শীতের সকালে লোভনীয় জয়নগরের মোয়া

বাবলু হাসান লস্কর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা : দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী শীতের আমেজে জয়নগরের মোয়া। ভালো জয়নগরের মোয়া না বহরুর মোয়া? দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বহরু গ্রামের বাসিন্দার যামিনীবুড়ো তাঁর নিজের খেতেই চাষ হত কনকচূড় ধান, আর সেই কনকচূড় ধানের খইয়ের সঙ্গে নলেন গুড় মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করে তিনি পরিবেশন করলেন একটা অনুষ্ঠানে। এমন জিনিস আগে কেউ খায়নি। অসাধারণ খেতে লাগল সবার সকলে বলা-বলি করতে লাগল, সত্যি অসাধারণ। চারিদিকে এভাবেই জন্ম নিল মোয়া। জয়নগরের মধ্যেই একটি গ্রাম পঞ্চায়েত বহরু। দক্ষিণ শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে বহরু কিম্বা জয়নগর স্টেশনে নামুন। নামলে আপনার চোখের সামনে দেখতে পাবেন মোয়া তৈরী। দেখতে দেখতে আপনারও মোয়া কেনার ইচ্ছা জন্মাবে।

    মোয়ার জন্মস্থান কিন্তু বহরু গ্রামে। জয়নগর হল ঐতিহ্যবাহী-পীঠস্থান ও কেন্দ্রস্থল তার জন্য বহরুর পরিবর্তে জয়নগরের নাম টি অধিক প্রচলিত। ইতিহাসও মোটে হেলাফেলার নয়। রায়মঙ্গল কাব্যে উল্লেখ মেলে ‘বড়ুক্ষেত্রে’র নাম। এই বড়ুক্ষেত্রই বহরু উনিশ শতকের শুরুতে এই গ্রামের জমিদারি পান নন্দকুমার বসু। তিনি ঠিক করেন এই বহরুতেই মথুরা-বৃন্দাবন স্থাপন করবেন। সেই ইচ্ছে অনুযায়ী, বহরুতেই তৈরি হয় শ্যামসুন্দরের মন্দির। সেই মন্দিরের গায়ে দেওয়ালচিত্র এঁকেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী গঙ্গারাম ভাস্কর। এই বহরুতেই ছোটোবেলা কেটেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বীর বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য আর এসবের পাশাপাশি রত্নগর্ভা এই গ্রামই জন্ম দিয়েছিল বাঙালির অতিপ্রিয় নলেন গুড় ও খইয়ের মিশ্রণে মোয়ার আবির্ভাব। মোয়ার বাণিজ্যিক উৎপাদন। মোয়াতে মিশল গাওয়া ঘি, খোয়া ক্ষীর এলাচ,কাজু কিচমিচ সহ খই আর গুড়ের জুটিও অন্তরঙ্গ হলো। এবার কালক্রমে জয়নগরের মোয়া এমনই বিখ্যাত হয়ে উঠল যে তার নামের ভারে ধামাচাপা পড়ে গেল জন্মদাত্রী বহরুর নাম। এই নব্বই বছরে জয়নগর-মজিলপুরেই গজিয়ে উঠেছে প্রায় আড়াইশোটি মোয়ার দোকান। তবে জয়নগর স্টেশনের ১নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাইরে বাস রাস্তার পাশে ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ আজো দাঁড়িয়ে। আজো এই দোকানের খ্যাতি বুঁচকিবাবুর দোকান হিসেবেই। কিন্তু, স্বাদের খ্যাতিতে এই দোকানকেও এখন টেক্কা দিচ্ছে কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, পঞ্চানন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বা রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মোয়া, কোয়ালিটির ফারাকে মোয়ার দামেরও হেরফের হয়। দেড়শো টাকা কেজি থেকে দাম পৌঁছতে পারে পাঁচশো-সাড়ে পাঁচশো টাকা কেজিতেও। এক-এক কেজিতে কুড়িটি করে মোয়া। খাঁটি জয়নগরের মোয়ার ক্ষেত্রে খই আর গুড়ের রসায়নটাই আসল হয়ে দাঁড়ায়। খই মানে কনকচূড়। বাংলায় মরিশাল নামে আরেক রকমের খইয়ের ধানও চাষ হয়। স্বাদে, গন্ধে কনকচূড়ের থেকে ঢের পিছিয়ে এই ধান। অথচ কলকাতা ও শহরতলির বাজারে ‘জয়নগরের মোয়া’ তকমার আড়ালে গিজগিজ করছে এই মরিশাল খইয়েরই মোয়া। একইসঙ্গে, আসল নলেন গুড় পাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠেছে এখন। উৎকৃষ্ট মোয়ার জন্য প্রয়োজন খাঁটি নলেন গুড়। জিরেন খেজুর কাঠ থেকে রস সংগ্রহ করে শিউলিরা (যাঁরা খেজুর রস সংগ্রহ করেন) রেখে দেন তিন দিন। তারপর, সেই রস সামান্য আঁচে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড়। এই নলেন গুড় আর কনকচূড়ের গুণমানে খামতি হলে প্রয়োজন পড়ে কৃত্রিম রং, ফ্লেভারের। যাঁরা রসিক, তাঁদের জিভ দিব্যি ধরতে পারে সেই ‘নকল’ স্বাদ। অতএব, আসল মোয়া চাখতে গাঁটের কড়ি ফেলতেই হবে। সেই জন্যেই কেজি প্রতি মোয়ার দাম পাঁচশোও ছাপিয়ে যায় হরবখত। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কুলপি-কাকদ্বীপ-নামখানায় ৪০০ বিঘার বেশি জমিতে আজো চাষ হয় কনকচূড় ধান। জিরেন কাঠের খেজুর রস অবশ্য দুর্লভতর হচ্ছে দিন-দিন।

    হেমন্ত শেষ হতে না হতেই মোয়া তৈরির মরসুম শুরু হয়ে যায় জয়নগর-মজিলপুর-বহরুর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। অসংখ্য পরিবারের সারা বছরের রোজগার এই কয়েক মাসের মোয়া তৈরি ও বিক্রি থেকেই উঠে আসে। মোয়াতে নলেন গুড়, খইয়ের সঙ্গে মেশে গাওয়া ঘি, এলাচ, পেস্তা, খোয়া ক্ষীর। ওপরে কিসমিস, কাজু। ঘি, পেস্তা, ক্ষীরের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে দামের হেরফের ঘটে। চাহিদা বাড়লেও দাম ঊর্দ্ধমুখী হয় মাঝেমাঝেই।

    জয়নগরের মোয়ার আধিপত্যে কীভাবে যেন বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে মোয়ার আবিষ্কর্তা যামিনীবুড়োর গ্রাম বহরু। যদিও, বহরুর মোয়া স্বাদে কিন্তু মোটেও পিছিয়ে নেই জয়নগরের মোয়ার থেকে। বহরু বাজারের ওপরেই ‘শ্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ মোয়া তো বিখ্যাত। প্রায় একই উপাদান, কিন্তু জয়নগরের মোয়ার থেকে বহরুর মোয়া যেন কিঞ্চিৎ নরম। জয়নগরের মোয়ায় ক্ষীরের আধিক্য সামান্য বেশি, আর বহরুর মোয়ায় গুড়ের। স্বাদের বিচারে কে সেরা— তা নিয়ে অবশ্য রসিকদের মধ্যে বিবাদের শেষ নেই।

    স্বাদে পিছিয়ে না থাকলেও খ্যাতিতে বহরুর মোয়া ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি জয়নগরের। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, বহরুও বৃহত্তর জয়নগরেরই অংশ। সেই যুক্তিতে বহরুর মোয়াও জয়নগরের মোয়া। বহরুর মোয়া-বিক্রেতা-নির্মাতারা এই কথা মোটেও মানতে চান না। খ্যাতিতে পিছিয়ে থাকলেও আলাদা অস্তিত্বের এই গৌরব তাঁরা ছাড়তে রাজি নন।

    জয়নগর-বহরুর খাঁটি মোয়ার স্বাদে সিংহভাগ বাঙালিই কিন্তু বঞ্চিত। অথচ, বাজার ভরে আছে নকল ‘জয়নগরের মোয়ায়’। চৌকো বাক্স, বাক্স খুললেই হলুদ পাতলা পলিথিনের ভিতর থেকে যে নিরীহ মোয়ারা উঁকি মারে, তাদের জন্মস্থল জয়নগরের ধারেকাছেও নয়। উপকরণ, স্বাদ— খামতি সবদিকেই। উপায় নেই, তাই জেনে-বুঝেই কনকচূড়, আসল নলেন গুড়, খয়া ক্ষীর, পেস্তা, এলাচের সেই মধুমণ্ডের বদলে ‘জয়নগরের মোয়া’র তকমা সাঁটা মরীচিকার দিকেই বারবার ছুটে যাই আমরা। বাজারে আরো জাঁকিয়ে বসে ছদ্মবেশী ‘জয়নগরের মোয়া’রা। এই নকল মোয়াদের ভিড় থেকে আসল মোয়া খুঁজে বের করা প্রায় দুঃসাধ্য। তাই, খাঁটি মোয়া চাখার উপায় আপাতত একটাই। একবার সময় বের করে, গা ছাড়া দিয়ে জয়নগরগামী কোনো ট্রেনে উঠে পড়া। এরপর, বহরু বা জয়নগর-মজিলপুর নেমে পড়ুন যেখানে ইচ্ছে মোয়ার দোকান গুলিতে।