জাকির হুসেন নামক কিংবদন্তি তৈরি হওয়ার পিছনে অনেকের মতো ভূমিকা ছিল শিবকুমারেরও

নিজস্ব প্রতিবেদক:- বুধবার দুপুরে ভিলেপার্লের পবন হংস শ্মশানে যখন নাগাড়ে মন্ত্রোচ্চারণের পটভূমিকায় চিরপ্রণম্য অগ্নিরথে সওয়ার হয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ৮৪ বছরের এক নশ্বর দেহ, তখন অগ্নির লেলিহান শিখার সামনে নিষ্পলক তাকিয়ে তিনি। ছবির ফ্রেমে স্পষ্ট, তাঁর ধারে কাছে কেউ নেই। সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা। মুখে এন-৯৩ মাস্ক। একাকী চিতার আগুনের দিকে তাকিয়ে তিনি। দেখছেন, বহুপ্রিয় এক সঙ্গীর দেহ কী ভাবে ধীরে ধীরে ছাই হয়ে যাচ্ছে। উস্তাদ জাকির হুসেনের এই ছবিটি ভাইরাল হয়েছে।কিছু আগেই তিনি পৌঁছেছিলেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মাকে শ্রদ্ধা জানাতে। শিবকুমারের শেষযাত্রায় এবং অন্ত্যেষ্টিতে ঝপঝপ করে শাটার পড়ার মতো একের পর এক ফ্রেম তৈরি হচ্ছিল। মিলিয়ে যাচ্ছিল। আবার তৈরি হচ্ছিল। সেই সব দৃশ্য একটার সঙ্গে অন্যটাকে জুড়ে দিচ্ছিল। গাঁথা হচ্ছিল এক আশ্চর্য ‘বিনিসুতোর শিউলি ফুলের মালা’। ছিলেন সেখানে অমিতাভ এবং জয়া বচ্চন, ‘শিব-হরি’ জুটির হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, জাভেদ আখতার-শাবানা আজমির মতো তারকা। ছিলেন তিনিও। জাকির হুসেন। শুধু ছিলেনই না, জম্মুতে জন্মানো এক হিন্দুর শেষযাত্রায় ‘কাঁধ দিলেন’ মুসলিম ব্যক্তিটি। শিবকুমারের পুত্র রাহুলের সঙ্গে। সেই ছবিও ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বচরাচরে নেটমাধ্যমবাহিত হয়ে। তবে অনেক বেশি নজরে পড়ছে শ্মশানের দৃশ্যটি। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে পোস্ট হচ্ছে সেই ছবি।এই তো আমাদের দেশ! এই-ই তো সেই দেশের ছবি। বহু খুঁজেও বার করা গেল না, এই ছবি কে তুলেছেন! জানা গেল না, কে-ই বা ছবিটি প্রথম পোস্ট করেন। ক্রমাগত গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে খণ্ড-ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ভারতে এই একটি ছবি কিঞ্চিৎ স্বস্তি দেয় বইকি। মাথা নত হয়ে আসে। শ্রদ্ধা জানানোর এটাই তো তুঙ্গ মুহূর্ত! অতঃপর প্রশ্ন ওঠে, আগুনের শিখায় শিবকুমারের নশ্বর দেহ যখন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, তখন কী ভাবছিলেন একদা তাঁর সহযোগী? সে সব হয়তো জানা যাবে না। আসলে জাকির হুসেন নামক ‘কিংবদন্তি’ তৈরি হওয়ার পিছনে অনেকের মতো ভূমিকা ছিল শিবকুমারেরও। সে সব কথাই কি স্মরণ করছিলেন চিতার সামনে দাঁড়ানো শিল্পী?

     

    ইনা পুরীর লেখা ‘শিবকুমার শর্মা: দ্য ম্যান অ্যান্ড হিজ মিউজিক’ বইতে জাকিরকে নিয়ে একটি কথালাপ রয়েছে, শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের জগতে যা অনেক সময় দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে প্রধান শিল্পী এবং সহকারী শিল্পীর মধ্যে যে সূক্ষ্ম হাইফেনটি স্পষ্ট বিদ্যমান থাকে, সেই ছক ভাঙতে চেয়েছিলেন শিবকুমার। পুণের এক অনুষ্ঠানে প্রথম পোস্টার দিয়ে জানানো হয় ‘শিবকুমার শর্মা-জাকির হুসেন’-এর যুগলবন্দি হতে চলেছে। যেখানে শিবকুমারের সঙ্গে পোস্টারে ছিল জাকিরের একই রকম ছবি। সাধারণত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠানের পোস্টারে যা সচরাচর দেখা যায় না। সেখানে মূল শিল্পী অধিক স্থান দখল করে থাকেন। সহযোগী শিল্পীর জন্য বরাদ্দ থাকে তুলনামূলক কম স্থান। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানো হয় শিবকুমারের। শিবকুমার সেই ‘যুগলবন্দি’-র তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন। পরে বলেছিলেন, ‘‘এ নিয়ে বহু জটিলতা হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ‘ইগো’ বা ‘অহং’ হল আত্মবিশ্বাসের এক মাত্র আধার। কিন্তু আমি তেমন মনে করি না। সমর্পণ থেকে আসে আত্মবিশ্বাস। সেই সমর্পণ থেকেই আসে শক্তি। ‘অহং’ আসলে ‘আমিত্ব’-এর জন্ম দেয়। শিল্পীর কাজ সাধনা করা এবং ভাবা। তিনি নিজে একটি মাধ্যমমাত্র।’’ যে কারণে সহশিল্পীকে সমপরিমাণ জায়গা ছাড়তে কুণ্ঠিত হন না তিনি।সহযোগী শিল্পীও যে আসলে মূল শিল্পীর মতোই গুরুত্বপূর্ণ, তা তিনি স্পষ্ট করেছিলেন চিরকাল। যে কারণেই হয়তো তাঁর একাধিক বাজনায় জাকির সঙ্গত করলে তাঁর জন্য বরাদ্দ থাকত পৃথক সময়। উদাহরণস্বরূপ কিরবাণী রাগটি স্মর্তব্য। দু’জনেরই যুবক বয়সের অনুষ্ঠান। সাধারণত কিরবাণীর মতো রাগ ঘণ্টাখানেক ধরে বাজানো হয় না। কিন্তু শিবকুমার বাজিয়েছিলেন। সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন জাকির। বাজনাটি এখনও ইউটিউবে পাওয়া যায়। শুনলে বোঝা যায়, গুণী শিল্পীকে কী ভাবে জায়গা করে দিচ্ছেন অন্য জন। সহশিল্পীর জন্য দরজা বন্ধ করে নয়, তাঁকে অন্তর্ভুক্তির মধ্যে দিয়েই পৃথক এক শৈলী তৈরি করতে চেয়েছিলেন শিবকুমার। যে ধারার সওয়ারি ছিলেন আর এক জন্য। তিনি হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। তিনিও সুযোগ দেন সহকারীকে তাঁর শিক্ষা-বিদ্যা তুলে ধরার। বস্তুত, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে পরস্পরকে চিনতেন শিবকুমার-জাকির। যাঁরা এই দু’জনের একাধিক অনুষ্ঠান দেখেছেন বা শুনেছেন, তাঁরা স্বীকার করবেন, ‘সওয়াল-জবাব’ অংশটি বিশেষ করে ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছত এই দুই শিল্পীর। প্রতিটি তানের পাল্টা উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেতেন জাকির। অনেক ক্ষেত্রেই যে সুযোগ জাকির পাননি অন্য শিল্পীর সঙ্গে সঙ্গত করার সময়। জাকির সঙ্গত করেননি এমন শিল্পী সম্ভবত নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রবিশঙ্করের সিন্ধভৈরবী রাগের সঙ্গে সঙ্গত হোক বা আলি আকবর খাঁ-সাহিবের সঙ্গে রাগ পিলু, নিঃসন্দেহে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম সেরা বাজনার মধ্যে স্থান পাবে। কিন্তু দৃশ্যকল্প? আর কোনও শিল্পী কি এমন দৃশ্যকল্পের জন্ম দিয়েছেন? মঞ্চে কোলে সন্তুর নিয়ে বসে ধ্যানমগ্ন এক রাজপুরুষ, তাঁরই সঙ্গে ‘সুলতান’ উপবিষ্ট সামনে তবলা নিয়ে। উল্লেখ্য, দু’জনই বাজনার সঙ্গে অন্তর্নিহিত ‘শোম্যানশিপ’-এরও মূর্ত প্রতীক। চুলের বাহার, পাঞ্জাবির রং, পা-ঢেকে পরিবেশন, ঝলমলে আলো— সব মিলিয়ে এক পরাবাস্তবতার জন্ম হত মঞ্চে। প্রতিটা তান সমে ফেরার পর দুই ধ্যানমগ্ন ঋষির পারস্পরিক স্মিত হাসি যেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম সেরা চিরন্তন ফ্রেম। তেমনই একটি দৃশ্যকল্প তৈরি হল শিবকুমারের শেষ বিদায়ের সময়ও।প্রসঙ্গত, অনুরূপ এক দৃশ্য তৈরি হয়েছিল লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণের সময়। মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে সশ্রদ্ধ শোকগ্রস্ত শাহরুখ খান এবং তাঁর ম্যানেজার পূজা দাদলানির ছবি নেটমাধ্যমের সৌজন্যে পৌঁছে যায় চরাচরে। প্রণম্য শিল্পীর শেষবিদায়ের অনুষ্ঠানে তৈরি হয়েছিল এক বৈগ্রহিক ছবি। দুই ধর্মের দুই ব্যক্তি নিজের রীতিমাফিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এক প্রয়াত শিল্পীকে। শাহরুখের ‘দুয়া’ নিয়ে যদিও তার পরে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। বিজেপি-র এক উটকো এবং ভুঁইফোঁড় নেতা বলে বসেন, শাহরুখ মাস্ক নামিয়ে থুতু ছিটিয়েছেন লতা মঙ্গেশকরের চিতায়! যা নিয়ে জলঘোলা হয়। আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যান নেটাগরিকরা। শিবকুমারের শেষযাত্রায় জাকিরের কাঁধ দেওয়ার ছবিও ঈশান কোণে অনুরূপ বিতর্কের মেঘের সঞ্চার করবে কি না, জানা নেই। তবে শাহরুখের ওই ঘটনার পর সত্যি বলতে কি, বিশ্বাস টলে গিয়েছে। এমন দৃশ্যের পর বিতর্ক হতে পারে! পারে। পরবর্তী সময় সে কথাই বলেছে। তবে বিশ্বাস এই যে, এই দৃশ্যপটগুলো, এই ফ্রেমগুলো চিরন্তন। শত বিতর্ক সত্ত্বেও এই ছবিগুলিকে ছিন্ন করতে পারে না মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের বিনিসুতোর সেই মালাটি। বিতর্ক পিছনে ফেলে যা তুলে আনে জীবনের এক শাশ্বত সত্য— ধর্ম নয়, এই দেশে মনুষ্যত্বই বলে শেষ কথা। বলে, শত চেষ্টা, শত বিভেদের পরও ক্ষীণতোয়া নদীর ফল্গু ধারার মতো সঞ্চারিত হচ্ছে একতার ছবি। শ্মশানে শিবকুমারে চিতার সামনে জাকিরের ছবি যেন সে কথাই চোখে আঙুল দিয়ে আরও এক বার দেখিয়ে দেয়। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, ‘দ্বেষ’টাই একমাত্র সত্য নয়। বরং তার উপরে উঠে আসে আরও এক সত্য— এই ছবিটাই আমাদের দেশ।