|
---|
নতুন গতি নিউজ ডেস্ক: সংশোধীয় গণতন্ত্রে জ্যোতি বসুর মত ব্যক্তিত্ব আর জন্ম নেবে কিনা জানি না। সকল মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলতেন তিনি। অনেকেই মনে করেন তিনি খুব কঠিন মানুষ। কিন্তু, তা নয় তিনি খুব সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। তাঁর মধ্যে একটা বিরাট মানবিকতা ছিল। প্রশাসনিক দক্ষ তো ছিলেনই। পাশাপাশি, সবচেয়ে বড় ছিল তাঁর উদার মানসিকতা। বিরোধীদের দেখেছি বিধানসভায় দাঁড়িয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কত কথা বলতে। আবার সেই বিরোধীরাই যখন কোনও ইস্যু নিয়ে তাঁর কাছে আসতেন, জ্যোতিবাবু সবটা মনযোগ দিয়ে শুনতেন। মন্ত্রী থেকে আমলা, কাউকে কখনও কোনও কটূ কথা বলেনি জ্যোতিবাবু। সকলেই তাঁকে অগাধ শ্রদ্ধা করতেন। সেই শ্রদ্ধা থেকেই তাঁর নির্দেশ মেনে চলতেন।
তিনি আমাদের মাথার উপর ছাতার মত ছিলেন। তিনিই আমাদের পথ দেখিয়েছেন। তাঁর পথ যদি স্মরণ করি, তাহলেই মানুষের সঙ্গে বামপন্থীদের সম্পর্ক উন্নত হতে পারে। তিনি যেভাবে প্রতিটি মানুষের অভাব-অভিযোগ সহজ ভাবে বুঝে যেতেন। আর কেউ কখনও পারবে না। উনি বলতেন, যখন যা পারবে বলে মনে করবে সেটাই মানুষকে প্রতিশ্রুতি দেবে। না পারলে দেবে না। উদাহরণ স্বরূপ একবার তিনি বলেছিলেন, ‘কোনও অঞ্চলে টিউবওয়েলের দরকার হল আর সেটা করে দিলে। অথচ তার হ্যান্ডেল খারাপ হয়ে পড়ে থাকল। এমন কাজ কখনও করবে না। রাস্তা বানানোর প্রতিশ্রুতি দিলে মনে রাখবে তার সঙ্গে আলোর ব্যবস্থা এবং বাস রুটের বন্দোবস্তের কথা আগে থেকে ভেবে রাখতে হবে। কারণ মানুষের একটা দাবি পূরণ করতে পারলে তোমার প্রতি জনগণের প্রত্যাশাই কিন্তু বেড়ে যায়। অতএব তা পূরণ করতে না পারবে প্রতিশ্রুতি দেবে না।’
জ্যোতিবাবুর মত বাস্তববাদী মানুষ দেখিনি কখনও। এত পড়াশোনা করেছেন। একটু সময় পেলেই বই পড়তেন। তাও কেউ কখনও তাঁর কথায় কোনও দাম্ভিকতা বুঝতে পারেনি। বক্তব্য রাখার সময় কখনও একটাও ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করতেন না। বুঁর্জোয়া, প্রোলেতারিয়েত শব্দগুলি কখনও ব্যবহার করতে দেখিনি তাঁকে। এমনকী, ধনী কথাটাও বলতেন না। উনি বক্তব্য রাখার সময় বলতেন গরিব আর বড়লোক। এতে মানুষের সঙ্গে সংযোগ আরও দৃঢ় হতে পেরেছে। তাঁর মতো এত সহজ-সরল করে মানুষের সঙ্গে কথা বলার মানুষের আজকে বড় অভাববোধ করি। আজকের নেতৃত্ব হয়ত অনেক সময় যে ভাষায় বক্তব্য রাখেন, তা দুর্বোধ্য হয়। ভাষা এত কঠিন হয় যে সাধারণ মানুষের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। জ্যোতিবাবুকে কখনও কোনও কঠিন ভাষা বলতে শুনিনি। তাঁর এই বিষয়টাই আমাদের কাছে শিক্ষণীয়। মানুষের ঠিক কি কি দরকার। সেটা উনি তাই খুব সহজেই বুঝে যেতেন। কোনওদিন কৃত্রিমভাবে কথা বলেন নি। আমরা কাদের সঙ্গে কথা বলছি, কী ভাবে কথা বলা দরকার এগুলোই তাঁর বক্তব্য থেকে অনুশীলন করতে হবে। এর জন্য দেশ বিদেশের বই কিংবা মার্কস-লেনিনের খণ্ড পড়তে হবে না। জ্যোতিবাবুর দেখানো পথ অনুসরণ করলেই আমার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্স্থাপন করতে সক্ষম হব।
একদিন বললেন শিলিগুড়ি যাই, কোনওদিন তো বাড়িতে নিমন্ত্রণ করোনি। আমি বললাম আপনি আমাদের বাড়িতে যাবেন? তিনি উত্তর দিলেন, কেন যাব না! তারপর তাঁকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী রত্না তাঁকে রান্না করে খাইয়েছিলেন। খুব খুশি হয়েছিলেন। তারপর থেকে শিলিগুড়িতে যতবারই আসতেন আমাদের বাড়িতে আসতেন। এখানে এসে যে যে জায়গায় যেতেন, আমায় ও রত্নাকে নিয়ে যেতেন। আমার সঙ্গে অনেক গল্প ভাগ করে নিতেন। পারিবারিক গল্প। কী ভাবে তিনি জলপাইগুড়িতে দোহমনীতে ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। দার্জিলিঙে রতনলালের বাড়িতে এসে উঠতেন। শিলিগুড়ির মহানন্দা পাড়াতে ছিলেন কালু ডাক্তারের বাড়ি। একবার ওঁর সঙ্গে লন্ডনে গিয়েছিলাম। ছাত্রাবস্থায় তিনি যে দোকান থেকে চাইনিজ খেতেন, সেখানে আমায় খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মনে পড়ে যখন তিনি শেষ হাসপাতালে ভর্তি হন। তার আগেও আমি ইন্দিরা ভবনে গিয়েছিলাম। ইশারা করে বলেছিলেন শুনতে এবং কথা বলতে পারছেন না। তার কয়েকদিন বাদেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বাবার মতো শ্রদ্ধা করতাম ওঁকে। ওঁর পথ ধরেই আমাদের এগোতে হবে। এর কোনও বিকল্প নেই।