|
---|
সরকারি চাকরির টোপ দিয়ে প্রতারণা, চক্রের ৮ পাণ্ডা গ্রেফতার
নতুন গতি প্রতিবেদক : নদীয়া জেলার নাকাশিপাড়ার মালুমগাছার যুবক আলমগির মণ্ডলের পরিচয় ছিল সেই জেলারই কালীগঞ্জ থানার দেবগ্রামের বাসিন্দা খোকন ঘোষের সঙ্গে। খোকনই তাঁকে বলে, কলকাতা হাইকোর্টে তার প্রচুর জানাশোনা আছে। সেখানে কয়েকটি ক্লার্কের পোস্ট এখন খালি। চাকরি হতে পারে। তবে টাকা লাগবে। এই উদ্দেশ্যে কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দেয়। আলমগির রাজি হয় টাকা দিতে। চাকরি পাইয়ে দেবে বলে আলমগিরের থেকে মোট ৮ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা নেয় প্রতারণা চক্রের লোকেরা। আলমগির জমি বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করেন। যাতে সন্দেহ না হয়, তার জন্য একটি নকল ইন্টারভিউয়েরও ব্যবস্থা করে চক্রীরা। সেখানে আলমগিরকে জাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারও দেওয়া হয়। আলমগিরের জন্য কলকাতা হাইকোর্টে একটি জাল অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারেরও ব্যবস্থা করে তারা।
আলমগিরকে বলা হয়, “করোনা” পরিস্থিতির জন্য এখন প্রতিদিন অফিসে যেতে হবে না। আগে থেকে তারিখ বলা হবে, শুধু সেই দিনগুলোয় গেলেই আপাতত চলবে। সেরকমই একটি দিন ছিল গত ৬ জুলাই। আলমগির হাইকোর্টে যান কাজে যোগ দিতে। আদালত ছিল প্রায় ফাঁকা। আদালতের করিডোরে তাঁকে এদিক-ওদিক ঘুরতে দেখে এক সরকারি আইনজীবীর সন্দেহ হয়। তিনি আলমগিরকে ডেকে, কোথায় থাকেন, কেন এসেছেন ইত্যাদি জানতে চান। ওই আইনজীবীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে আলমগির বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। আদালতের অন্যান্য লোকজনও ততক্ষণে এসে গিয়েছেন। তাঁদের চেষ্টায় হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় নকল রেজিস্টার-সহ প্রীতম হাতি নামে এক ব্যক্তি। এই প্রীতম হাতি-ই সেদিন নকল হাজিরা-খাতায় আলমগিরকে দিয়ে সই করিয়েছিল।
খবর যায় হেয়ার স্ট্রিট থানায়। আলমগির এবং প্রীতম হাতি, দু’জনকেই থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আলমগির মণ্ডলের অভিযোগের ভিত্তিতে রুজু হয় মামলা।
জেরা করা শুরু হয় প্রীতমকে। বাগুইআটি-কেষ্টপুরের কমলা পার্কের বাসিন্দা প্রীতমের কাছে যে নকল হাজিরা খাতা পাওয়া গিয়েছিল, তাতে আলমগির মণ্ডল ছাড়াও আরও নাম ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল,এই চক্রের শিকড় আরও গভীরে। তদন্তের ভার দেওয়া হয় লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের অ্যান্টি ফ্রড সেকশনের হাতে।
প্রীতমকে জেরা করে অ্যান্টি ফ্রড সেকশনের অফিসারেরা জানতে পারেন, এই চক্রের পাণ্ডারা বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে আছে। জেরায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কয়েকজনের উপর শুরু হয় নজরদারি। তার ভিত্তিতেই ১১ জুলাই আলিপুরের গোপাল নগরের রাস্তা থেকে গ্রেফতার করা হয় প্রদীপ রায়কে। প্রদীপের বাড়ি বেলেঘাটায়। ওই দিনই প্রদীপের কাছে থেকে জেরা করে পাওয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয় তার সঙ্গী প্রসেনজিৎ শাউকে। আলমগিরের অভিযোগ এবং প্রীতমকে জেরা করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরেক অভিযুক্ত খোকন ঘোষকে পাকড়াও করতে অ্যান্টি ফ্রড সেকশনের অফিসারদের একটা দল নদিয়া চলে গিয়েছিলেন। ১১ জুলাই, ওই একই দিনে নদিয়ার কালীগঞ্জের দেবগ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয় খোকন ঘোষকে।
খোকনের বিবৃতি থেকে পাওয়া যায় এই প্রতারণাচক্রের আরেক অভিযুক্তের হদিস। সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠেন অ্যান্টি ফ্রড সেকশনের অফিসাররা। ওই দিনই তাঁদের হাতে ধরা পড়ে ওই এলাকার স্থানীয় ব্যবসায়ী রতন সিংহ। ১৪ জুলাই, উল্টোডাঙ্গার একটি ঠিকানায় রেইড করে ধরা হয় সায়ন বসু নামে খোকনের আরেক সঙ্গীকে। সায়ন বসুর বাড়ি বর্ধমানে। তাকে জেরা করে পাওয়া যায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাজিতপুরের অনন্ত পালের নাম। নিউটাউনের ইউনিটেক বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে অনন্ত পালকে গ্রেফতার করা হয় ১৭ জুলাই। অনন্ত পাল জাল নথি তৈরিতে দক্ষ এবং চক্রের অন্যতম প্রধান পাণ্ডা। অনন্তকে যে এসব কাজে সাহায্য করত, সেই পার্থ ঘোষকে গ্রেফতার করা হয় বাগুইআটি থেকে। ধৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রচুর জাল নথিপত্র।
প্রীতম হাতি, প্রদীপ রায়, প্রসেনজিৎ সাউ, খোকন ঘোষ এবং রতন সিংহ এখন বিচারবিভাগীয় হেফাজতে। সায়ন বসু, অনন্ত পাল এবং পার্থ ঘোষ পুলিশ হেফাজতে। জেরা চলছে।
রইল অভিযুক্তদের ছবি। বাজেয়াপ্ত হওয়া জাল নথিপত্র, নকল রেজিস্টারের ছবিও।