করোনা কালের মধ্যেই দুয়ারে কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর

বাবলু হাসান লস্কর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা : প্রতিটি জাতির মানুষের মধ্যে বিশেষ দিনকে উপলক্ষ করে উৎসবের রেওয়াজ প্রাচীনকাল থেকেই। বিশ্ব মুসলিমের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ। শাওয়ালের চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ খুশির ঈদের আগমনী বার্তা । ঈদ ধনী-গরীব সকল মানুষের মিলন বার্তা বহন করে। রোজা ইসলামের আত্মশুব্ধি, সংযম, ক্ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাম্যবাদীতা, ক্ষমা, দানশীলতা, উদারতা ও মনুষ্যত্বের দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর আসে-ঈদ মানে আনন্দ,ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে স্বজন আর বন্ধুদের মিলনমেলা, হৈ-হুল্লোড়, এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানো। ঈদ মানে কোলাকুলি, করমর্দন। ঈদ মানে প্রতিবেশীদের নিয়ে খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা দেওয়া। নাড়ির টানে আত্মীয়সহ বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে যাওয়া,ভাই-বোনদের সঙ্গে একত্র হওয়া। নতুন জামাকাপড় পরা। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল,ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়া । ঈদগাহে যাওয়ার আগে ফিতরা আদায় করা । ঈদের দিনে বিশেষ আমল বেশি বেশি করে তাকবির বলা ” আল্লাহু আকবর,লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু,ওয়াআল্লাহু আকবর,আল্লাহ আকবর,ওয়া লিল্লাহিল হামর্দ । বিশেষ করে এই মুহূর্তে কর্নার বাড়বাড়ন্তের জন্য রাজ্য সরকারের নির্দেশিকায় ৫০ এর অধিক মানুষ একত্র না হওয়া সোশ্যাল ডিসটেন্স বজায় রেখে নামাজ পড়া, একে অপরের সঙ্গে এই মুহূর্তে কোলাকুলি না করা নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষা রাখার জন্য আমাদের কে এই মূহুর্তের নির্দেশিকা তথা শৃঙ্খলা মান্যতা দিতে হবে । কিন্তু এবার সেই অনাবিল আনন্দের আবহ নেই। খুশির জোয়ারও নেই। করোনা ভাইরাস-মহামারীর আকার ধারণ করার কারণে সারা বিশ্বের মতো ভারতবর্ষে থমকে গেছে স্বাভাবিক জীবন যাপন। এমনি পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর। দীর্ঘ এক মাস জুড়ে সিয়াম সাধনার মধ্যে কঠোর ইবাদতের পর বহুল প্রতীক্ষিত ঈদুল ফিতর দোরগোড়ায়।

    কিন্তু আলোয় ভাসার এই দিনকে ঘিরে রেখেছে মহামারীর বিষন্নতায় ভরা ভয়ংকর কালো এই করুণ করোনা কাল।চারিদিকে কান পাতলে শোনা যায় স্বজনহারার কান্না। বাতাসে ভেসে আসা অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ ও আগরবাতির গন্ধ। সারা পৃথিবী যখন মানুষের জন্য মৃত্যু অববাহিকা, সেই সময়েই এলো ঈদ। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। হাসি, আনন্দ আর উদযাপনের বার্তা নিয়ে আসে ঈদ। কিন্তু এবার? রোগশোক আর মৃত্যুর রঙে ধূসর এই পৃথিবীতে খুশির ঈদের যেন কোনো রং নেই। বর্তমানে সারাবিশ্বসহ আমাদের দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত কারণে মুসল্লিদের জীবন ঝুঁকি বিবেচনা করে এ বছর ঈদগাহ বা খোলা জায়গার পরিবর্তে ঈদের জামাত কাছাকাছি মসজিদে আদায় করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া শিশু, বয়োবৃদ্ধ, যে কোনো অসুস্থ ব্যক্তি এবং অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি ঈদের নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। পাশাপাশি সর্বসাধারণের সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনের নির্দেশনা অবশ্যই মান্যতা দিতে হবে ।

     

    ভারতবর্ষের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে ঈদ-অর্থনীতির আকার প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঈদ-অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির মূল কারণ জিডিপির হার বৃদ্ধি। এছাড়া মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও ঈদ-অর্থনীতির আকার বাড়ছে। মূলত ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা ঈদকে ঘিরে অর্থনীতিতে এক বিশাল মাত্রা যোগ করে। পাশাপাশি দরিদ্র শ্রেণিরাও এসময় তাদের স্বল্প সামর্থ্য থেকেই ঈদ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে। তাই এ দেশের অর্থনীতিতে একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে ঈদ উৎসব। রমজানের ঈদুল ফিতর ও কোরবানির ঈদুল আজহা ও সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেশের অর্থনীতিতে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়।

    উল্লেখ্য, করোনাকালে কিছু কিছু শব্দের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি নতুন করে পরিচিত হয়েছি। বিশেষ করে এই করোনাকালের লকডাউন, আইসোলেশন কিংবা কোয়ারেন্টাইন শব্দগুলো। তবে প্রতিটি শব্দেই মিশে রয়েছে সময়ের দীর্ঘশ্বাস। রয়েছে বেদনা, আতঙ্ক ও নিঃসঙ্গতা। কভিড-১৯ রোগের করোনাভাইরাসের ভয়ে যেন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সবকিছু। মনের কোণে সামান্য আনন্দটুকুও যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে। নিশ্চুপ নিঃশব্দ এক পৃথিবীর চেহারা যেন বিশ্ববাসী দেখতে পেল। থমকে গেছে জীবন-জীবিকা । হবেই বা না কেন যেখানে জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে পড়েছে। তবে মানুষ থেমে যেতে শেখেনি। তাই হয়তো করোনার ভয় আস্তে আস্তে মন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে। পৃথিবীকে ফিরিয়ে নিতে চাইছে স্বাভাবিক গতিতে। বহির্বিশ্বের মতো এ দৃশ্য আমাদের দেশেও বিরাজমান। উৎসবের জাতি হিসেবে বাঙালি জাতির পরিচয় নতুন নয়। তবে এই ২০২১ সালে আমাদের দেখতে হয়েছে উৎসবের ভিন্ন রূপ।

    করোনাকালে আমরা পার করেছি বাঙালির সবচেয়ে রঙিন উৎসব ১লা বৈশাখ। যেখানে ১ লা বৈশাখ আসার আগেই চারদিকে সাজ সাজ রব উঠে যায় সেখানে এবার দেখতে হলো পুরোই ভিন্ন রূপ। বাতিল হয়েছে বৈশাখ সংক্রান্ত যাবতীয় উৎসব। যার ফলে একদম ফ্যাকাশে হয়েছিল উৎসবের সব রং। কোথাও লাগেনি কোনো রঙের ছটা, বাজেনি কোনো গান। ব্যাপারটা এমন ছিল ঘরে বসেও মানুষ মনে হয় গান শুনতে আগ্রহী হয়নি। অজানা এক আতঙ্কে কাটিয়েছে দিন। যার ফলে কোন ফাঁক দিয়ে উৎসবের দিন চলে গেল সে হিসাব মনে হয় কেউ নিতে যায়নি। যে উৎসবে একজন আরেকজনের বাড়িতে যাওয়া, ভালো ভালো খাওয়ায় মেতে ওঠাই ছিল মূল চিত্র সেখানে এবার কেউ যায়নি কারও বাসায়। এমনও হয়েছে উৎসবের দিন অনেক বাড়িতে বাড়তি আয়োজনের দৃশ্যপট ছিল না। এমনকি হাঁটাচলা ওঠাবসা সবকিছুতেই ছিল সাবধানতা ও আতঙ্কের ছাপ। এমন দৃশ্যও দেখতে হবে ভাবেনি হয়তো কেউ। কিন্তু দেখতে হয়েছে।

    চিন্তার বিষয় হচ্ছে, দিন দিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও যেন ভীতি কমে গেছে মানুষের মন থেকে। আর তাই কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও মানুষ ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। গত কয়েকদিনে দেশের ফেরিঘাট আর মহাসড়কগুলোতে তাই দেখা গেছে ঈদে ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড়। কিন্তু দেশে ভারতীয় করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করায় এটা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।

    তাই এবারের ঈদ উৎসব ঘিরে থাকবে শঙ্কা আর মনের ভেতর এক ধরনের ভয়। বলা যায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার এক ঈদ আনন্দ। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দে মাতলেও হুট করেই বেরিয়ে আসবে না কেউ কোনো বন্ধুর বাসা থেকে। দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও সচেতনতার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠবে না। আর করোনা আক্রান্ত পরিবারে ঈদ বলে তো তেমন কিছুই থাকছে না। সেই সঙ্গে দেশের নানা অঞ্চলে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে বন্যা। কিছু কিছু এলাকা তো ঈদের দিনেও থাকবে পানির নিচে। জীবন চালানোই যেখানে দায় হয়ে পড়েছে সেখানে ঈদ আনন্দের কথা ভাবাই যায় না। তাই বলা যায় আনন্দ বেদনার মিশেল এই ঈদ।

    মানুষ তবুও স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। অন্ধকার দিন পেছনে ফেলে আলো আসবেই। আর সে আলোতেই সবাই গাইব জীবনের জয়গান। সেদিনই হয়তো আনন্দের পূর্ণতা ঘটবে। আপাতত সেদিনের অপেক্ষায়। আমরা চাই না শুধু এমন শুভেচ্ছা বিনিময়। এমন পরিস্থিতি এমন ঘরবন্দি ঈদ আর না আসুক মানব জীবনে।

    তাই এই করোনাকালের ঈদের প্রধান প্রার্থনা হচ্ছে, পৃথিবী করোনামুক্ত হোক। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী মানব জীবনের স্বাভাবিক গতিধারাকে পাল্টে দিয়েছে! সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, খুশি-আনন্দের পরিবর্তে বেঁচে থাকার সংগ্রামটাই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে।

    প্রতি বছর ঈদ এলে মুসলিম বিশ্ব মেতে ওঠে এক অনাবিল স্বর্গীয় আনন্দে আর বিলিয়ে দেয় পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা। প্রবাসীরাও প্রবাস জীবনের শত কষ্ট আর বঞ্চনার মাঝে ঈদের কয়েকটি দিনে অন্তত আনন্দ খুঁজে নিত প্রবাসে অবস্থানরত বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিচিতজনদের সঙ্গে। শেয়ার করত প্রবাস জীবনের সঞ্চিত ব্যথা, হালকা করত নিজেকে। কিন্তু মহামারী করোনাভাইরাসে বিশ্বজুড়ে যখন নীরব নিস্তব্ধ, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, দেশে দেশে কারফিউ আর লকডাউন দীর্ঘদিন ধরেই কর্মহীন হয়ে ঘরে বন্দি থাকা প্রবাসীদের এবারে ঈদ কীভাবে পালন করতে যাচ্ছে? তাদের ভাবনার কথাগুলো তুলে ধরার চেষ্টায় কথা বলেছি অনেক প্রবাসী ভারতীয়র সঙ্গে। অশ্রুসিক্ত নয়নে ভারাক্রান্ত মনে উদাস হয়ে নিজের রুমে বালিশের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে পরিবারের কথা চিন্তা করে প্রবাসের মাটিতে পড়ে আছে নিথর দেহখানি কিন্তু মনটা পড়ে রয়েছে দেশে থাকা প্রিয় মানুষগুলোর কাছে। এক ভাইরাসের কারণে মানবজাতির এমন কঠিন পরিস্থিতি দেখতে ভালো লাগছে না মোটেই।

    ঈদে মহাসমারোহে হইচই করে ছুটে বেড়ানো শিশুরাও আজ ঘরবন্দি। এর চেয়ে কষ্ট আর কী হয়? ঈদ আনন্দের সব অনুষঙ্গ ত্যাগ করেও যদি পৃথিবী থেকে করোনা বিদায় নিত, তাহলে শান্তি পেত মন। অথচ আমরা এখনো ধারণাও করতে পারছি না কবে এই করোনাভাইরাস বিদায় নেবে মানবজাতির কাছ থেকে।

    অবসাদ, মানসিক চাপ কাটিয়ে পৃথিবীর মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ পাক। শহর ফিরুক তার নিজস্ব ছন্দে। প্রকৃতি ফিরুক নিজের নিয়মে। আমরা সেই সুদিনের প্রত্যাশায় পথ চেয়ে রই। পৃথিবী থেকে করোনার বিদায়ে মানুষ ঈদের আনন্দের চেয়ে বেশি আনন্দিত হবে। এবং সেই আনন্দই পৃথিবীর বুকে আসুক দ্রুত, এটা এই করোনা দিনের ঈদ প্রত্যাশা।