সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কলম ধরলেন চিন্ময় বসু। 

আজ থেকে একশো বছর আগে ১৯২১ সালের ২ রা মে এক নক্ষত্রের জন্ম হয়েছিল। কলকাতার গড়পাড় রোডে সুকুমার রায়ের একমাত্র পুত্র সত্যজিৎ রায় সেদিন জন্মেছিলেন। ওনার জন্ম হয়েছিল বাংলার প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে। জন্মের পরে প্রথমে ওনার নাম রাখা হয়েছিল প্রসাদ এবং ডাকনাম মানিক। শোনা যায় যে সুকুমার রায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুরোধ করেছিলেন তার পুত্রের নামকরণের জন্য এবং উনি নাম দিয়েছিলেন সরিৎ এবং ডাকনাম সহজ। কিন্তু সেই নাম রাখা হয় নি। দুই বছর বয়েসে আনুষ্ঠানিক ভাবে নামকরণ করা হয় সত্যজিৎ। ‘যখন ছোট ছিলাম’  বইতে সেই নামকরণের দলিলটি ছাপা হয়েছিল এবং সেখানে ডক্টর কাদম্বিনী দেবী র সইও রয়েছে।
উপেন্দ্রকিশোর রায়ের পৌত্র এবং সুকুমার রায়ের পুত্র হয়ে উনি সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু সেই ‘চামচ’ বেশিদিন ওনার মুখে থাকেনি। সকলেই জানেন যে ওনার জন্মের আড়াই বছরের মধ্যেই পিতা সুকুমার রায়ের মৃত্যু হয় এবং ওনাদের পারিবারিক ব্যাবসা টি ও উঠে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই সেই গড়পাড়ের বাড়িটিও রায় পরিবারকে ছাড়তে হয়। মাতা সুপ্রভা দেবীর সাথে দক্ষিণ কলকাতায় এক মামার বাড়িতে গিয়ে ওনাকে উঠতে হয়েছিল। ওনার মাকে তখন একটি কাজও নিতে হয়েছিল, সংসারের খরচ চালাতে।
এইসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উনি সত্যজিৎ রায়কে যথাযথ ভাবে মানুষ করেন, ওনার মত মা ছিলেন বলেই সত্যজিৎ রায়ের প্রতিভা বিকশিত পেতে পেরেছিল একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
কলেজের পড়া শেষ করে উনি চলে যান শান্তিনিকেতনের কলা ভবনে অঙ্কন শিক্ষার জন্য এবং বলা যায় সেখান থেকেই ওনার জীবনের এক নতুন এবং মূল অধ্যায় শুরু হয়।
অবশ্য সেই একটা কথা আছে না…….. মর্নিং শোজ দ্য ডে, সেরকমই খুব অল্প বয়স থেকেই সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে বিভিন্ন মেধার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের পিসতুতো দিদি নলিনী দাশ, যিনি পরিচিত ছিলেন ‘নিনিদিদি’ হিসাবে, ওনার লেখা বই সত্যজিতের ছেলেবেলা (বইটি র প্রথম নাম অবশ্য ছিল ‘সাত রাজার ধন এক মানিক’) তে সেই সমস্ত বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই মানিক বাবু ফটো তোলা শুরু করেন, আর তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই  ‘বয়েজ ওন পেপার’ এর মতন বিখ্যাত বিলিতি পত্রিকায় ফটোগ্রাফির জন্য প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন।
উনি এই প্রসঙ্গে বলেছেন যে সবার সাথে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় মাত্র বারো-তেরো বছর বয়েসেই সাধারন বক্স ক্যামেরা দিয়ে অনেক অসাধারন সব ফটো তুলেছিলেন। সেই সময় বিহারের দ্বারভাঙ্গা তে নৌকা থেকে ঘর্ঘরা নদীর উপর রেলব্রিজের এক অসাধারণ  ছবি তুলেছিলেন।মাত্র দশ বছর বয়সে সাধারণ বক্স ক্যামেরা দিয়ে।

    (ছবিটি নলিনী দাশের বই থেকে নেওয়া।)

    আরেকটি মজার ঘটনার উল্লেখ ওনার লেখাতেই পাওয়া যায়- নলিনী দেবী যখন কলেজে পড়তেন তখন সত্যজিৎ পড়তেন ক্লাস এইটে। একবার কলেজের এক অধ্যাপককে দেবার জন্য ওনাকে একটি মানপত্র তৈরি করে আনতে বলা হয়েছিল। তা উনি ওনার ভাই সত্যজিৎ রায়কে দায়িত্ব দিলেন। বললেন, একটি মানপত্র ভালো করে বানিয়ে দিতে এবং যথারীতি সত্যজিৎ রায় অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে সেই মানপত্র তৈরি করে দিলেন। কিন্তু সেই মানপত্র পরেরদিন কলেজে নিয়ে যেতেই নলিনী দেবীর কপালে জুটল তিরস্কার। কারন হিসেবে প্রফেসর বললেন যে, তোমায় বলা হয়েছিল যে, নিজে যেরকম পারবে সেরকম বানাতে। কোন পেশাদার শিল্পী এবং লেখক কে দিয়ে মানপত্র বানিয়ে নিয়ে আসতে কখনোই বলা হয় নি। নলিনী দেবী কিছুতেই শিক্ষককে বোঝাতে পারছিলেন না যে, সেই মানপত্রটি তার ক্লাস এইটে পড়া ভাই বানিয়ে দিয়েছে! এইভাবেই সহজাত প্রতিভা নিয়ে বড় হয়ে উঠেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
    এরপর শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসু এবং বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়কে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন সে কথা বহুবার আলোচিত হয়েছে। শান্তিনিকেতনের পাঠ অসম্পূর্ণ রেখেই কলকাতায় এসে বিজ্ঞাপন সংস্থা তে কর্মজীবন শুরু করেন। বেশি ডিটেইলস গেলে লেখা আর শেষ হবে না।  তাই বলি যে কাজের সূত্রে লন্ডনে গিয়ে ‘বাইসাইকেল থিফ’ দেখার পরেই চিত্রপরিচালক হবার বাসনা তীব্র হয় এবং দেশে ফিরে কতখানি সংগ্রাম করে প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী ‘ শেষ করেন তা আজ এক ইতিহাস।…………..

    সংবাদ সৌজন্যে :বার্তা সাম্প্রতিক
    http://bartasamprotik.blogspot.com/2020/05/blog-post_2.html