|
---|
আজিজুর রহমান,গলসি : প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী নদী গাঙ্গুর। মধ্যযুগের মনসামঙ্গল কাব্যধারা ও প্রাচীন মনসামঙ্গল কাব্যে বেহুলার নামের সাথে জড়িয়ে আছে গাঙ্গুর নদীর নাম। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক কাল প্রযন্ত বাংলা সাহিত্যে, গানে, নাটকে ও চলচিত্রের বারবার এসেছে এই গাঙ্গুর নদীর নাম। গাঙ্গুর নদী পূর্ব বর্ধমান জেলার গলসি অঞ্চলের একটি ছোট নদী বলে বেশ পরিচিত ছিল। বর্তমানে যার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব না পাওয়া গেলেও গলসীর বেশকিছু জায়গায় এই নদীর অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান রয়েছে। মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দরের জীবন কাহিনীতেও এই নদীর গুরুত্ব লক্ষ্য করা যায়। কথিত আছে, লখিন্দরকে বাসরঘরে সর্পদংশনের পর কলার ভেলা করে এই নদীতেই ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই গাঙ্গুর নদীর ইতিহাস যুগ যুগ ধরে এক অমূল্য স্মৃতি বহন করে আসছে। ফলে প্রাচীন কাল থেকেই গলসির নাম ঐতিহ্যের মুকুটে মূল্যবান পালকের ভূমিকা পালন করে চলেছে গাঙ্গুর নদী। এই নদীর সাথে গলসির বহু পৌরাণিক তথ্য ও ইতিহাস জড়িত রয়েছে।
স্থানীয় বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, পূর্ব বর্ধমানের গলসির কসবা এলাকায় গাঙ্গুর নদীর উৎপত্তিস্থল ছিল। কেউ কেউ এই নদীর উৎপত্তি স্থল পানাগড় বলে থাকেন। তবে পানগড়ের দক্ষিণ পূর্ব কোনে গলসি ১ নং ব্লকে অবস্থিত কসবা গ্রামটি। বর্তমান দামোদর নদের বাম পাশ অর্থাৎ উত্তর দিকে প্রবাহিত হত গাঙ্গুর। এই নদীকে ঘিরেও বসতি গড়ে উঠেছিল। তাছাড়াও বণিক চাঁদ সওদাগরের বসতবাড়িও এই নদীর তীরে অবস্থিত ছিল বলেই এখনও লোকমুখে প্রচারিত হয়। দামোদর ও এই নদীপথ ধরে তিনি তার ব্যবসা শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন। মোগল আমলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে বণিক চাঁদ সওদাগরের চম্পাইনগরী পরগণার নাম উল্লেখ আছে। যেটি বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান জেলার গলসি ১ নং ব্লকের কসবা গ্রামে অবস্থিত। এখনও মানুষের মুখে মুখে রটে কসবা চম্পাইনগরী বা চম্পকনগর এর নাম।
১৯৪০ সালের পূর্ব পর্যন্ত দামোদরকে বাংলার দুঃখের নদ বলা হত। প্রায় প্রতি বছরই দামোদরের বন্যায় প্লাবিত হত রাজ্যের শস্যভান্ডার বর্ধমান জেলা। তখন থেকেই বর্ধমানের মূল শস্যভান্ডার বলা হত গলসিকে। ১৭০০ থেকে ১৮০০ শতাব্দী সময় দামোদরের বন্যার কারণে সাধারণ মানুষ সর্বশান্ত হয়ে যেত। সেই সময় গাঙ্গুর নদী গলসির মানুষের জন্য বিধাতার দেওয়া সেরা উপহার বলে বিবেচিত হত। ১৯১৩ সালের বন্যায় যখন গলসি ও বর্ধমানের বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল, তখন বাঁকা ও গাঙ্গুর নদী অতিরিক্ত বন্যার জল সরিয়ে দিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল। তবে বন্যার কারণে দামোদরের বালি ও পলি এসে গাঙ্গুর নদীর গতিপথে বাধা সৃষ্টি শুরু করে। অনেকের মতে, ১৯৪৩ সালের বন্যায় গাঙ্গুরের বহু জায়গা মজে সমতলভূমির আকার নেয়।
অন্যদিকে বর্ধমান জেলাকে বাঁচাতে ১৯৪০-এর দশকে দামোদরের মূল চ্যানেলের দুই পাশে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলস্বরূপ, গাঙ্গুর নদী দামোদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে গাঙ্গুর খণ্ডিত ও ক্ষয়প্রাপ্ত জলাভূমি ও জলাশয়ে রূপান্তরিত হয়। পাশাপাশি সড়ক ও রেলপথ নির্মাণের ফলে দামোদর ও তার শাখা নদী গাঙ্গুর পরিবহন ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তার অতীত গৌরব হারাতে শুরু করে। এরপর কালক্রমে গাঙ্গুর ভরাট হয়ে গেলে তা কৃষিজমিতে পরিণত হয়ে যায়।
তবুও, বর্তমানে গাঙ্গুরের অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান রয়েছে। গলসির, কসবা, আঁতুসী, মিঠাপুর, পলাশী সহ বেশকিছু গ্রামে তার কিছুটা অস্তিত্ব এখনও দেখা যায়। এলাকার কসবা ও আতুসী কিছু মাঠ আজও গাঙ্গুর মাঠ নামে পরিচিত। তবে গাঙ্গুর নদী এখন সাধারণ মানুষের সম্পত্তি বলেই পরিচিতি। একসময় এই নদীর জলপ্রবাহ অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। কৃষিনির্ভর মানুষ এখান থেকে সেচের জল পেত। বর্ষাকালে গাঙ্গুর পূর্ণ প্রবাহিত হলে এলাকাজুড়ে সেচের কাজ চলত। সেই সময় এই নদী ফসল উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করত। গাঙ্গুরের চারপাশে বনজঙ্গলে ঘেরা জমিগুলোতে ধান, আখ, পাট, আলু, তৈলবীজ ও সবজি চাষের জন্য এই নদীর জল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কালক্রমে গাঙ্গুর তার অস্তিত্ব হারালেও মানুষের মুখে মুখে আজও রটে এই নদীর নাম। যা প্রাচীন কাল থেকেই গলসির সুনাম বৃদ্ধি করেছে। মধ্যযুগের মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখিত, চাঁদ সওদাগর ও বেহুলা লখিন্দর কাহিনীর সত্যতাও বহন করে এই গাঙ্গুর নদী।