বিস্তারিত জেনে নিন কেনো “অসমে চলছে উচ্ছেদ অভিযান

নতুন গতি, ওয়েব ডেস্ক : অসমে বাংলায় কথা বলেন এমন মানুষের সংখ্যা ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী প্রায় ২৯ শতাংশ। দরং জেলার সিপাঝারে যাঁদের বিরুদ্ধে দখল করে বসবাসের অভিযোগ উঠেছে, যাঁদের কপালে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর সিলমোহর, তাঁরা এই শতাংশের মধ্যে পড়বেন কি না জানা নেই। দখলদারদের সেনসাস-ভুক্ত হওয়ার কোনও অধিকার নেই। তবে, তাতে এই মানুষগুলির এখন কিছুই যায়-আসে না। মাথা গোঁজার ঠাঁইটা তাঁদের এখুনি প্রয়োজন। আপনি বাঁচলে, ভাষার নাম। অনেকেই বলছেন, চল্লিশ বছরের বেশি এঁরা এখানে বাস করছেন, অন্তত এমনই দাবি, তা হলে কেন ও কীভাবে অনুপ্রবেশকারীর তকমা? তা ছাড়া, বাংলাদেশি নাকি বাংলাভাষী, সমস্যাটা কোথায়– প্রশ্ন তাঁদের। তাঁরা এনআরসি-র প্রসঙ্গ তুলছেন। মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায় প্রায় ১৪ লক্ষ বাঙালি ছিলেন (এর মধ্যে হিন্দুই ১০ থেকে ১২ লক্ষ। এবং এই তালিকায় হিন্দুর এই বিশাল সংখ্যা বিজেপিকে চাপেও ফেলেছিল। নির্বাচনী জয় সেই চাপ থেকে তাদের অবশ্য ঝাড়া হাত-পা করেছে।) আমরা এ সবের সত্যাসত্য স্পষ্ট জানি না। তবে, বাংলাভাষী ‘দখলদার’ উচ্ছেদে বিতর্কের এই ঝড় বইবার যথেষ্ট কারণ অসমের সাম্প্রতিক ইতিহাসেই মজুত রয়েছে। সত্তরের দশকে এই পড়শি রাজ্যে ‘বঙাল খেদা’-র হিংসা, রক্তপাতের কাহিনি সেটা। তবে আমরা সেই কাহিনিতে যাব না এ লেখায়, উচ্ছেদ এলাকাতে ঘুরব।

     

    অসমের দরং জেলার ঢোলপুর সিপাঝারের ১০ হাজার বিঘা জমি। বসবাস যাঁরা করেন, সরকারের দাবি, তাঁরা দখলদার। মানে বেআইনি ভাবে জোরজবরদস্তি বাস করেছেন। এঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন, মুসলিম ধর্মাবলম্বী। এঁদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীও বলা হচ্ছে। গত সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার এখানে সরকারি উচ্ছেদ অভিযান হয়েছে। উচ্ছেদ করা হয়েছে ১,২০০-১,৩০০টি পরিবারকে। বৃহস্পতিবারের উচ্ছেদে রণক্ষেত্র, নিহত হয়েছেন দুই আন্দোলনকারী, পুলিশও নাকি আহত। ঘটনা তিল তিল করে তাল হয়েছে। জুন থেকে এই নব চেহারাটিতে আসতে শুরু করেছে। হিমন্ত বিশ্বশর্মা সেখানে এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন জুনের ৭ তারিখ। এখানকার শিবমন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন।

     

    পর পর কয়েকটি টুইটে কী বলেছিলেন তিনি? ‘আজ আমি গিয়েছিলাম দরংয়ের সিপাঝারের নদী তীরবর্তী দখল হয়ে যাওয়া এলাকা পরিদর্শনে। এই এলাকাটি ঢোলপুর শিবমন্দিরের কাছে। বেআইনি দখল হয় শিবমন্দিরেরও ১২০ বিঘা জমিও। অসম পুলিশ এই এলাকা মুক্ত করেছে। অসমের যেখানে এমন দখলদারি হবে, তা মুক্ত করা হবে। দখলদারের হাত থেকে আমাদের ভূমি এবং অসমিয়া অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে এ কাজ করা হবে। শিবমন্দির কমিটি এবং স্থানীয়দের আমি আশ্বস্ত করছি, এখানে মনিকুত (প্রার্থনাগৃহ) নির্মাণ করা হবে, (মন্দিরের) এলাকা ঘিরে দেওয়া হবে দেওয়াল দিয়ে, গেস্টহাউসও হবে।’ অনেকেই বলছেন, টুইটে ওই যে অসমিয়া অস্তিত্ব রক্ষার কথা বললেন মুখ্যমন্ত্রী, তা-ই অন্যরকম ইঙ্গিত বয়ে আনছে। এই সমস্যায় অসমিয়া-হাওয়া দেওয়ার কি দরকার ছিল হিমন্ত বিশ্বশর্মার? বেআইনি দখলদারদের উচ্ছেদের সঙ্গে অসমিয়া জাত্যাভিমানের কি সম্পর্ক?

     

    এর পর, জুলাইয়ের ১৬ তারিখ অসমের রাজ্য বাজেটে এখানকার জমিতে কৃষিপ্রকল্পে ৯.৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। সেই প্রকল্পে ভূমিপুত্রদের কাজে লাগানোর কথাও বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসন এই জমিটিকে ‘কমিউনিটি এগ্রিকালচারাল ল্যান্ড’ হসেবে ঘোষণা করেছে। এখানে বলে নিতে হবে, জুনে এই জমিতে এক দফা উচ্ছেদ অভিযান চলে। মন্দিরের কাছে বাস করা সাতটি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয় তখন। মুখ্যমন্ত্রীর টুইটে সেই প্রসঙ্গই তুলেছিলেন।

     

    বাঙালি মুসলিম, যাঁরা মূলত দিনমজুরির কাজ করে থাকেন। বেআইনি ভাবে জমি দখল করে বাস করছেন, এমন অভিযোগ অসম সরকারের হলেও, এখানকার বাসিন্দারা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, তাঁরা অন্তত ৪০ বছর ধরে এখানে থাকছেন। বীরপাড়া, গোয়ালপাড়ার মতো এলাকাগুলি নদীভাঙনে জলগর্ভে চলে যাওয়ায় তাঁরা এখানে চলে আসতে বাধ্য হন। বাসিন্দাদের অনেকেরই দাবি, সেই সময় তাঁরা এখানকার স্থানীয়দের থেকে জমি কিনেছিলেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লেনদেন হয়েছিল কোনও নথিপত্র ছাড়া। এর ফলে, এখন তাঁদের দখলদার বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

    মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা শনিবার এ নিয়ে এক দফা তাঁদের কাঠগড়ায় তোলেন। বলেন, বন্যা ও ভূমিক্ষয়– ‘এ দুটিকে মন্ত্রের মতো করে বলা হচ্ছে। কিন্তু অসম সরকার পিছু হটবে না। আমাদের (অসমিয়া) সংখ্যা প্রতিদিন কমে যাচ্ছে।’ উচ্ছেদ হওয়া ভূমিহীনদের ২ একর জমি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই প্রসঙ্গে, আর একটা তথ্য দিতে হবে: সিপাঝার, মঙ্গলদৈ লোকসভার এই এলাকাটি থেকে ১৯৭৯-৮৫ সালে অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের বেআইনি অনুপ্রবেশকারী-বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল।

     

    গুরুখুটির বিস্তীর্ণ অঞ্চল, ঢোলপুরের একাংশ, বহু দিন ধরেই সংঘাতের ক্ষেত্র। ভূমিজ ও ‘অনুপ্রবেশকারী’– বার বার দু’পক্ষের মধ্যে অশান্তি হয়েছে। প্রবজন বিদ্রোহী মঞ্চ বা পিভিএম এবং সংগ্রামী সতীর্থ সম্মেলনের মতো সংগঠন গড়েছে ভূমিজরা। তাদের দাবি, এই জমি দখলমুক্ত করতে হবে। ২০১৫ সালে অসমিয়া বাসিন্দারা অসম জমিরক্ষা আইন ২০১০-এ এই দাবিতে মামলা করেন মঙ্গলদৈ আদালতে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন গোদুগ্ধ উৎপাদক সংগঠন মঙ্গলদৈ গোয়ালা সংস্থা। এই সংগঠনের সভাপতি কোবাড আলি ছিলেন সামনে। ২০১৩ সালের একটি আরটিআই থেকে জানা গিয়েছে, এখানে ৭৭ হাজার বিঘা সরকারি জমি দখল হয়ে রয়েছে বহু বছর ধরে। জমি ফেরানো হবে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বিজেপির। ভোট জয়ের পর সেই পথে নেমেছে তারা। ২০ সেপ্টেম্বর একটি বিবৃতিতে প্রবজন বিদ্রোহী মঞ্চের আহ্ববায়ক উপমন্যু হাজারিকা এমনও বলেন, আগে পাঁচটি উচ্ছেদ অভিযান হয়েছে। কিন্তু সরকারি কৃষি প্রকল্পের জন্য ভূমিজদের জমিই অধিগ্রহণ করা হয়েছে। দখলদারদের ছোঁয়া হয়নি। ফলে অসমিয়া সেন্টিমেন্টের তাগিদে কিছু একটা করতেই হত শর্মা-সরকারকে, তা-ই হচ্ছ, বলছেন অনেকেই।

     

    গত মাসে ঢোলপুর ৩-এর ২০০টি পরিবার উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অসম হাইকোর্টে গিয়েছে। আর, সরকার হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে, সরকারি জমি দখল করে বাস করছেন এই সব মানুষ, জমি ফেরাতেই উচ্ছেদ। আবেদনকারীদের উত্তর দাখিল করার আগেই গত বৃহস্পতিবার উচ্ছেদ অভিযান। আন্দোলনকারীরা বলছেন, আদালতে ফয়সলা হওয়ার আগে, কেন পদক্ষেপ?

     

    গত সোমবার ঢোলপুর-১ ও ঢোলপুর-৩-এর বাসিন্দা ৮০০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। কোনও বাধা আসেনি তাতে। যদিও নির্দিষ্ট পুনর্বাসন প্রকল্প কেন নেই, সেই প্রশ্ন আরও ঘনিয়ে ওঠে। এর পর বৃহস্পতিবার অল অসম মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের তরফে পুনর্বাসনের দাবিতে বিক্ষোভ দেখানো হতে থাকে। এখানে বসবাসকারী পরিবারগুলির সঙ্গে প্রশাসনের আলোচনা চলে, একটি চুক্তিও হয় তাতে। বিক্ষোভকারীদের দাবি, সরকারের তরফে বলা হয়েছিল, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকবে। কিন্তু সেটা হয়নি বলেই অশান্তির সূচনা। আবার পুলিশের বক্তব্য, চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও হঠাৎ করে পুলিশের উপর হামলা চালায় কয়েকজন বিক্ষোভকারী। যাদের হাতে ছিল লাঠি, রড, ধারাল অস্ত্র। পাথর ছোড়া হতে থাকে। দরংয়ের এসপি সুশান্ত বিশ্বশর্মা বলছেন, আত্মরক্ষার স্বার্থে পুলিশ যা করার করেছে। শনিবার, মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত এই ঘটনার পিছনে পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া বা পিএফআইয়ের রয়েছে বলেও দাবি করেন। পিএফআই-কে একটি চরমপন্থী সংগঠন হিসেবে মনে করে সরকার। যদিও পিএফআইয়ের দাবি, তারা মানবাধিকারের দাবিদাওয়া নিয়ে লড়াই করে। উচ্ছেদ অভিযানে পুলিশ ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষে ১২ বছরের একটি কিশোর সহ এলাকার দু’জনের মৃত্যু হয়। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আহত এক ব্যক্তির উপর ক্যামেরা ঝোলানো একজন লাফালাফি করছে। জেলা প্রশাসনের ভাড়া করা ওই ক্যামেরাম্যান, নাম বিজয় বনিয়া, তাকে ঘটনার পর দিনই, মানে গত শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়। সে এখন গুয়াহাটি জেলে।

     

    সোমবার গ্রেফতার করা হয়েছে আসমত আলি আহমেদ (৩৭), চাঁদ মামুদ (৪৭) নামে দু’জন স্থানীয়কে। দরংয়ের পুলিশ সুপার সুশান্ত বিশ্বশর্মা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, তদন্তে জানা স্পষ্ট এরা উস্কানি দিয়েছিল। এই দু’জনের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা, ষড়যন্ত্র সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। সুশান্ত বিশ্বশর্মা মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তের ভাই। তাঁকে সাসপেন্ড করা হোক, দাবি তুলেছেন বিরোধীরা। জেলাশাসককেও সাসপেন্ডের দাবি উঠেছে। তবে, ইতিমধ্যেই বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত।

    প্রশ্ন অনেক। ১০ হাজার বিঘায় যদি বেআইনি দখলদারি হয়ে থাকে, তা মুক্ত করতে সুচারু পরিকল্পনার প্রয়োজন, তা কি নিয়েছিল সরকার? অনুপ্রবেশকারী বলে কিংবা ভোটের প্রতিশ্রুতির তাগিদে কিংবা জাত্যাভিমানের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে এমনটা করা যায় কি? উত্তরটা হল– এ সব করলে বিপরীতই হয়, হিতের কোনও প্রশ্ন ওঠে না।