চিত্রনায়িকা ববিতার জন্য ঈদের আয়োজন করেছিলেন সৌমিত্র


নতুন গতি বিনোদন ব্যুরো :বাংলা চলচ্চিত্রের একজন অভিভাবক তিনি, এক বিশাল বটবৃক্ষ, তার তলায় বিরাজ করছে বর্তমান বাংলা সিনেমার জগৎ’ – পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশি অভিনেত্রী ফরিদা আক্তার পপি, দর্শকদের কাছে যিনি ববিতা নামেই পরিচিত। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি এই অভিনেতা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫।

     

    সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ১৯৭৩ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অনঙ্গ বউ চরিত্রে অভিনয় করেছেন ববিতা। ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অভিনয় করতে তারা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের শান্তি নিকেতনে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘তখন তো আমি খুব ছোট ছিলাম। আমার বয়স ছিল ১৫/১৬ বছর। সৌমিত্রদা সম্পর্কে আমি খুব একটা জানতাম না। অপুর সংসার ছবিটি দেখে গেছি। তার আগে আমি একটি মাত্র ছবি করেছি ঢাকায়। তখনও পর্যন্ত চলচ্চিত্রে আমার অভিজ্ঞতা ছিল খুব কম।’

     

    সেটাই ছিল ববিতার প্রথম বিদেশে যাওয়া। এবং ভারতে শুটিং করতে যাবেন বলেই তার পাসপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল। তার ভাষায়, ‘এই প্রথম আমি বিদেশ কোথাও যাচ্ছি। সেসময় খুব ভয় পেয়েছিলাম। এক তো হল মানিকদার (সত্যজিৎ রায়) ছবিতে অভিনয় করছি। তার পর এতো বড় একজন অভিনেতা সৌমিত্রদার সঙ্গে কাজ করছি। আমি পারবো কি পারব না! ওনাকে দেখলাম গঙ্গাচরণ চরিত্রের পোশাক পরা- ধুতি পরা। গোল গোল চশমা। আমি দাঁড়িয়ে আছি। ওনার সঙ্গে আমি শট দিলাম। তার পর উনি বললেন, বাহ তুমি তো খুব সুন্দর শট দিয়েছ! খুব সুন্দর!’


    ববিতা বলেন, সৌমিত্রর সেই প্রশংসা তাকে তখন সাহস যুগিয়েছিল। এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি তাকে আপন করে নিয়েছিলেন, ‘ওনাকে দেখেছি শুটিং এর অবসরে, যখন সবকিছুর আয়োজন করা হচ্ছে, উনি হয়তো বসে বসে কবিতা আবৃত্তি করছেন। আবার দেখতাম তিনি শরীর চর্চা করছেন। এটা দেখে আমার খুব মজা লেগেছে।’

     

    অশনি সংকেত ছবির একটি দৃশ্যের প্রসঙ্গ তুলে ববিতা বলেন, ‘একটি দৃশ্য না বললেই নয়। আমি স্নান করে এসে দাঁড়িয়ে আছি। আর সৌমিত্রদা পা ধুচ্ছেন। একটি ট্রলি শট হবে। শটটি এরকম- আমি হেঁটে হেঁটে আসবো। এসে সৌমিত্রদার দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে আমি ওনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বো। এবং চোখের জল টসটস করে পড়বে।’

     

    সেসময় সত্যজিৎ রায় ববিতাকে বললেন, গ্লিসারিন ব্যবহার না করে তাকে সত্যি সত্যি কেঁদে দেখাতে হবে। কিংবদন্তি পরিচালক তাকে বলেন, ‘দেখবো তুমি কেমন শট দিতে পারো। কেমন অভিনেত্রী তুমি দেখবো! তার পর আমি হেঁটে হেঁটে সৌমিত্রদার বুকের ওপর এসে পড়লাম এবং ঠিক জায়গা মতো চোখের অশ্রুটাও পড়লো। তখন সৌমিত্রদা, মানিকদাসহ সবাই হাততালি দিয়ে উঠলেন। বললেন, বাহ খুব অপূর্ব শট হয়েছে, অপূর্ব শট হয়েছে।’

     

    ববিতা জানালেন, শুটিং এর কোন একদিন তিনি কাঁদছিলেন। কারণ সেদিন ছিল ঈদ। আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করার আনন্দের কথা মনে করে তার চোখ ছলছল করছিল। তারপরের ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘সৌমিত্রদা সেটা খেয়াল করেছেন- কী ববিতা, তোমার চোখ ছল ছল করছে কেন, কী হয়েছে তোমার? আমি বললাম সৌমিত্রদা আজকে তো আমাদের ঈদ, আমি আজকে শুটিং করছি, তাই একটু মনটা খারাপ লাগছে। তখন উনি বললেন যে মোটেও ভেবো না, দেখ আমরা কী করি।’

     

    সেদিন সন্ধ্যার সময় ববিতা দেখলেন তার জন্য ঈদের আয়োজন করা হয়েছে, ‘আমরা গেস্ট হাউজের যে রুমে ছিলাম সেখানে দেখি সন্ধ্যার সময় বাজি পটকা ফাটানো হচ্ছে, তারাবাতি জ্বালানো হয়েছে। বাবুর্চিকে বলা হয়েছে সেমাই পাকাতে। তিনি বললেন এই দেখ আমরা ঈদ করছি।’

     

    অশনি সঙ্কেত ছবিটি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বিয়ার পুরস্কার পায়। সেখানে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ববিতাও উপস্থিত ছিলেন। অশনি সংকেত ছবির সূত্রেই সৌমিত্র্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিল প্রথম পরিচয়। এর পরে তারা দুজন একসঙ্গে কোন ছবিতে অভিনয় না করলেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল বলে ববিতা জানান।

     

    তিনি বলেন, ‘সৌমিত্রদার সঙ্গে আমার যেন একটা আত্মার সম্পর্ক। আমি যখনই গেছি, তিনি হয়তো কলকাতায় কোন ছবির শুটিং করছেন, আমি বললাম যে দাদা আপনাদেরকে দেখার জন্য এলাম। তিনি ঠাট্টা করে বললেন, কী ববিতা শুনলাম তুমি নাকি বাংলাদেশে প্রচুর ছবি করছ। তুমি নাকি ইদানীং খুব পুরস্কার টুরস্কার পাচ্ছো! অবশ্য আমরা জানতাম। তুমি যখন অশনি সঙ্কেত করেছ তখনই বুঝতে পেরেছি তুমি আসলে একদিন অনেক বড় হবে।’