মানব ধর্মের কি প্রয়োজন আছে? বর্তমানে বহুল চর্চিত একটি নতুন ধর্ম হল 'মানবধর্ম'।

মানব ধর্মের কি প্রয়োজন আছে? বর্তমানে বহুল চর্চিত একটি নতুন ধর্ম হল ‘মানবধর্ম’।
মোবারক মন্ডল,নতুন গতি, করিমপুর, নদীয়া : বর্তমানে বহুল চর্চিত একটি নতুন ধর্ম হল ‘মানবধর্ম’।
একদল সেকুলারপন্থি লোকদের দেখা যাচ্ছে, যখনই সাম্প্রদায়িক কোন ঘটনা ঘটছে তখনই মানবধর্মের জয়গান করতে শুরু করছে। নিজেদের মানবতাবাদী বলে পরিচয় দিয়ে সোস্যাল মিডিয়া গরম করছে আর প্রচলিত ধর্মগুলির বিরুদ্ধে নিজেদের উগ্র মন্তব্য ছুড়ে মারছে। অথবা ধর্মের কথা বললে বলছে, মানবতাবাদ বা মানবধর্ম হল সবথেকে বড় ধর্ম। এটা মূলত প্রচলিত ধর্মগুলিকে অস্বীকার করার একটা পথ মাত্র। মজার ব্যাপার হল, ধর্মবিমূখ, নাস্তিক, ধর্মবিদ্বেষী সবারই সাধারণ ধর্ম হয়ে গেছে এই মানবধর্ম। এই ধর্মের স্বরূপটা যে কী তা বুঝার কোন উপায় নেই, বুলি আওড়ানো ছাড়া তারা নিজেরাও জানে না এর নীতিমালা কি?
মানবধর্ম আসলে কি?
সেই সমস্ত মানবতাবাদীদের মতে মানবধর্ম হল সেই ধর্ম যা মানুষের বিবেকের উপর ভর দিয়ে চলে। যেখানে সবার আগে প্রাধান্য পায় মানবকল্যান। অন্যের মাঝে নিজেকে খুঁজে দেখার ধর্ম। নিজের আনন্দকে সবার মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার ধর্ম। অন্যদের কষ্টকে নিজের মাঝে ভাগ করে নেওয়ার ধর্ম। কেউ কেউ মনে করেন শুধু সৎ ও মানবদরদী হওয়ায় হল মানবধর্ম।
তাদের মতামত হল চতুর্দিকে মানবকেন্দ্রিক যত অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও সঙ্কট ক্রমশ ভয়ানকরুপ ধারন করেছে তার একমাত্র কারন হল ধর্মের বেড়াজাল। এর সমাধান হল ধর্মের গন্ডি থেকে বেরিয়ে মুক্ত চিন্তার অধিকারী হতে হবে এবং শুধুমাত্র আমি একজন মানুষ আর আমার একমাত্র সাধনা হচ্ছে মানবতার সেবা এই নীতিতে বিশ্বাসী হতে হবে তবেই সমস্যার সমাধান হবে। আর এটাই হচ্ছে মানবধর্ম।
অনেকেই আজকে ধর্মমুক্ত মানবতাবাদের পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন। কারণ তাদের মতে, ধর্মের কারণেই মূলত দ্বন্দ্বটা তৈরি হচ্ছে এবং হয়, আর এই দ্বন্দ্বের কারণেই মানবজাতির মধ্যে ধর্মযুদ্ধ হয়েছে সবচেয়ে বেশি এবং পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে মানুষ ধর্মযুদ্ধে।
এখন প্রশ্ন হল মানবধর্মই যদি মূল ধর্ম হয় তাহলে প্রচলিত ধর্মগুলি কি তাহলে মানবতাবিরোধী?
এই মহাবিশ্বের সমস্তকিছুর একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট বা ধর্ম রয়েছে । আমি বলবো, পৃথিবীতে এমন কিছু নেই, যার কোন ধর্ম নেই, যেমন চুম্বকের ধর্ম সমগোত্রিয় পদার্থকে আকর্ষন করা, প্রকৃতির ধর্ম স্থান-কাল ভেদে তার ঋতুবৈচিত্র প্রকাশ করা । নদীর ধর্ম সাগরে মিলিত হওয়া, আর মহাকাশের নিজ নিজ কক্ষপথের অসংখ্য জ্যোতির ধর্ম হল অপরাপর গ্রহাণুপুঞ্জকে কম্পাস মেপে প্রদক্ষিন করা । অক্সিজেনের ধর্ম লোহার সাথে বিক্রয়া করে মরিচা তৈরী করা আর লোহার নমনীয়তার ধর্মের কারনেই একে পিটিয়ে পাত করা যায় । এই বৈশিষ্ট্য বা ধর্মসমুহের মাধ্যমেই যেকোন পদার্থকে চিন্হিত করা যায় । শুধু জড়োজগতে নয় জীবজগতেও প্রত্যেকটি জীবের এমন সতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা দিয়ে তাদেরকে চিন্হিত করা যায়। তেমনিভাবে মানুষেরও কিছু সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম আছে ।এই ধর্ম বা সতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলোকেই আমরা মনুষত্য, মানবতা বা মানবধর্ম বলে থাকি । তবে মনুষত্য বা মানবতার ক্ষেত্রে শারিরীক বৈশিষ্ট্যগুলোকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয় এবং আচরনগত ও মনস্তাত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয় ।
অন্যভাষায় বলা যায় – যে চারিত্রিক গুনাবলি এবং মনস্তাত্বিক বৈশিষ্ট্যসমুহ অর্জনের মাধ্যমে একজন মানুষ পরিপুর্ন মানুষে পরিনত হয় তাকে মনুষত্য বা মানবতা বলে । কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যসমুহ কি ? এই বৈশিষ্ট্যসমুহ স্রষ্টা মানুষের স্বভাবের মাঝেই দিয়ে দিয়েছেন । যেমন ধৈর্য , ভালোবাসা , সহনশীলতা , মানবতাপ্রেম,একতা ইত্যাদি । তবে অন্যান্য প্রাণী এবং মানুষের মাঝে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে । অন্যান্য জড়োবস্তু বা প্রাণী স্রষ্টা নির্ধারিত এই ধর্মটিকে কখনোই প্রত্যাখ্যান করতে পারে না । তবে এই মহাবিশ্বে একমাত্র মানুষই স্রষ্টার নির্ধারিত ধর্মটিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে । একটি হিংস্র বাঘিনী যতই ক্ষুদার্থ হোক না কেন কখনোই নিজের শাবকদেরকে হত্যা করে না কারণ এটি তাদের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য । কিন্তু দারিদ্রের কারণে অনাগত কণ্যা সন্তানদেরকে খুন করাটা আমাদের সমাজের সাধারণ ঘটনা । তবে এটি কি মানুষের ধর্ম ? মানুষ কি তাহলে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট ? কখনোই নয় । সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েছেন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি এবং বিবেক বিবেচনা । সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই ভালোভাবেই জানতেন যে মানুষ তার স্বাধিন ইচ্ছাশক্তি বলে মানবধর্ম থেকে দুরে চলে যাবে । এজন্য মানব জাতীর সৃষ্টির শুরু থেকেই স্রষ্টা মানুষকে পথনির্দেশ দিয়ে আসছেন তাঁর নির্ধারিত নিতিমালা এবং মনোনীত মানুষদের মাধ্যমে যেন মানুষ মানবতার ধর্ম থেকে বেশী দুরে সরে না যায় । স্রষ্টা পথনির্দেশনাকে আমরা ধর্ম বলে থাকি । যদিও প্রকৃতপক্ষে এটি ধর্ম নয় বরং এটি স্রষ্টা মনোনীত জীবনবিধান । মানুষের ধর্ম একটিই আর তা হলো মানবধর্ম । আর এই জীবনবিধানটি জীবনে মানবধর্মটিকে পালনেরই পদ্ধতি ।
সুতরাং এটা স্পষ্ট হল, মানবধর্ম ধর্মবিরোধী নয় এবং ধর্মও মানবতাবিরোধী নয়।
পৃথিবীতে প্রতিটি ধর্মই মানবতার কথা বলে। এমন কোন ধর্ম নেই যে মানবতার কথা বলে না। মানুষের কল্যানের জন্যই ধর্মের আগমন ঘটেছে। মানুষ যখনই সঙ্কটে পড়েছে তখনই ধর্মগুরুরা ধর্মের বাণী শুনিয়ে মানুষের ভিতরে মানবতাবোধ জাগিয়ে তুলেছে। মানুষ ধর্মের তলায় আশ্রয় গ্রহন করে প্রশান্তি লাভ করেছে। যদি ধর্ম না থাকত তাহলে আজ তথাকথিত মানবতাবাদীদের মানবিকতাই জেগে ওঠতো না। যদি ধর্মের ভিতরে মানবতা না থাকত তাহলে মানুষ অনেক আগেই ধর্মকে ছুঁড়ে ফেলত।
কেননা, আমার মতে, সত্যিকারের কোনো ধর্মে এমন কোনো বিধান থাকতে পারে না, যা মানবতার খেলাফ— অমানবিক । এখানে যুক্তি হলো, সব ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস একটাই— যিনি তাদের বিধান দিয়েছেন, তিনিই মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন । সুতরাং মানবের জন্যে কোনটা ভালো, এটা তার চেয়ে ভালো আর কে জানে ?
অন্যায় সব ধর্মের চোখেই অন্যায় এবং মানবিকতা সব ধর্মের চোখেই সমান ।
সামাজিক ও বৈশ্বিক ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে ধর্মগুলোর মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য আদতেই নেই । তাহলে আমরা এবার প্রশ্ন করি, যারা ধর্মমুক্ত মানববাদের কথা বলেন, তারা মানবতাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করতে চান ? আমরা দেখেছি, তারা নানা ধর্মের অনুসারীদের বিভিন্ন স্খলন নিয়ে সোচ্চার থাকেন, প্রকৃত অর্থে যেগুলো ধর্মের ত্রুটি নয় । এভাবে আসলে তারাই কি দ্বন্দ্বটা উস্কে দিচ্ছেন না ? অবশ্য আমার মনে হয়, এটা করে তারা ধর্ম-অনুসারীদের একরকম উপকারও করছেন । কেননা, এর ফলে ধর্মবেত্তারা তাদের অনুসারীদের ভুল-চুক সম্পর্কে আরও বেশি ওয়াকিবহাল হতে পারছেন এবং ধর্মের প্রকৃত মর্ম জানতে তারা আরও বেশি গবেষণা করছেন । ফলে আমরা দেখি, পৃথিবীতে ধর্মমুক্ত মানুষের সংখ্যা যতো বাড়ছে, ধর্মের প্রতি অনুরাগীর সংখ্যা বাড়ছে তার চেয়ে বহু বহুগুণ বেশি ।
একটু দেখে নেওয়া যাক প্রচলিত ধর্মের ভিতরে মানবতার কথা আছে কি না?
যেমন হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে –
ক) সমাজকে ভালোবাসো । ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও । দুর্গতকে সাহায্য করো । সত্য ন্যায়ের সংগ্রামে সাহসী ভূমিকা রাখার শক্তি অর্জন করো । (ঋগবেদঃ ৬.৭৫.৯)
খ) একজন নিরীহ মানুষের ক্ষতি যে করে সে মানুষ নয়, সে হায়েনা । তার কাছ থেকে দূরে থাকো । (ঋগবেদঃ ২.২৩.৭)
গ) হে মানবজাতি ! তোমরা সম্মিলিতভাবে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হও । পারস্পারিক মমতা ও শুভেচ্ছা নিয়ে একত্রে পরিশ্রম করো । জীবনের আনন্দে সম-অংশীদার হও । (অথর্ববেদ-৩.৩০.৭)
তেমনি ইসলাম ধর্মে মানবতার জয়গান করে বলা হয়েছে –
ক) “কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো লোককে হত্যা করে, যে লোক কাউকেও হত্যার অপরাধে অপরাধী নয়, কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেনি; সে (হত্যাকারী) যেনো গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করলো। আর যে তাকে বাঁচিয়ে রাখে সে যেনো গোটা মানব জাতিকে বাঁচালো।” (আল মায়েদাঃ আয়াত-৩২)
খ) “কল্যাণমূলক কাজে সবার সাথে সহযোগিতা করো এবং পাপ কাজে কারো সাথে সহযোগিতা করোনা” ( আল কুরআন, সূরা ৫: আয়াত ২)
গ) মহম্মদ (সঃ) বলেছেন বিদায় হজ্জের ভাষনে –
“কোনো আরবের কোনো অনারবের উপর এবং কোনো অনারব কোনো আরবের উপর এবং কোনো সাদা বর্ণের কোনো কালো বর্ণের মানুষের উপর এবং কোনো কালো বর্ণের কোনো সাদা বর্ণের মানুষের উপর কোনো প্রকার মর্যাদা নেই একমাত্র তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতি ছাড়া। বংশের ভিত্তিতে কারো কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই।”
একইভাবে প্রতিটি ধর্মেই মানবতার কথা বলা হয়েছে এবং মানবের সেবাকে পরিত্রাণ লাভের একমাত্র উপায় বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
তাই প্রত্যেকেই যদি নিজ ধর্মকে সঠিকভাবে মেনে চলে তাহলে আর মানবতা সঙ্কটে পড়বে না। তথাকথিত মানবতাবাদীদের অভ্যাস হল তারা ধর্মের অনুসারীদের আচার আচারণ দেখে ধর্মের দিকে কাঁদা ছুঁড়ে। এবং তারা মানবতবাদী হয়েও ধর্মের এবং ধর্মের অনুসারীদের সমালোচনায় মুখর হয়। ফলে ধর্মীয় উস্কানি আরও বেড়ে যায়। তাদের মানবিকতা হওয়াতে ধর্মের কোন সমস্যা নেই বরং সে ধর্মেরই অনুশাসনকে মানলো। সোস্যাল মিডিয়ায় ফলাও করে নিজেকে মানবতাবাদী বললেও প্রকৃতপক্ষে তাদের বাস্তবে কোন মানবতার সেবায় দেখা যায় না। এটা শুধুমাত্র তাদের ধর্মকে অস্বীকার করার কৌশল মাত্র।
বর্তমানে দেশে সাম্প্রদায়িকতার আবহাওয়া তৈরির কারন হল রাজনৈতিক স্বার্থ। একদল মানুষ এখান থেকে আখের গুছাতে ব্যস্ত।নিজ নিজ স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করছে। প্রত্যেকেই তার ধর্মকে বেস্ট মনে করার কারণে মূলত দ্বন্দ্বটা তৈরি হয় না । বরং দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, আমার কাছে যেমন আমার ধর্মটা বেস্ট তেমনি তার কাছেও তো তার ধর্মটা বেস্ট— এই মনোভাব পোষণের অভাব থেকে । আমার মতো তার ধর্মও তার কাছে বেস্ট— এই মনোভাব যদি আমরা লালন করতে পারতাম, তাহলে অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কসুর হতো না ।
সবিশেষ— ধর্মের সঠিক জ্ঞান থাকলে এবং ধর্মের অনুশাসনগুলো প্রত্যেকেই ঠিকঠাক মেনে চললে আজকে আলাদা করে মানবধর্ম পালনের কোন প্রয়োজন হবে না। নিজেকে মানবতাবাদী বা মানবধর্মের অনুসারী বলে গর্ববোধ করার থেকে সেই ধর্মের অনুসারী হয়ে বেশি গর্ববোধ করত। একথা চিরন্তন সত্য যে, কেবল ধর্মের সঠিক বোধ ও অনুশাসনের মাধ্যমেই মানুষ সত্যিকারের মানবিক হতে পারে। সুতরাং ধর্মের চেয়ে মানবতা বড় হলেও মানবতা শেখার জন্যে ধর্মের চেয়ে বড় আর কিছু নেই ।