত খাঁ খাঁ করছে ফাঁকা মাঠ। কোথাও আবার বিঘার পর বিঘা জমিতে চাষ করা হয়েছে। ফাঁকা মাঠের আর সবুজ চাষ জমির বুক চিরে সোজা মেঠো রাস্তা ধরে অবশেষে পৌছালাম বীরভূমের মিরাঠি গ্রামে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যাযয়ের জন্ম ভিটেতে। মাটির দোতলা বাড়ি এটাই প্রণব বাবুর জন্মভিটে, এখানেই বহুকাল ধরে পুজো হয়ে আসছে। আর এই গ্রামের বাড়িতে প্রতিবছরই পুজোর সময় নিয়ম করে উপস্থিত থাকেন প্রণব বাবু। বাড়ির পুজোর স্থায়ী পুরোহিতের আসনে তিনি নিজেই বসেছিলেন। এই বয়সেও স্পষ্ট ভাষায় সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ মনে হবে তিনি পেশায় এক ব্রাহ্মণ। সমস্ত নিয়মকানুন মেনে তিনি পুজো সম্পন্ন করলেন। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে তিনি পূজোর সমস্ত তদারকি এমনভাবে করলেন দেখে মনে হচ্ছিল তিনি সত্যিই এই গ্রামের ছেলে।

    পুরানো সেই মাটির দোতলা বাড়ির পাশেই প্রণব বাবু থাকার জন্য একটি বিল্ডিং স্থাপন করা হয়েছে। সারাদিন পুজোর কাজ করার পর প্রণব বাবু ওই বাড়িতেই বিশ্রাম নিতে যান। পরের দিন নববীতে চন্ডী পাঠ করলেন তিনি। প্রণব বাবুর প্রকাশ্যে চণ্ডীপাঠ শুনবেন বলে দূরান্তের গ্রামের লোক ভিড় জমিয়েছিলেন তাঁর গ্রামের বাড়ির সামনে। তার শরীর খারাপ থাকায় অবশেষে তিনি অন্দরমহলে চণ্ডীপাঠ করলেন। নিরাপত্তার জন্য গোটা গ্রাম নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছিলো। সেইমতো সেভাবে কাউকেই তার সাথে খুব একটা দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না। কিন্তু অবশেষে একটি সূত্র মারফত দশ মিনিটের জন্য তার সাথে দেখা করার সুযোগ পেলাম। বিলম্ব না করে আমার দুই সঙ্গী আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুভাষ হালদার এবং বিশিষ্ট সমাজ সেবি ও গঙ্গাসাগর এর জে.সি মেমোরিয়াল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পরিচালক অতনু মণ্ডল দের নিয়ে অন্দরে ঢুকে পড়ি। কিছু বই এবং কিছু উপহার সামগ্রী তিনি আমাদের থেকে গ্রহণ করলেন, এবং আমাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করতে বললেন তার পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় কে। খাওয়া দাওয়া সেরে মন্দিরের সামনে অভিজিৎ বাবুর সাথে দীর্ঘ আলোচনা করলেন আমার প্রিয় সঙ্গি অতনু মণ্ডল।

    সত্যিই হয়তো নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না।তিনি যে ভারতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব নিজের হাতে সামলেছেন। ভারতবর্ষের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির ছোটবেলার বেড়ে ওঠার গ্রামটি আজও হৃদয়ের মধ্যে প্রণব বাবু-র হৃদয় এমন ভাবে গেঁথে রয়েছে সেটা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করা গেল। এটাই হয়তো বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব দূর্গোৎসবের তাৎপর্য এটাই হয়তো বাঙালির দুর্গোৎসব শ্রেষ্ঠ উৎসবে পরিণত হওয়ার কারণ গুলির মধ্যে অন্যতম।