সুস্থ সংস্কৃতি সুস্থ সমাজ

সুস্থ সংস্কৃতি সুস্থ সমাজ

    নতুন গতির পাঠকের কলমে 

    মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানুষের জীবনকে করে তোলে সুন্দর, সুচারু, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত। আর এই সংস্কৃতি যদি হয় সুস্থ ও সবল ধারার, তবে তার জীবনটা হবে সফল। সুস্থ ধারার সংস্কৃতির উৎস হলো ইসলাম। আর এর মূলে রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ। ইসলামী সংস্কৃতি ছাড়া অন্য কোন সংস্কৃতি সুস্থ ধারার সংস্কৃতি নয়। ইসলামী সংস্কৃতি হচ্ছে একটি মানবতাবাদী সংস্কৃতি। অন্যদিকে আধুনিক সংস্কৃতির মূলে রয়েছে ধর্মহীনতা, বেহায়াপনা ও উলঙ্গপনা, এতে নেই কোন মানবিকতা, নৈতিকতা ও শালীনতা।

    সংস্কৃতির পরিচয়

    “সংস্কৃতি” শব্দটি মূলত সংস্কৃত ভাষার শব্দ। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো “কালচার ” যার অর্থ কর্ষণ করা। আর আরবী প্রতিশব্দ হলো “আস সাকাফাহ।” সাকাফাহ শব্দের অর্থ উপলব্ধি করা, জানা ও প্রশিক্ষণ পাওয়া। পরিশীলিত, প্রশিক্ষিত, মার্জিত ও রুচিশীল ব্যক্তিকে বলা হয় ‘‘মুসাক্কাফ’’ বা সংস্কৃতিবান। আর সংস্কৃতি শব্দটি গঠিত হয়েছে “সংস্কার” শব্দ থেকে । যার অর্থ শুদ্ধি, পরিমার্জন, মেরামত, ভূল সংশোধন। সুতরাং সংস্কৃতি অর্থ হলো সংস্করণ, বিশুদ্ধকরণ, অনুশীলনলব্ধ দেহ, মন ও আত্মার উৎকর্ষ সাধন।

    পরিভাষায় : বিশ্বাসলব্ধ মূল্যবোধে উদ্ভাসিত, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত মন-মানসিকতাকেই সংস্কৃতি বলা হয়। সমাজ বিজ্ঞানীদের ভাষায় সংস্কৃতি হলো জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নিয়ম-নীতি, সংস্কার ও অন্যান্য দক্ষতা যা মানুষ সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জন করে। অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো মানুষের আচরণের সমষ্টি।

    আমরা বহু সংস্কৃতির মাঝে বসবাস করি। জাতিভেদে, দেশভেদে সংস্কৃতির ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। সব সংস্কৃতি পরিমার্জিত ও পরিশীলিত নয়। সুস্থ সমাজ গঠনে পরিশুদ্ধ ও সুস্থ সংস্কৃতির প্রয়োজন। সুস্থ সংস্কৃতিই সুস্থ সমাজ গড়তে পারে। তবে বর্তমানে সব সংস্কৃতির উপর আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ব্যপক বিস্তার করেছে। যার মূলে রয়েছে বেহায়পনা ও অশ্লীলতা। আধুনিকতার নামে আমাদের সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নিয়েছে। যার ফলে সমাজ ধংসের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে।
    নিম্নে মূলত দুটি সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করব।
    ইসলামি সংস্কৃতি ও আধুনিক সংস্কৃতি।

    ইসলামী সংস্কৃতি

    ইসলামী সংস্কৃতি হলো ইসলামের মূলনীতির উপর ভিত্তি করে মানুষ তার আচার-ব্যবহার, দেহ, মন ও আত্মাকে যেভাবে সংস্কার ও সংশোধন করে, তাই ইসলামী সংস্কৃতি। অর্থাৎ এ হলো এমন এক জীবন পদ্ধতি যা মুসলমানগণ প্রতিনিয়ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী দৃষ্টি ভঙ্গি ও জীবনাদর্শের আলোকে অবলম্বন করছে । চাই তা সামাজিক জীবনের বৈষয়িক ক্ষেত্রেই হোক কিংবা ধর্মীয় ক্ষেত্রে।

    ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তি

    ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তি হলো কুরআন ও সুন্নাহ। সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ বহির্ভূত কোন সংস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতি বলা যাবে না। ইসলামী সংস্কৃতি কোন ভাবেই কুরআন-সুন্নাহ বহির্ভূত সংস্কৃতি গ্রহণ করেনা। ইসলামী সংস্কৃতি কুরআন-সুন্নাহ বর্ণিত উৎসব ব্যতিত অন্য কোন উৎসব গ্রহণ করেনা। যেমন মুসলমানদের উৎসব মাত্র দু’টি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ইসলামী সংস্কৃতি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী এক থাকে কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়না।

    ইসলামী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য

    ইসলামী সংস্কৃতি মহান আল্লাহর তাওহীদ ভিত্তিক সংস্কৃতি ইসলামী সংস্কৃতির মূলনীতি ও মূল্যবোধ বিশুদ্ধ, যথার্থ, মহান ও সার্বজনীন। অর্থাৎ এটি এমন এক সংস্কৃতি যার মূলনীতি এতই বিশুদ্ধ যাতে সন্দেহ সংশয়ের কোন অবকাশ নেই। আর এটি এমন একটি সার্বজনীন সংস্কৃতি যা কোন দেশ, জাতি, ভাষা, বর্ণে সীমাবদ্ধ নয়।

    এই সংস্কৃতি সকল প্রকার ত্রুটি থেকে মুক্ত এবং বিবেক ও জ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ইসলামী সংস্কৃতি একটি মানবতাবাদী সংস্কৃতি। এতে রয়েছে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা।

    মহান আল্লাহর বাণী “নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে মর্যাদার দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ, যে তোমাদের মধ্যে খোদাভীরু” (সূরা হুজরাত : ১৩)
    রাসূল (সা.) বলেন, মানব চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি ।

    ইসলামী সংস্কৃতি একজন মুসলমানকে আনুগত্যশীল করে তোলে। সে আরো বেশি রাসূল (সা.) এর সহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী তার জীবন পরিচালনা করতে তৎপর হয়।

    এটি এমন এক সংস্কৃতি যাতে রয়েছে মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ। হাদীসে বর্ণিত আছে, হজরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থানের (জিহবার) এবং দুই রানের মধ্যবর্তী স্থানের (লজ্জাস্থানের) জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো। (সহীহ বুখারী : ২১০৯)

    ইসলামী সংস্কৃতি নৈতিকতা সমৃদ্ধ এবং মানুষের ধর্ম কর্মের সমন্বয়ক।

    আধুনিক সংস্কৃতি

    আধুনিক সংস্কৃতি বলতে মূলত পশ্চিমা সংস্কৃতিকেই বুঝায়। যাতে কোন ধর্মের ছোঁয়া নেই, নেই কোন নৈতিকতা, মানবিকতা ও শালীনতা। এতে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর নির্দেশ পালন করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এটি একটি উলঙ্গপনা (Free sex) সংস্কৃতি।

    আধুনিক সংস্কৃতির ভিত্তি

    আধুনিক সংস্কৃতির ভিত্তি হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ খৃষ্টবাদ, ইহুদিবাদ, পুঁজিবাদ ও অন্যান্য পার্থিব মতবাদ। যার মূল উদ্দেশ্য হলো ধর্মহীনতা। এই সংস্কৃতির মূল কথা হচ্ছে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে নির্বিচারে গ্রহণ করা এবং যারা এর বিপরীতে দাঁড়ায় তাদেরকে অসভ্য ও পশ্চাতপদ গণ্য করা।

    আধুনিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য

    আধুনিক সংস্কৃতি মূলত একটি ধর্মহীন সংস্কৃতি । যা মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে নষ্ট করে দেয়। ফলশ্রুতিতে সে তার ধর্ম থেকে দূরে সরে যায় এবং এটি মুসলমানদেরকে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূল (সা.) এর অনুসরণ থেকে বিমুখ করে।

    আধুনিক সংস্কৃতির মধ্যে জীবনের দৃশ্যমান ও আনুভূতিক শিল্পময় প্রকাশ লক্ষ করা যায়। আর এতে লাগামহীন জীবন যাপনের উলঙ্গতাকে নানাভাবে বর্ণময় করার চেষ্টা দেখা যায়।

    আধুনিক সংস্কৃতি বিভিন্ন উৎসব সাদরে গ্রহণ করে নেয়, ইসলামে যার কোন ভিত্তি নেই। যেমন- শবে বরাত, থার্টি ফাস্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইন ডে, এপ্রিল ফুল, বিবাহ বার্ষিকী, জন্ম দিন, গায়ে হলুদ উৎসব, মহররম উৎসব ইত্যাদি।

    আধুনিক সংস্কৃতি বংশানুক্রমে অতিবাহিত হতে থাকে। বংশানুক্রমে তার ধারা বজায় থাকে।

    আধুনিক সংস্কৃতি একটি প্রতিযোগিতা মূলক সংস্কৃতি। যার কারণে এর ধারা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন হয় এবং এটি বিশ্বে আলোচিত অনেক কিছু সাদরে আপন করে নেয়।

    আধুনিক সংস্কৃতি মুসলমানদের ঈমানী চেতনাকে নষ্ট করে দেয়। যার কারণে সে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর আনুগত্য থেকে দূরে সরে যায়। আর অন্য দিকে ইসলামী সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে কেবল আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর উপর নিঃশংসয়ভাবে বিশ্বাসী মুমিনদের জীবন যাপনকে কেন্দ্র করে। যেখানে অবিশ্বাসী হওয়ার বা কুরআন- হাদীস অনুসৃত জীবন যাপনের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। অন্য জাতির সংস্কৃতি গ্রহণ করার ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন,“যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য ধারণ করলো সে তাদেরই দলভুক্ত হলো।” (সুনানে আবু দাউদ :৪০৩১)

    আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন, তিন প্রকারের লোক আল্লাহর কাছে সর্বাধিক ঘৃণিত, ১. হারাম শরীফের পবিত্রতা বিনষ্টকারী, ২. ইসলামে বিজাতীয় রীতি-নীতির (সংস্কৃতির) প্রচলন কারী, ৩. কোন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যার প্রচেষ্টাকারী। (বুখারি)

    উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতিয়মান হয় যে, সুস্থ সমাজ গঠনে ইসলামি সংস্কৃতির বিকল্প কোন সংস্কৃতি নেই। বর্তমান সময়ে আমরা যে সংস্কৃতিকে আমাদের প্রকৃত সংস্কৃতি বলে মনে করি অর্থাৎ ইসলামী সংস্কৃতি বলে মনে করি তা আসলে ইসলাম তথা কুরআন-সুন্নাহ স্বীকৃত সংস্কৃতি নয়। এর অর্থ হলো আমরা মুসলিম জাতি বিশ্বে আজ যে সংস্কৃতিতে নিজেদের আপন করে নিয়েছি , তা হয়তো খ্রিস্টিয় সংস্কৃতি অথবা ইউরোপিয় ও আমেরিকান সংস্কৃতি তথা মানুষের মনগড়া মতাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি। অন্যদিকে কেউ কেউ এই সংস্কৃতি পালন করে আলট্রা মডার্ণ (অত্যাধুনিক) হওয়ার জন্য। এবং নিজেকে আধুনিকতাবাদী হিসাবে প্রকাশ করতে।

    আজ অধিকাংশ মুসলমানগণ যে সংস্কৃতি লালন করছে তা ইসলাম স্বীকৃত সংস্কৃতি নয়। মুসলমানদের সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, যেগুলো হলো অসুস্থ ধারার সংস্কৃতি। ইসলামী সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য প্রস্তুত করা। আর এই সফলতা আসবে বর্তমান জীবনে মানুষের নির্ভুল আচরণের মাধ্যমে। এই সংস্কৃতি এমন একটি নির্ভুল সমাজ কায়েম করতে চায়, যা হবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ। এর জন্য প্রয়োজন ইসলামি সংস্কৃতির নিজ জীবনে বাস্তবায়ন ।

    তাই আসুন আমরা মুসলিম হিসেবে আমাদের যে সংস্কৃতি গ্রহণ করা প্রয়োজন তাই আমরা লালন করবো। আর সেই সংস্কৃতি হলো ইসলামী সংস্কৃতি । তাহলে আমাদের সমাজ থেকে অন্যায়-অশ্লীলতা দূর হবে এবং সমাজে আমরা সুন্দর ও সুস্থভাবে জীবন যাপন করতে পারবো। আল্লাহ আমাদেরকে এই ধরনের সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার তাওফীক দান করুন। আমীন !

    লিখেছেন মোবারক মন্ডল করিমপুর , নদীয়া থেকে