সংখ্যালঘু শিক্ষা আন্দোলনের নক্ষত্র পতন – শাহাবুদ্দিন গাইন।

মনোয়ার হোসেন : পশ্চিমবাংলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্ব – উদ্যোগে যে কটি আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার মধ্যে আল হিলাল মিশন অন্যতম একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

    উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরের কদম্বগাছি গ্রামে উক্ত মহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছে। যার প্রাণপুরুষ ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শাহাবুদ্দিন গাইন মহাশয়।
    ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে শাহাবুদ্দিন গাইন সাহেব পিছিয়ে পড়া উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন । নিজে একজন বড় সরকারি চাকুরীজীবী ছিলেন কিন্তু শুধু নিজের ভালো ও সচ্ছলতা নিয়ে ক্ষান্ত ছিলেন না, স্বপ্ন দেখতেন উত্তর চব্বিশ পরগনায় একটি আদর্শ মিশন অর্থাৎ আল আমিন মিশনের অনুরূপ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। যেমন চিন্তা তেমনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, মিশন গড়ে তুললেন দ্রুততার সাথে এবং ছাত্র ভর্তি হলো কিন্তু এত খরচা ব্যয় ভার বহন করবে কে? চলল কঠিন সংগ্রাম, দিন নাই রাত নাই কয়েকজন সংগ্রামী সাথী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ চষে বেড়ালেন অর্থের জন্য। এ এক কঠিন লড়াই! ছাত্র তো ভর্তি হলো কিন্তু সেই ছাত্রদের ভরণ পোষণ ও তার ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ে! যত দিন যায় ছাত্র – ছাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, ছাত্র-ছাত্রী উভয়ের আলাদা আলাদা ক্যাম্পাস গঠন করেন। জেলার বাইরে শাখা গড়তে হয় ছাত্র-ছাত্রীদের চাপে। লড়াই আরো কঠিন হয়ে পড়ে।
    নিজের ইচ্ছাশক্তি ও মানসিক জোরে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে চলেন নিজের কাঁধের উপর ভর করে। সঙ্গে পেয়েছিলেন কিছু নওজোয়ান ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ও শিক্ষকদের, কোন সময় ভেঙ্গে পড়েন নি লড়াইয়ের ময়দান থেকে!

    সমগ্র বিশ্বজুড়ে এবং এই উপমহাদেশেও অতিমারির আক্রমণে স্তব্ধ হয়ে যায় সব প্রতিষ্ঠানগুলি। দু’বছর বন্ধ থাকার পর আবার নতুন করে লড়াই শুরু করতে হয় কর্মবীর শাহাবুদ্দিন গাইন সাহেবকে।

    ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান শহরে একদিন আমার বাড়িতে উপস্থিত হন শাহাবুদ্দিন গাইন সাহেব, তিনি বিভিন্ন জেলার সাথে বর্ধমান জেলাতেও ছাত্র ভর্তির জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন! উনার সাথে দীর্ঘক্ষণ সংখ্যালঘু পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের বিষয়ে আলোচনা হলো, উনি আমাকে আন্তরিকভাবে আল হিলাল মিশন পরিদর্শন করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। উনি দীর্ঘ আলোচনার পর আমার সাথে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করে কলকাতা ফিরে গেলেন।
    ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে আমি একদিন অতর্কিতে কদম্বগাছি আল হিলাল মিশন পরিদর্শনে গেলাম। সেই প্রথম আল হিলাল মিশন পরিদর্শন করলাম ।শাহাবুদ্দিন গায়েন সাহেব ছিলেন না, প্রধান শিক্ষক ও বিভিন্ন কর্মকর্তা ঘুরিয়ে দেখালেন মিশন ক্যাম্পাস। ইতিমধ্যে শাহাবুদ্দিন সাহেব ফোন করে জানালেন উনি ফিরছেন আমি যেন আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। অবশেষে উনি উপস্থিত হলেন এবং আমাদের সাথে কিছুটা সময় অতিবাহিত করে আমরা বর্ধমান ফিরে এলাম।
    ২০০৫ ও ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী আল হিলাল মিশনে ভর্তি করেছিলাম। প্রতিবছর আল হিলাল মিশনের একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিতাম বর্ধমান শহরে এবং বর্ধমানের খণ্ডঘোষ ও গলসি থানায় একটি করে পরীক্ষার সেন্টার এছাড়াও পূর্বস্থলী ও কাটোয়া কালনা থানায় পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিতাম। শাহাবুদ্দিন সাহেব প্রতিবছর নিয়মিতভাবে বর্ধমান আসতেন। প্রতিবারই সাক্ষাৎ হতো এবং শিক্ষা নিয়ে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে তার আবেগের কথা শোনাতেন, তার ভিতর থেকে জাতির প্রতি কর্তব্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের কথা ভুলে গেলে হবে না।

    ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে আমার শশুর মশাই নাসরে আলম সাহেব বারাসত ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে ভর্তি হলেন এবং ওখানেই তার ইন্তেকাল হয়, সেই সময় শাহাবুদ্দিন গাইন সাহেব তার কর্মকর্তাগণ জানতে পেরেই ক্ষনিকের মধ্যে উপস্থিত হন এবং আমার শ্বশুরমশায়ের মৃতদেহ বর্ধমান নিয়ে আসার জন্য সব রকম সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন যা আমি কোনদিনই ভুলবো না।

    অবশেষে গত ৪ ডিসেম্বর বৈকাল ৩ ঘটিকায় আল হিলাল মিশনের কোচবিহার ব্রাঞ্চে কর্মবীর শিক্ষা প্রেমি ও শিক্ষা অনুরাগী শাহাবুদ্দিন গায়েন সাহেবর দৌড় শেষ হয় অর্থাৎ ইন্তেকাল ( ইহলোক ত্যাগ করে পরলোক গমন )করেন । আগামী ৬ ডিসেম্বর শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর দুটো ত্রিশ মিনিটে উত্তর 24 পরগনার কদম্বোগাছি আল হিলাল মিশনে জানাজার দোয়া সম্পন্ন হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ জান্নাত দান করুন আমীন।