প্রাক স্বাধীনতা মোমবাতি মিছিলে সামিল সুন্দরবনের শিশু পার্লামেন্টের কন্যাশ্রীর দল

নতুন গতি, ওয়েব ডেস্ক :রাত পোহালেই বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ উপমহাদেশ আমাদের গর্বের ভারতবর্ষের পঁচাত্তর তম স্বাধীনতা দিবস।আর তার আগের দিন দুপুরে, কলকাতা শহরের ঐতিহ্যশালী প্রেসক্লাবের অন্দরমহল একদল কচিকাঁচা শিশুর কলরবে মুখর হয়ে উঠেছিল । ওরা এসেছে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে। ওরা সেচ্ছাসেবী সংস্থা সিনির উদ্যোগে গড়ে ওঠা ‘চাইল্ড পার্লামেন্টে’র সদস্য। এছাড়াও আজ এখানে উপস্থিত রয়েছে কলকাতার কিছু পথশিশু ও অন্যান্যরা।

    সিনির প্রতিষ্ঠাতা ড: সমীর নারায়ণ চৌধুরী অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করে বলেন “বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে সিনি জোর দিয়ে এসেছে পরিল্পনায় শিশুদের অংশ গ্রহণ এর উপর। তাঁরই অঙ্গ হিসাবে এই কর্মসূচীর সূচনা। আমাদের লক্ষ্য এক শিশু বান্ধব সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে শিশুরা পাবে তাদের পূর্ণ বিকাশের পরিবেশ। অতিমারীর পরিস্থিতিতে শিশুদের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সিনি চেষ্টা করে গেছে শিশুদের প্রত্যেকে সমাজমনস্ক একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গড়ে তুলতে। স্কুল বন্ধ থাকায় অনেকটা সময়ও পাওয়া গেছে গঠন মূলক কাজে শিশুদের উৎসাহিত করার।”

    অনুষ্ঠানের শুরুতে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সুজয় রায় শিশুদের দিকে ছুঁড়ে দিলেন ছোট্ট প্রশ্ন আজ কন্যা শ্রী দিবস আর কাল স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হবে বলত — “স্বাধীনতা বলতে তোমরা কী বোঝ?” কিছুটা নিস্তব্ধতা! তারপর উঠে আসে একটি শক্ত হাতের মুঠো। অতিসাধারণত্বের মোড়কের আড়ালে, অসাধারণ এক কন্যা শ্রী – নাম সাথী উঠে দাঁড়ায়। শান্ত অথচ অবিচল স্বরে সে বলে –

    “সুন্দর বনের প্রত্যন্ত অঞ্চল কুলতলিতে আমার বাস। ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়েছিলাম – পৃথিবীর তিন ভাগ জল এক ভাগ স্থল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখছি – আমাদের পৃথিবীটা পুরোটাই জল। এখানে প্রতিদিন চেনাশোনা কোন না কোন ছোট বাচ্চা জলে ডুবে মারা যায়। জলে ডুবে মৃত্যু ভয়ে আমরা প্রতিদিন কুঁকড়ে যাই। প্রতিরাতে আমরা দুঃস্বপ্ন দেখি। চেনা মুখ গুলো রোজ হারিয়ে যায় অতল জলের গভীরে। আমরা এই প্রতিকুলতাকে জয় করে একটু সুস্থ ভাবে নিশ্চিন্তে বাঁচতে চাই। এই নির্ভয়ে বাঁচা টুকুই আমার কাছে ‘স্বাধীনতা’।

    দৃঢ়চেতা মেয়েটির উলটে প্রশ্ন করে “পৃথিবীর অন্য সকল শিশুর মত, আমাদের কি সুস্থ ভাবে বাঁচার অধিকার নেই? আমাদের সমস্যা ও মতামত টুকু জানাবার কি কোন জায়গা নেই?”পরক্ষণেই ছোট্ট হাতের মুঠো গুলো সমষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠে এলো শূন্যে। সম্মিলিত শৈশবের জোরালো আওয়াজ সোচ্চারে জানালো তাদের প্রাণের দাবী। প্রেসক্লাবের ছোট্ট ঘরটায় যেন আছড়ে পড়লো সাত সমুদ্রের সুবিশাল ঢেউ। “ বন্ধ হোক এড়ান যায় এমন শিশু মৃত্যু, হেসে খেলে বড় হোক সুন্দরবনের শিশু রাও।

    ভূমিকার আগেও থাকে একটা শুরুর গল্প। সূচনার সূত্রপাত হয়েছিল বছর তিনেক আগেই। সুন্দরবন সংলগ্ন নদী তীরবর্তী অঞ্চলে প্রতিনিয়ত জলে ডুবে শিশু মৃত্যু বন্ধ করতে সিনি তার য় ৫০ বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগী অস্ট্রেলিয়ার ‘দ্য জর্জ ইনস্টিটিউট’ এর সহায়তায় সুন্দরবন লাগোয়া উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় জলে ডোবা দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করে।

    সমীক্ষায় উঠে এসেছে এক ভয়ঙ্কর তথ্য। সারা পৃথিবীতে যত-রকমের দুর্ঘটনায় বাচ্চাদের প্রাণহানি ঘটে, তারমধ্যে জলে ডুবে শিশুমৃত্যু অন্যতম। সুন্দরবন অঞ্চলে নদী-নালা-খাল-বিল, বা পুকুর-ডোবার মত অগুন্তি জলাশয় জালের মতো ঘিরে রেখেছে বিস্তীর্ণ লোকালয়। দেখা গিয়েছে, জলে ডুবে মৃত্যুর কারণে সুন্দরবনের এই অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় তিনটে করে শিশুর পরিচয় পৃথিবী থেকে মুছে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে।

     

    সংশ্লিষ্ট সুত্র অনুযায়ী জানা যায়, করোনা অতিমারির আবহে বহুদিন ধরে শিশুদের শৈশব জেলখানার মতো বাড়ির চৌহদ্দির নির্দিষ্ট সীমারেখাতেই আবদ্ধ। কিন্তু এর মধ্যেই ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে আরো বড় এক ভয়ঙ্কর মহামারি। মুহূর্তের অসতর্কতায় জলে ডুবে আকস্মিক দুর্ঘটনার কবলে নিঃশব্দ মৃত্যু প্রতিমুহূর্তে কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য কচি প্রাণ। ভবিষ্যতের অমূল্য প্রাণ তলিয়ে যাচ্ছে অতল জলের গভীরে; দায়ী অসচেতনতা এবং সঠিক কার্য্যকারিতা প্রয়োগে বাস্তবায়ন ও সদিচ্ছার অভাব। জলে ডুবে শিশু-মৃত্যু প্রতিহত করার জন্য নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে; এই চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলনে গড়ে তোলা হয়েছে ‘চাইল্ড পার্লামেন্ট’। সংসদীয় গনতন্ত্রের অধিবেশনের আদলে সুন্দরবনের প্রান্তিক উপকুল অঞ্চলের ১০ টি ব্লক থেকে প্রায় ৮০০শিশুদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রায় ১৫০ টি শিশু সদস্য অংশগ্রহণের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে ‘চাইল্ড পার্লামেন্ট’।

    সংস্থার পক্ষ থেকে শ্রী সুজয় রায় জানান, ” বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ শিশু মৃত্যু বন্ধ ও স্বাস্থ্যের অনান্য মাপকাঠির নিরিখে ভারতবর্ষের প্রথম পাঁচ রাজ্যের মধ্যে রয়েছে । সাম্প্রতিক জননী ও শিশু সুরক্ষা বা শিশু সাথী প্রকল্পের মত সরকারী উদ্যোগ শিশু মৃত্যু রোধে বিশেষ অবদান রেখেছে। বর্তমানে ৫ বছরের নিচে শিশুদের মৃত্যু হার পশ্চিমবঙ্গে ২৫.৪, আর এস ডি জি তে ২০৩০ সাল অবধি যে লক্ষ্য মাত্রা টা হল ২৫। সুন্দরবনে জলে ডুবে শিশু মৃত্যু বন্ধ হলে ২০৩০ এর অনেক আগেই আমরা এই লক্ষমাত্রা মাত্রা অর্জন করতে পারব।

    বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি বছর ২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ জলে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। এদের মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর সংখ্যা কপালে ভাঁজ ফেলার মতো বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও চিন্তার বিষয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অধিকর্তা পুনম ক্ষেত্রপাল সিংহের মতে, এত মানুষের মৃত্যু সত্ত্বেও জলমগ্ন এলাকার পরিস্থিতি ও মৃত্যু নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। এই বছরেই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ‘জলে ডুবে শিশু মৃত্যু’ — একটি ভয়াবহ আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। জাতি সংঘের ১৯৩ টি সদস্য রাস্ট্র এই সমস্যাটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ-বছরের ২৫শে জুলাই, রবিবারে প্রথম ‘ আন্তর্জাতিক জলে ডুবে মৃত্যু বিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে সাধারণ পরিষদ।

    মনুমেন্টের মাথা পেরিয়ে সূর্যের আলো গড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমদিকে। প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক বৈঠক শেষ হবার পর মোমবাতি মিছিল এ যোগ দেয়া শিশুদের চোখেমুখে যেন দিন শেষের মায়াবী কমলা আলোর যাদু আভা। সেই গোধূলির উদ্ভাসিত আলোয় শপথ নিল এক নতুন অঙ্গীকার। ভোট দেওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও, সাথীর মতো অসংখ্য শিশু, কিশোর-কিশোরীর হাত ধরেই আগামী প্রজন্ম স্বপ্ন দেখতে শিখবে ।স্বপ্ন গুলো বাস্তবায়ন করার পথে এক পা ,দু পা করে সাহসী পদক্ষেপ করবে। সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিশ্রুতি পালনে এগিয়ে যাবে নতুন করে। এক বুক সাহস নিয়ে আজ অন্য ধরণের পথ চলা শুরু হ’ল। নরম মোম বাতির আলোয় সেই সব হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট প্রাণের প্রতি স্নেহ আর ভালোবাসা জানাতে গিয়ে অজান্তেই ভিজে উঠল চোখের কোণ। ছোট্ট প্রাণ গুলো আগলে রাখার দায়িত্ব ছিল আমাদেরই। আমাদের অপারগতায় ওরা হারিয়ে গেল অকালে। আজকের পর এমন মোম যেন আর কখনও না জ্বালতে হয়। বরং দুহাতের আগলে রাখা যত্নে, ছোট্ট প্রাণ গুলো সূর্যের মত আলো ছড়াক। অস্তাচল নয় … স্বপ্ন বুনতে থাক ‘উদয়ের পথ।’