দ্বি-স্বার্ধ শতবর্ষের আলোকে দেশবীর মীর নিশার আলী তিতুমীর

শরীফুল ইসলাম। নতুন গতি,

    ঠিক তাঁর জন্মগ্রহণের বছর পঁচিশেক পূর্বে এক অসম যুদ্ধে কয়েকজন বিশ্বাস ঘাতকের ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতির প্রেক্ষিতে শেষ হয় বাংলার স্বাধীন নবাবী। অতঃপর বণিকের দাঁড়ি পাল্লায়ই শাসকের ছদ্মবেশে এ বাংলা তথা ভুভারতে লাগু হয় এক অমানুষিক নির্যাতন যন্ত্রের।
    সেই লাগামহীন শোষণ যন্ত্রের চাকা বুক ছিতিয়ে রুখে দেওয়ার সংকল্প নিয়েই যেন জন্ম গ্রহন মীর নিশার আলী তিতুমীরের।

    ইংরেজী ১৭৮২-র ২৭শে জানুয়ারী এই বাংলার বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনার বসিরহাটের বাদুরিয়া চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন মীর নিশার আলী।
    পিতা মীর হাসান আলী, মাতার নাম আবিদা বেগম।
    প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিশার আলী। অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর ইংরেজ ত্রাস লড়াকু এই মানুষটি তিতুমীর নামেই ইতিহাসে পরিচিত।

    প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের বিদ্যালয়ে। তারপর মাদ্রাসা। মাত্র আঠারো বৎসর বয়সে হাফিজ, কোরআন-হাদিসে অসাধারণ পান্ডিত্য, বাংলা ব্যাকরণ সহ আরবী ও ফার্সী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

    মাত্র চল্লিশ বৎসর বয়সে ইসলামের পবিত্র ভূমি মক্কায় পাড়ি দেন হজ্জ ব্রত পালনে। এখানেই ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ স্যার সৈয়দ আহমেদ সাহেবের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলায় এসে ওয়াহাবী আন্দোলনের শুরু করেন এবং নেতৃত্ব দেন।

    তৎকালীন নীলকর ইংরেজ এবং দেশীয় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বেশ কিছু জমিদার গ্রাম বাংলার দরিদ্র কৃষক প্রজাদের সঙ্গে অতীব নিষ্ঠুর আচরণ করতো। পালোয়ান তিতুমীর এই সকল নীলকর ইংরেজ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লাঠি তুলে নেন। এবং প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অল্প সময়ের মধ্যই তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার কৃষক আন্দোলনের জনপ্রিয় মুখ। মিষ্ঠ ভাষী সুবক্তা তিতুর কথা শোনার জন্য দূর দুরান্তের বহু মানুষ তাঁর কাছে এসে আসর করতো।

    ইংরেজী ২৩ শে অক্টোবর, ১৮৩১ -এ তিতুমীর নারিকেল বেড়িয়ায় তাঁর বিখ্যাত বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। মূলত বাঁশ এবং কাদা মাটির সমন্বয়ে নির্মিত দ্বিতল বিশিষ্ঠ এই কেল্লার অনেক গুলি প্রকোষ্ঠ ছিল। এক একটি প্রকোষ্ঠে ইট, কাঁচা বেল ইত্যাদি নানা রকমের বস্তু ছিল যা শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো।

    ইংরেজ ও কুখ্যাত জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতুর নেতৃত্বে কৃষক-প্রজার লড়াই প্রথম দিকে সাফল্যের মুখ দেখেছিল।
    চব্বিশ পরগনা, নদীয়া সহ ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের দখল নেন তিতুমীর। তাঁর বিভিন্ন আন্দোলন -এর মধ্য বারাসাত বিদ্রোহ ছিল অন্যতম উল্লেখযোগ্য। ইংরেজ ঐতিহাসিক উইলিয়ান হান্টারের মতে , তিতুমীর নেতৃত্বে ওই বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষক-সেনা অংশগ্রহণ করেন।

    তাঁর লড়াইয়ের অভিঘাত অত্যাচারী নীলকর ইংরেজ ও নিষ্ঠুর জমিদারদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল।

    ১৮৩১, ১৯ শে নভেম্বর ব্রিটিশ সেনা ও স্থানীয় জমিদারদের লেঠেল বাহিনী বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে । বীরত্বের সঙ্গে তিতুমীর আক্রমণ প্রতিহত ও প্রতি আক্রমণ করেন। শেষ পর্যন্ত উভয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণের মুখে তিতুর বাঁশের কেল্লা ভেঙে পড়ে। অসম এই যুদ্ধে কেল্লার মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়।

    জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতুমীরের লড়াইকে বহু ঐতিহাসিক খাটো করে দেখেছেন। কেউ বলেছেন তিতুমীরের লড়ায়ের মূলে ছিল হিন্দু বিদ্বেষ। কেউ কেউ মনে করেন, ইসলামের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা স্থাপন ও ইসলাম প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য । তবে, এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের অভিমত টি প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, তিতুমীর লড়াই ছিল প্রকৃতপক্ষে কৃষক আন্দোলন। এবং এই আক্রমণের লক্ষ্য ছিল অবশ্যই অত্যাচারী নীলকর ইংরেজ ও অত্যাচারী স্থানীয় জমিদার।