|
---|
মোহাম্মদ রিপন – ভারতের জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী সম্পর্কে আলাদা করে বলার বিশেষ কিছু নেই। অহিংসার পূজারী এই মানুষটি সারাজীবন নিজ দেশের হয়ে, দশের হয়ে সংগ্রাম করে গিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতার এতবছর পরও মহাত্মা গান্ধীর জীবন এবং তার আদর্শ আজও এই বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তরে এক সর্বজনগ্রাহ্য দর্শন। আজও সন্ত্রাসের কলুষ বাতাবরণ যখনই বিশ্বের কোথাও মাথাচাড়া দেয়, তখনই মনে পড়ে গান্ধীজির মনুষ্যত্ববাদ। অনেকেই এটিকে গান্ধীবাদ বলে থাকেন।
মানুষের মনে পড়ে যায়, এই অকারণ হিংসা আর হানাহানির মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় না মানব জাতির শান্তি-সৌহার্দ্য। হিংসা হানাহানিতে বাড়তে থাকে মানুষে মানুষে বৈষম্য। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নিত্য নতুন সমস্যা। আর সে কারণেই মানব জাতির সংকটময় মুহূর্তগুলোতে এই মানুষটির অবিচল আত্নবিশ্বাস আমাদের অন্তরে জোগায় সাহসের দৃঢ়তা। দেখায় সেই পথ, যে পথে আছে সম্মান, আছে সত্য আর বিশ্বাসের উজ্জ্বল আলোকময় পুরস্কার। সবচেয়ে বড় কথা, সত্যের পথেই রয়েছে প্রকৃত আনন্দ। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে তিনি বাপু নামেই আখ্যায়িত হয়েছেন। এই ‘বাপু’ শব্দটির অর্থ পিতা। সেই অর্থে পুরো জাতি তাকেই পিতার সম্মান দিয়েছে। আজ ভারতবাসীর জাতির জনক গান্ধীর ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী। দিনটি ভারতবাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। যদি মহাত্মা’ শব্দটিকে যদি ভাঙা যায়, তবে তার অর্থ হয় ‘মহান আত্না যার’। বিশ্বে এই নামে যে মানুষটির পরিচয়, তিনি হলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনি ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর ভারতের গুজরাটের পোরবন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যখন জন্মেছিলেন তখন সারা ভারতবর্ষজুড়ে ব্রিটিশ সরকারের গুন্ডারাজ। তখন সমগ্র ভারতবর্ষ পার করছিল এক ক্লান্তিকাল। পরাধীন দেশ, পরাধীন জাতি, অন্য কোনো রকম চিন্তার অবকাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না ভারতবর্ষে। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বার বার কেঁপে উঠছিল ভারতের গলি পথ থেকে শুরু করে রাজপথ। তার দীর্ঘ আন্দোলনে সব সময় সাহস যুগিয়েছেন তার সহধর্মিণী কস্তুরবা গান্ধী। সাংসারিক জীবনে তিনি ছিলেন খুব অমায়িক। তিনি ছিলেন ৪ সন্তানের পিতা। সন্তানদের নাম হল- হরিলাল, মনিলাল, রামদাস ও দেবদাস।
১৮৯১ সালে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি সম্পন্ন করে দেশে ফিরেন মহাত্মা গান্ধী। ১৮৯৩ সালে এক বছরের চুক্তিতে ব্রিটিশ উপনিবেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ওকালতি করতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বুঝলেন চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে ব্রিটিশ শাসকরা। শুধু গায়ের রং কালো বলে ভারতীয়রা চরম লাঞ্ছনার ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল সেখানে। ভারতবর্ষের শাসন ব্যবস্থার প্রতিচিত্র দক্ষিণ আফ্রিকায়ও খুঁজে পান তিনি। ২১ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় থেকে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান তিনি। শেষ পর্যন্ত ১৯১৫ সালে ফিরে আসেন দেশের মাটিতে। পরের ১৫ বছর সত্য আর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় শুরু হয় তার জীবনের আরও একটি সংগ্রামময় অধ্যায়। এই ১৫ বছরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন ছোটখাটো চেহারার স্বল্পভাষী মানুষটি। তার নেতৃত্বে অথবা তারই দিক-নির্দেশনায় একের পর এক আন্দোলন দেখেছে ভারতবাসী। সত্যের প্রতি আগ্রহ থেকেই তার ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন আসমুদ্র হিমাচলের মানুষকে এক অবস্থানে নিয়ে আসে। নিয়ে আসে সবাইকে একই গাছের তলায়। ধীরে ধীরে সবার কাছে তিনিই হয়ে হয়ে ওঠেন ‘বাপু’ বা ‘বাপুজি’। পালন করতে চেয়েছে তারই নির্দেশ। আদর্শ নেতা হিসেবে সব কিছুই অনুকরণ করতে চেয়েছে তার অনুসারীরা।
অনুকরণ করেছে তার সরল সাদাসিধে জীবনযাপন। তিনি নিজের রান্না নিজেই করতেন। নিজেই চালাতেন চরকা। সেই চরকার সুতো কেটে তা দিয়েই তৈরি করতেন খদ্দরের পোশাক। তার খদ্দরের পোশাক পরা শীর্ণ খর্ব অথচ আত্নবিশ্বাসে গরিমাময় গান্ধীজির মূর্তি ক্রমশ প্রতিবিম্বিত হয়েছে প্রত্যেক অনুসারীর মনে-প্রাণে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় তার আন্দোলনের ২১ বছর এবং ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সংস্পর্শে বার বার তাকে জেলে বন্দী করেছে ব্রিটিশ প্রশাসন। জীবনের বিভিন্ন সময়ের জেলখাটার হিসাব কষলে দেখা যায় ৭ বছর তাকে কাটাতে হয়েছে কারাগারের অন্তরালে। কিন্তু ন্যায় ও সত্যের জন্য জেল খাটাকে কোন রকম নিচু চোখে দেখতেন না তিনি।
গান্ধীজির যুক্তি ছিল,’আমি নিজে যদি জানি আমি যে কাজ করছি তা সঠিক, তার সঙ্গে রয়েছে আমার নিজের আত্নার সমর্থন, তবে এই কারাবন্দী হওয়া আমার পক্ষে সম্মানের। ‘ অহিংসা, সত্য আর সমানাধিকার-ব্রিটিশ সিংহাসনকে পর্যদস্তু করতে গান্ধীর এই আন্দোলনের পথ যে কতদূর সঠিক ছিল তা ক্রমশ বুঝেছে ভারতবর্ষ।
স্বাধীনতার উজ্জ্বল পথে তার দর্শন যে কতখানি গভীরে প্রোথিত ছিল তার সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে টুকরো হয়ে স্বাধীনতা পেয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। এর পরের বছর ১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারি দেশ ভাগের করুণ পরিণতিতে গভীর ব্যথিত হন গান্ধীজি। শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দাঙ্গার এই পৈশাচিকতা, বর্বরতা থামাতে ৭৮ বছর বয়সে অনশনে বসেন তিনি। টানা পাঁচ দিন অনশনের পর দেশের নেতাদের অনুরোধে খাবার গ্রহণ করেন তিনি। এর কিছুদিন পর ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম গডসের গুলিতে নিহত হন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। এভাবেই ইতিহাসের একটি পর্বে সমাপ্ত হয়। আসুন জেনে নেই গান্ধীজীর কয়েকটি অজানা ঘটনা।
১. মৃত্যুর পর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য পাঁচবার মনোনীত হন মহাত্মা গান্ধী। ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯ এবং ১৯৪৭-এর প্রথম দিনটি ১৯৪৮ সালে। কিন্তু মরণোত্তর নোবেল দেওয়া হয় না বলে গান্ধীজী নোবেল পুরস্কার পাননি। নোবেল কমিটি এর জন্য বহুবার দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
২. ৪টি মহাদেশের ১২টি দেশের গণ-আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
৩. যে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করে দেশকে স্বাধীনতা এনে দেন গান্ধী, সেই ব্রিটেন মহাত্মার জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে ১৯৬৯ সালে তাঁর নামে ডাকটিকিট চালু করে।
৪. জানা গিয়েছিল, মহাত্মা প্রতিদিন ১৮ কিলোমিটার পথ হাঁটতেন। সেই হিসাবে পৃথিবী পরিক্রমায় বের হলে তিনি দুইবার পৃথিবী চষে ফেলতে পারতেন।
৫. একসময় সেনাদলে নাম লিখিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তবে যুদ্ধের বীভৎসতা দেখে তিনি এর ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে অহিংসার প্রতি আরো বেশি করে আকৃষ্ট হন।
৬. স্বাধীনতা পাওয়ার পরে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রথম বক্তৃতার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না গান্ধী। ধর্মীয় সংহতি বজায় রাখতে কলকাতায় ছিলেন তিনি।
৭. গান্ধীর ব্যবহৃত বহু সামগ্রী, এমনকি যে বস্ত্র পরিহিত অবস্থায় তিনি খুন হন, সেটিও মাদুরাইয়ের গান্ধী মিউজিয়ামে সংরক্ষিত করে রাখা রয়েছে।
৮. মহাত্মা গান্ধীর ইংরেজি উচ্চারণের মধ্যে আইরিশ প্রভাব ছিল। কারণ তাঁর প্রথম শিক্ষক ছিলেন একজন আইরিশ।
৯. লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন মহাত্মা। এরপর অ্যাটর্নি হন। তবে প্রথমবার আদালতে বক্তব্য রাখতে উঠে নার্ভাস হয়ে পড়েন গান্ধী। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে পড়েন ও মামলা হেরে যান।
১০. মহাত্মা গান্ধীর ভক্ত ছিলেন মার্কিন টেক জায়ান্ট অ্যাপলের স্রষ্টা স্টিভ জবস। তাঁর দেখাদেখি জবসও গোলাকার ফ্রেমের চশমা পরতেন। পরে সেটাই হয়ে উঠেছিল জবসের স্টাইল স্টেটমেন্ট।
১১. একজোড়া বাঁধানো দাঁত ছিল গান্ধীর। প্রয়োজনের সময় ছাড়া সেটিকে কাপড়ে মুড়ে কাছে রাখতেন তিনি।
১২. মহাত্মা গান্ধীর নামে ছোট রাস্তাগুলি বাদে মোট ৫৩টি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক রয়েছে। এ ছাড়া দেশের বাইরে মহাত্মার নামে মোট ৪৮টি রাস্তা রয়েছে।
১৩. দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকাকালীন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ফুটবলের প্রসারে ব্রতী হন গান্ধী। তিনি ডারবান, প্রিটোরিয়া ও জোহানেসবার্গে ফুটবল ক্লাব খুলতে উদ্যোগী হন। তিনটিরই নাম ছিল, প্যাসিভ রেজিস্টার্স সকার ক্লাব।
১৪. গান্ধীজী কখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাননি। তবে সেখানেও তাঁর ভক্ত কম নেই। তাঁর অন্যতম বড় অনুরাগী ছিলেন হেনরি ফোর্ড। এক সাংবাদিকের হাত দিয়ে তাঁকে একটি সুতা কাটার চরকা উপহার দেন গান্ধী।
১৫/গান্ধীর সম্মানে ৫৩ টি বড় রাস্তা আছে । শুধু তাই নয়, টাইম ম্যাগাজিনের ম্যান অফ দ্য ইয়ার 1930 সালে তিনি মনোনীত হন।