নতুন গতির ঈদ সংখ্যা প্রকাশ ও গুণীজন সংবর্ধনা

এস হুদা আনার : প্রতিবারের মতো এবারও নতুন গতির ঈদ সংখ্যা প্রকাশ ও গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হল ২১ আগস্ট রোববার, কলকাতায় উর্দু একাডেমি সভাঘরে। অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন ড. কুমারেশ চক্রবর্তী এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ আবদুল হান্নান। মননশীল পত্রিকাটির মোড়ক উন্মোচন করেন খ্যাতিমান সাহিত্যিক শেখ হাসান ইমাম।এছাড়াও সম্মাননীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. মীরাতুন নাহার (প্রাবন্ধিক), ইদ্রিস আলী (বিধায়ক), মইনুল হাসান (প্রাবন্ধিক),, ডঃ সাইফুল্লাহ (প্রাবন্ধিক), ডঃ ইমামুল হক (প্রাবন্ধিক), একেএম ফারহাদ, মাসুদ করিম (আইনজীবী),, কাজী মোহাম্মদ ইয়াসিন, শাহিদ আকবর, শফিকুল ইসলাম, ড. মনীষা চক্রবর্তী প্রমুখ।

    সংবর্ধিত হন মনোয়ারা খাতুন, ডঃ রমজান আলি, মোঃ শাহ নওয়াজ, মোঃ আকমাল হোসেন, আইয়ুব রানা(বাংলাদেশ)।এছাড়াও অনুষ্ঠানে তিনটি গ্রন্থ প্রকাশ পায়। আবদুল মান্নানের “সময়ের সংলাপ”, শেখ রমজান আলির “আলো নয় আগুন”, এবং আলমগীর রাহমানের “প্রজন্মের সিলেবাসে নেই”।

    প্রথানুযায়ী কোরানিক আয়াতোচ্চারণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন মাওলানা মোঃ শফিউল্লাহ মল্লিক। স্বাগত ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল প্রাবন্ধিক হাসিবুর রহমানের, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। সেটি সম্পন্ন করেন নতুন গতি সম্পাদক এমদাদুল হক নূর।
    তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় নতুন গতির ইতিহাস তুলে ধরেন। ১৯৯৪-এ প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক আবদুল আজিজ আল আমানের হাত থেকে তিনি সম্পাদনার দায়িত্ব পান। শক্তি তখন তাঁর ক্ষীণ। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতাটিকে মনে করিয়ে দেয়:

    “কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যা রবি,
    শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
    মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল স্বামী,
    আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।”

    এমদাদুল হক নূর যেন সেই মাটির প্রদীপ। পরম করুণাময়ের কাছে শুধু শক্তি প্রার্থনা করেছেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ সেই শক্তি দান করেছেন এমদাদুল হক নূরকে। ২০০৩ থেকে আজ কুড়ি বছর ধরে ৫০০ থেকে ৭০০ পৃষ্ঠার ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করে চলেছেন অনলসভাবে। করোনা আবহেও মুখ থুবড়ে পড়েনি “নতুন গতি”। চলার পথে টানাপোড়েন যে পড়েনি তা নয়, কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতি রক্ষার মহান কাজে ব্রতী এমদাদুল হক নূর উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজেও ঝড়কে প্রতিহত করেছেন। পুরনো ইতিবৃত্ত তুলে ধরে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রথমদিন থেকে সঙ্গে থেকে যাঁরা তাঁকে সাহচর্য দান করেছেন সেইসব ব্যক্তিত্বদের। আজ তাঁদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইদ্রিস আলি, মীরাতুননাহার, শেখ হাসান ইমাম প্রমুখ।

    উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা পরিষদের বন কর্মাধ্যক্ষ একেএম ফারহাদের বক্তব্যে কিছুটা ক্ষোভ ঝরে পড়ে। তিনি বলেন, মাতৃভূমিকে ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। আমরা সেটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, কিন্তু বড় দুঃখজনক ব্যাপার আজ আমাদের প্রমাণ করতে হচ্ছে আমরা ভারতীয়। আমাদের পূর্বপুরুষ তো দেশ বিভাজনের সময় দেশ ছেড়ে যাননি, তবে কেন আমাদের এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে?

    অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার এমদাদুল হক নূরের প্রয়াসকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, সাহিত্যের মূল লক্ষ্য মিলন ঘটানো। “নতুন গতি” নিরন্তর সেই কাজটি করে চলেছে চল্লিশ বছর ধরে অনলস পরিশ্রম করে। “নতুন গতি” আজ একটি ইতিহাস। “নতুন গতি”র সহ-সম্পাদক মনিরা খাতুনের একটি খুব ভালো লাগা কবিতা “ঘুম নেই” আবৃত্তি করে তিনি বক্তব্যের সমাপ্তি টানেন। সম্প্রীতিগামী এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লেখক অধ্যাপক ইমানুল হকের বক্তব্যে বিভেদকামী মানুষের প্রতি ক্ষোভ উগরে পড়ে। একটি চরম সংকটের মুখোমুখি আমরা ভেবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
    প্রাক্তন সাংসদ তথা প্রাবন্ধিক মইনুল হাসান প্রশ্ন তোলেন, এ কোন ভারতবর্ষে বাস করছি আমরা? সত্যিকারের ভারতবর্ষের ঠিকানা কী? নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করছে শিক্ষক, ঠুনকো অজুহাতে ধর্ষক মুক্তি পাচ্ছে, তাদের সম্মানিত করা হচ্ছে, চোখের সামনে, মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে — এ কোন ভারতবর্ষে আমাদের অবস্থান?

    নতুন গতি ঈদ সংখ্যাটির উন্মোচক সাহিত্যিক হাসান ইমামের কন্ঠেও ঝরে পড়ে সেই একই প্রশ্ন। আমাদের মূল্যবোধের শিক্ষা কই? মানবতার শিক্ষা কই? কেন আজ এত সম্প্রীতির অভাব? আসলে, আমরা ক্রমশ সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছি। পরস্পরকে জানি না বলে অজ্ঞানতার কারণেই বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে সমাজে। ৪০ বছর ধরে প্রকাশিত ঐতিহ্যবাহী “নতুন গতি”র এই সম্মেলনকে তিনি মিলনোৎসব বলে আখ্যায়িত করেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সম্পাদক এমদাদুল হক নূর এবং মনিরা খাতুনকে।

    সততা, ধারাবাহিকতা এবং বিনম্রতা মানুষকে মহীয়ান করে তোলে। এমদাদুল হক নূর প্রসঙ্গে কথাগুলো বলেন শিক্ষাব্রতী কাজী মোহাম্মদ ইয়াসিন। তিনি অপূর্ব-সুন্দর একটি বক্তব্যে বর্তমান লেখকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা আজ ক্রমশ হাসতে ভুলে যাচ্ছি। এখন যারা লেখালেখি করছেন তাঁদের সকলের প্রতি অনুরোধ আপনারা হাসাবার চেষ্টা করুন। প্রসঙ্গত তিনি মুজতবা আলি এবং শিবরাম চক্রবর্তীর কথা বলেন।

    অনুষ্ঠানের সভাপতি ড. কুমারেশ চক্রবর্তী স্বীকার করেন “নতুন গতি” বাংলা সাহিত্যে একটি অন্য মাত্রা এনেছে। বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, উদার মানসিকতা আমার পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। তাই “নতুন গতি”র এই সহবস্থানবাদী ভাবমূর্তি আমাকে নিমুগ্ধ করে। ইসলামধর্ম সম্প্রীতির কথা বলে। “মদিনা সনদ” হল বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান। নারীদের সম্মান দিতে শিখিয়েছে ইসলাম।”Women Empirement সেখান থেকেই পাওয়া।

    হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, বিধায়ক তথা আইনজীবী ইদ্রিস আলী তাঁর নাতিদীর্ঘ বক্তব্যে সবাইকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। এমদাদুল হক নূরের সঙ্গে প্রথম থেকে আছেন এবং আজীবন সঙ্গে থাকবেন বলেও আশ্বস্ত করেন।

    এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন আইনজীবী মাসুদ করিম, অধ্যাপক সাইফুল্লাহ, শফিকুল ইসলাম, ডঃ রমজান আলি, সিরাজুল হক, আবদুল হান্নান, শাহিদ আকবর প্রমুখ।অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে সংগীত পরিবেশন করেন ড.মনীষা চক্রবর্তী, মহব্বত হোসেন ও সাইফুল ইসলাম। কবিতা পাঠে অংশ নেন কেতকী মির্জা, হাসনে আরা বেগম, আরিফা গোলদার, মফিজুল ইসলাম, আসাদ আলি প্রমুখ। মানপত্র পাঠ করে শোনান রুবাই বানু। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন আসাদুল ইসলাম। সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় রফিক উদ্দিন মণ্ডল।

    অনুষ্ঠানের মাঝখানেই সমাজসেবী আবদূল হান্নান “নতুন গতি”র অগ্রযাত্রাকে উদ্দীপিত করতে পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করে “নতুন গতি”কে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেন।