আজও কাঁদে মাতৃভাষা

আজও কাঁদে মাতৃভাষা

    নাজমুল হালদার :
    ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর, ইউনেস্কোর এক সাধারণ সম্মেলনে, ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে #আন্তর্জাতিক_মাতৃভাষা_দিবস ঘোষণা করা হয়।

    ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার্থে যে আটজন বাঙালি তথা বাংলা ভাষামায়ের বীর সংগ্রামী শহিদ হয়েছিলেন, তাঁদেরকে আমরা এই একটা দিনই তো ঢাঁকঢোল পিটিয়ে, মহা-ধূমধামে– কবিতার আঙিনায়, ফেসবুকের ভাষাদরদি পোষ্টে, মোমবাতি জ্বালিয়ে, শহিদের বেদীতে পুষ্পদানে অথবা ম্যাসেনজার ও হোয়াটস্যাপে, ম্যাসেজ বিনিময়ের মাধ্যমে স্মরণ করি প্রতিবারে। বছরের এই একটা দিনই আমরা এক্কেবারে শুদ্ধ বাঙালি আর বাদবাকি দিনগুলোতে বিদেশী ভাষার এজেন্ট!

    এখন তো যে মানুষটা কথায় কথায় ইংরাজি ভাষা আওড়াতে জানে না, যার সন্তান ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে না, যার বাড়িতে সকালে ইংরাজি খবরের কাগজ আসে না, যাদের বাড়িতে ইংরাজি ও হিন্দি সিনেমা দেখা হয় না, যাদের সন্তানের নাম ইংরেজদের মত নয়, যার বাপ-মা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে না, তাদের চে’ মূর্খ যেন আর কেউ নেই সমাজে।

    সাধারণ সভা সমিতি তো ছেড়েই দিন। বাংলা কবিতার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রায়শ শুনি, “নেক্সট যিনি কবিতা পড়বেন…” অথবা “সাইলেন্স সাইলেন্স, সাইলেন্স প্লিজ !!”

    — তুমি কি নিয়ে পড়াশোনা করছ?
    — কাকু, আমি বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করছি।
    — ওওও… বাংলা নিয়ে…!!

    এমন তাচ্ছিল্যভর্তি চোখে তাকাবে যেন বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ছ মানে তুমি অপরাধী! যেন আর কোনো পথ ছিল না তাই আরকি!

    সবচে’ চিন্তার বিষয়– বিদেশী ভাষা, বিদেশী সাহিত্য, বিদেশী সংস্কৃতি, বিদেশী পোশাক, বিদেশী সমস্তকিছুই সুনিপুণভাবে ধ্বংস করছে আমাদের বাংলার সংস্কৃতিকে আর আমরা মাথা ঝাঁকিয়ে অথবা ঝুঁকিয়ে সেটাকে সমর্থন জানাচ্ছি।

    আমরা বাঙালিরাই প্রিয় খেলোয়াড়/অভিনেতা/অভিনেত্রী/গায়ক/গায়িকার জন্মদিন অথবা মৃত্যুদিন কি দারুণ স্মরণে রাখি। একবার ফেসবুকের বাইরে বেরিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করুন যে আজকে কী দিবস অথবা বাংলা ভাষার জন্য প্রাণপাত করা আটজন শহিদের মধ্যে একজনের নাম বলতে বলুন… আমি হলফ করে বলতে পারি যে একশো জনের মধ্যে নিরানব্বই জনই, তো তো করতে করতে জানাবে, তারা জানে না যে আজকে কী দিবস এবং কেন…।

    গুড-মর্নিং অথবা গুড-আফটার-নুন তো এখন আমাদের বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোতেও বলতে হয়! কেন বাংলায় বলতে বিবেকে বাঁধে বোধহয়!

    “I love you” না বলে কখনো প্রিয় মানুষটাকে “ভালোবাসি” বলে দেখতে পারেন। বিশ্বাস করুন, অকৃত্রিম ভালোবাসার অনুভবে ভরে উঠবে হৃদয়।

    যা’হোক, বাদ দিন ও’সব কথা। বাঙালিরা এমনিতেই দেখনদারিতে ভীষণ সুখি ও খুশি। পূর্বপুরুষদের ক্ষয়প্রাপ্ত জুতোজোড়াতে পা গলিয়ে বুক বাজানো ছাড়া আর তেমন কোনো গতিও নেই বিলুপ্তপ্রায় বাঙালি জাতির।

    ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, ভাষামায়ের লেহাজ রক্ষার্থে যে আটজন ভাষা সংগ্রামী শহিদ হয়েছিলেন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ-

    শহিদ একঃ-

    নামঃ- আবুল বরকত।
    পেশাঃ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র।
    মাতাঃ- হাসিনা বিবি।
    পিতাঃ- মৌলানা শামসুজ্জোহা।
    জন্মস্থানঃ- মুর্শিদাবাদ (পশ্চিমবঙ্গ)

    শহিদ দুইঃ-

    নামঃ- আব্দুল জব্বার।
    পেশাঃ- সাধারণ কর্মজীবী।
    মাতাঃ- সফাতুন্নেসা বিবি।
    পিতাঃ- হাসেন আলি।
    জন্মস্থানঃ- ময়মনসিংহ (বাংলাদেশ)

    শহিদ তিনঃ-

    নামঃ- রফিকউদ্দিন আহমেদ।
    পেশাঃ- মানিকগঞ্জ জেলার দেবেন্দ্রনাথ কলেজের বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র।
    মাতাঃ- রাফিজা খানম।
    পিতাঃ- আব্দুল লতিফ।
    জন্মস্থানঃ- মানিকগঞ্জ (বাংলাদেশ)

    শহিদ চারঃ-

    নামঃ- আব্দুস সালাম।
    পেশাঃ- ডাইরেক্টর অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অফিসে রেকর্ড কিপার।
    জন্মস্থানঃ- লক্ষণপুর (বাংলাদেশ)

    শহিদ পাঁচঃ-

    নামঃ- শফিউর রহমান।
    পেশাঃ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র (প্রাইভেট) এবং ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী।
    মাতাঃ- কানেতাতুন্নেসা বিবি।
    পিতাঃ- মাহবুবুর রহমান।
    জন্মস্থানঃ- কোন্নগর (পশ্চিমবঙ্গ)

    শহিদ ছয়ঃ-

    নামঃ- আব্দুল আওয়াল।
    পেশাঃ- রিক্সাচালক।
    পিতাঃ- মোহাম্মদ আব্দুল হাশেম।
    জন্মস্থানঃ- ঢাকা (বাংলাদেশ)

    শহিদ সাতঃ-

    নামঃ- মোহম্মদ অহিউল্লাহ্।
    পেশাঃ- শিশু শ্রমিক।
    পিতাঃ- হাবিবুর রহমান।
    জন্মস্থানঃ- নবাবপুর (বাংলাদেশ)

    শহিদ আটঃ-

    অষ্টমজনের কোনো পরিচয় জানা যায়নি। ১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি যে শোক মিছিল বেরিয়েছিল, তা ছত্রভঙ্গ করতে সশস্ত্র বাহিনী যে ট্রাক চালিয়েছিল তাতেই মৃত্যু হয়েছিল ওঁর।

    বিঃদ্রঃ- আরও বহুবীর সংগ্রামী শহিদ হয়েছিলেন সে’দিনের নৃশংস গুলিবর্ষণে তবে বেশিরভাগজনের লাশের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।