‘ইন্দু’- এ হার্ট টু.. এক অসাধারণ স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র

পারিজাত মোল্লা : লালমাটির সুন্দরী পুরুলিয়া। দু’পাশে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলে গ্যাছে রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে শিমূল-পলাশের গাছ। গাছ ভর্তি লাল ফুল লালমাটি রূপসী পুরুলিয়ার রূপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে- মনে হবে বিউটি টাচ, গালে যেন কেউ গোলাপি পাফ বুলিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে কবিতার আসর। সব মিলিয়ে এক মোহময়ী রোমান্টিক পরিবেশ। যে রোমান্টিক পরিবেশের টানে শহরের রোমান্টিক মানুষ বারবার ছুটে আসে এখানে। খুঁজে বেড়ায় রোমান্টিকতা। সেই খোঁজের মধ্যেই সৃষ্টি হয় নতুন কাব্য অথবা কবিতার। যেমন এবার সৃষ্টি হলো এক অসাধারণ স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ‘ইন্দু’- এ হার্ট টু….।

    সদ্য যৌবনে পা দেওয়া তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে দোলা দিয়ে বসন্তের রোমান্টিক পরিবেশে পুরুলিয়ার তেলিয়ামায় বসেছে কবিতার আসর। যেমন প্রতিবছর বসে। কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একগুচ্ছ বাচিক শিল্পী সেখানে হাজির। কলকাতার শিল্পীর দলে ছিলেন চলচ্চিত্র নির্দেশক তথা অভিনেতা রাজা মুন্সী। রোমান্টিক পরিবেশে মুহূর্তের মধ্যে তার শিল্পীসত্ত্বা সক্রিয় হয়ে ওঠে। হাতের কাছে ছিল রমা চোংদারের গল্প ও স্ক্রিপ্ট। তার উপর ভর করে এবং দর্শকের মনে ‘এরপর কী’ প্রশ্ন জাগিয়ে সৃষ্টি করে ফেললেন ৯১৫ সেকেন্ডের একটা শর্ট ফিল্ম- ‘ইন্দু’। দক্ষতা থাকলে একটা ছোট্ট কবিতা যে একটা শেষ না হওয়া বড় কাহিনী হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘ইন্দু’-তে।

    বসন্ত উৎসব তথা কবিতা উৎসবে যোগ দিতে পুরুলিয়ায় গ্যাছেন শহরের সুদর্শন যুবক। আদিবাসীদের দল পরব উৎসবে ধামসা মাদলের তালে তালে নৃত্যে মেতে উঠেছে একদল আদিবাসী যুবক-যুবতী। সেখানেই তার চোখ পড়ে সরল-সাদাসিধে সুন্দরী আদিবাসী তরুণীর দিকে। তার ডাকে সাড়া দেয় তরুণী। ‘নেশা লাগিলরে…’ শিমূল-পলাশের রোমান্টিক পরিবেশে রোমান্টিকতায় মেতে ওঠে দু’জনে। ‘তুমি কোন আকাশে থাক’ শহরের যুবক ফিরে যায় নিজের পরিচিত পরিবেশে। ভুলে যান ঐ তরুণীর গর্ভে রেখে আসা নিজের সৃষ্টির কথা। সমাজের হাজার অপমান সহ্য করেও সেই উপহার বড় হয়।

    সময় পেরিয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর আবার সেই যুবক, কালের নিয়মে আজ যে প্রৌঢ়, হাজির হন পুরুলিয়ায়। বিচারক হিসাবে যোগ দেন কবিতার আসরে। সেখানে এক তরুণীর অসাধারণ কবিতা পাঠ শুনে চমকে ওঠেন। তার মধ্যেই খোঁজার চেষ্টা করেন কাউকে – অবিকল সেই রূপ, সেই কণ্ঠ, নিখুঁত উচ্চারণ, বাচন ভঙ্গিমা। হয়তো একেই বলে আত্মজার প্রতি টান। একরাশ বিভ্রান্তি ও চিন্তা নিয়ে তিনি ফিরে আসেন উদ্যোক্তাদের দেওয়া তার অস্থায়ী বাসায়। মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন- কে এই তরুণী? তাকে দেখে মন কেন এত চঞ্চল? নতুন করে প্রেমে পড়ার মত বয়স তো আর তার নাই! তবে কি…. না, আর তিনি ভাবতে পারেননা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই চলে মনের অস্থিরতা। মাঝরাতে বেজে ওঠে মোবাইল। মোবাইলের পর্দায় ভেসে ওঠে এক অচেনা নাম্বার। চমক ভাঙার আগেই সুরেলা মহিলা কণ্ঠ। ‘মু রে মু, মনে পড়ে কবি বাবু’- কণ্ঠে আদিবাসী টান স্পষ্ট। চমকে ওঠেন কবি। এখান থেকেই কাহিনীর শুরু। শেষ ‘ডুবিয়া মরিলাম, মরিয়া ডুবিলাম’।

    শুরুতেই অসাধারণ কবিতা পরিবেশন করে অসাধারণ এক রোমান্টিক পরিবেশের সৃষ্টি করে দেন বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী সোহিনী ঘোষ। কাহিনী এগিয়ে চলে নিজের ছন্দে। সরকার দম্পতি জয়দীপ ও জয়িতার অসাধারণ অভিনয় এবং সঙ্গে জ্যোৎস্না মণ্ডলের আবেগী কণ্ঠে সঙ্গীত এক অন্য পরিবেশের সৃষ্টি করে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সমস্ত কিছু। তার মাঝেই দেবলীনা, সন্দীপ, অজিত, সুজিত ও গোপা- স্বল্প পরিসরে যে যেটুকু সুযোগ পেয়েছে তার সদ্ব্যবহার করেছে। ফলে কখনোই ‘বোরিং’ লাগেনা। সিনেমাটোগ্রাফি, এডিটিং ও নির্দেশনায় অসাধারণ রাজা মুন্সী। তাকে সহযোগিতা করেছেন শ্রীজিৎ। ব্যবস্থাপনায় ছিলেন গোপা চক্রবর্তী।

    স্বল্প দৈর্ঘ্যের ‘ইন্দু’ দেখে চলচ্চিত্র প্রেমী বার্ণপুরের মুনমুন মুখার্জ্জী বললেন – একটা সময় উত্তম-সুচিত্রা জুটির অনেক সিনেমা দেখেছি। পরে বিভিন্ন কারণে আর দ্যাখা হয়না। তাছাড়া প্যানপ্যানানি সেই একঘেয়ে কাহিনী বিরক্ত ধরিয়ে দেয়। তবে ‘ইন্দু’ দেখে ভাল লাগল। যারা অভিনয় ও কাহিনী দেখতে ভালবাসেন আশাকরি তাদের প্রত্যেকের ভাল লাগবে। ‘সরকার’ দম্পতির মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন ‘বসু’ দম্পতিকে।

    রাজা মুন্সী বললেন – গিয়েছিলাম পুরুলিয়ায়। রোমান্টিক পরিবেশ দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না, সেই ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’-র মত। হাতের কাছে নিজের পরিচিত বাচিক শিল্পীদের নিয়েই তৈরি করে ফেললাম সবার ভাললাগার ‘ইন্দু’। বিচারের দায়িত্ব দর্শকের উপর ছেড়ে দিলাম।