|
---|
বিশেষ প্রতিবেদন: এই ফিল্ড রিপোর্টটি, ১৬ই মে ২০২০ তারিখে “দ্য ওয়্যার” অনলাইন নিউজ পোর্টালে সাংবাদিক হিমাদ্রি ঘোষের কলমে ইংরেজিভাষায় লিখিত এবং প্রকাশিত সংবাদের বাংলা অনুবাদ। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ যে এই অনুবাদটি প্রকাশ করছে তার উদ্দেশ্য দুটি – সত্যের প্রকাশ এবং শান্তিপ্রিয় বাংলাবাসীর সামনে একটা বড়সড় সামাজিক সঙ্কটের কথা সোজাসুজি তুলে ধরা।
কী সেই সঙ্কট? ইদানীং আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার লক্ষ্যে বিশেষ এক রাজনৈতিক লুঠেরাবাহিনী তাদের পরিকল্পিত আক্রমণ সাজিয়ে বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভয়ের আবহাওয়া সৃষ্টি করতে চাইছে। বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের লোকেদের তারা টার্গেট করছে, খুন করার চেষ্টা করছে, বাড়ি ভাঙছে, সম্পত্তি লুঠ করছে এবং শেষে আবার এই পুরো চক্রান্তের রং বদলে, ধর্মীয় উস্কানিভরা গুজব ছড়িয়ে, আহত, আক্রান্ত সম্প্রদায়কেই আক্রমণকারী বলে দোষারোপ করছে – আরো বড় আগুন রাজ্যে ছড়ানোর জন্য। এহেন যাবতীয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক কার্যকলাপ যা সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে, সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে, সন্দেহের বিষে আমাদের সহজ সহাবস্থানকে বিঘ্নিত করে (দাঙ্গার প্ররোচনা দিয়ে আমাদের রুটি-রুজি কেড়ে নেয়) এবং আসলে আমাদের আরো বেশি করে অন্ধকারে ঠেলে দেয়, এই অনুবাদ তার মিথ্যের মুখোশ খুলে আসল হিংস্র মুখটা প্রকাশ করার সদিচ্ছা। ঘটনাস্থল থেকে, কী ঘটেছে তারই সরাসরি বিবরণ। সেই সাথে এটি একটি সতর্কবার্তা বাংলার সাধারণ মানুষের প্রতি – সচেতন থাকুন, সতর্ক থাকুন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানিদাতাদের দূর করে দিয়ে সুরক্ষিত থাকুন। পরের অংশে আমরা সোজা চলে আসি ইংরেজি রিপোর্টের অনুবাদে।]
ঘটনাস্থল তেলিনিপাড়া। হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বর শহরের লাগোয়া এক ছোট্ট জনপদ। সারা পৃথিবী যখন নোভেল করোনা ভাইরাস নিয়ে নাজেহাল এবং যুদ্ধে ব্যস্ত, কলকাতার থেকে ৪০ কিমি উত্তরে এই মফস্বল শহর তখন লড়াই দেখেছে সাম্প্রদায়িক টানাপোড়েনের। গত ১২ই মে থেকে সেই জনপদ আতঙ্কে কাঁটা হয়ে আছে।
তেলিনিপাড়া, গঙ্গা নদীর পশ্চিমপাড়ে একদা পাট প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য পরিচিত এক মফস্বল। হুগলী সংসদীয় ক্ষেত্রের অন্তর্গত। গত ১০ই মে, রবিবার, বিকেলে এলাকায় প্রথম কিছু তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি হয় দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের, যা পুলিশি মধ্যস্থতায় শেষমেশ মিটেও যায়। ১১ই মে, সোমবার, ছিল নির্ঝঞ্ঝাট। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে গেল ১২ই মে, মঙ্গলবার থেকে। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে, হঠাৎ এলাকায় দলে দলে ভিড় বাড়াতে দেখা যায় কিছু লোককে, তাদের মাধ্যমেই শুরু হয়ে যায় সুপরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আক্রমণ। একতরফা সেই হামলায় এলাকা নিমেষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরিস্থিতির বিপদ বুঝে জেলাশাসক সেদিনই এলাকায় জারি করেন ১৪৪ ধারা, তড়িঘড়ি ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করা হয় পার্শ্ববর্তী দুই মহকুমা শ্রীরামপুর এবং চন্দননগরের সাথে। এই দুই মহকুমার মাঝবরাবরই ভদ্রেশ্বর এবং তেলিনিপাড়ার অবস্থান।
১৫ই মে বৃহস্পতিবার, ‘দ্য ওয়্যার’ এর সংবাদ প্রতিনিধি সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন আক্রান্ত এলাকা। কলকাতা থেকে গ্র্যান্ড টাঙ্ক (জিটি রোড) রোড বরাবর এগিয়ে এলাকায় পৌঁছোনোর পথেই ভদ্রেশ্বরের বাবুবাজার মোড়ে নজরে পড়ে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত দোকান। এরপরেই ডানদিকে বেঁকে রাস্তা গেছে তেলিনিপাড়ার দিকে। আধপোড়া কয়লা হয়ে যাওয়া দোকানের নামফলকে “সাদ” শব্দটি তখনও স্পষ্ট পড়া যায় (অর্থাৎ কোনো মুসলিম দোকানীর বিপনী এটি)। ভদ্রেশ্বর ফায়ার ব্রিগেডের উল্টোদিকেই নজরে আসে ভাঙচুরে লণ্ডভণ্ড একটি মাজার (মুসলিম সমাধিসৌধ এবং প্রার্থনাস্থল), রাস্তা থেকেই দিব্যি নজরে আসে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকা ইঁট, প্লাস্টার, টাইলস আর ছিন্নভিন্ন করে মেঝেতে ছড়িয়ে দেওয়া মুসলিমদের ধর্মীয় পতাকা।
ভদ্রেশ্বরের বাজার পেরোনোর সময় কানে আসে হাওয়ায় ভাসা গুঞ্জন আর আলোচনা। সেসব এই তেলিনিপাড়ার ঘটনা নিয়েই। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতিতে কোনো উত্তেজনা নেই। সেই শান্ত পরিবেশ থমথমে নিষ্প্রাণতায় পাল্টে গেল ডানদিকে বেঁকে দিনেমারডাঙা স্ট্রিট বরাবর তেলিনিপাড়া ঘাটের দিকে এগোতেই। পথ আটকালো পুলিশের ব্যারিকেড। গাড়ি আর যাবে না। এবার পায়ে হেঁটে তাই পৌঁছোনো আক্রান্ত এলাকার অলিগলিতে। রাস্তায় লোকচলাচল প্রায় নেই। যে দু একজন কাজের তাড়নায় বাইরে বেরোতে বাধ্য হয়েছেন, আতঙ্ক আর অসহায়তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে রয়েছে তাঁদের চোখেমুখে।
দেখা গেল, তেলিনিপাড়া ঘাটের ঠিক আগেই, রাস্তার শেষমাথায় স্পেশালাইজড ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটেলিয়নের (SIRB) জওয়ানরা পাহারায় রয়েছেন। এক জওয়ান ‘দ্য ওয়্যার’ প্রতিনিধিকে জানান, তাঁরা রয়েছেন সংখ্যায় প্রায় জনা তিরিশ এবং চলছে সারাদিন সারারাত ধরে টহলদারি।
দিনেমারডাঙা রাস্তার মোড় থেকে বাঁদিকে রাস্তা গেছে ইদানীং পরিত্যক্ত গোঁদালপাড়া জুটমিলের দিকে। দুবছর হলো বন্ধ এই চটকল। একটু এগিয়েই বাঁদিকে আবার সরু গলি, ফেরিঘাট স্ট্রিটের দিকে নিয়ে যায় এই পথ। পথ থামে তেলিনিপাড়া ঘাটে এসে। জিটি রোড থেকে টানা দিনেমারডাঙা স্ট্রিটের এই মোড় অবধি পুরোটাই মূলত হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকা। সেখানেই প্রথম পা রাখা।
নাহ্, এখানে আগাগোড়া তেমন কোনো ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের চিহ্ন নেই। দিনেমারডাঙা স্ট্রিটের শুরুতে শুধু দুটো জ্বালিয়ে দেওয়া গাড়ির দেখা মিলেছিল। সরকারি ওয়েবসাইটে তারই একটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর যাচাই করে ‘দ্য ওয়্যার’ জানতে পেরেছে যে, এর মালিকের নাম গুলাম সারওয়ার আনসারি। বাকী গাড়িটা যেভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তার দেহে রেজিস্ট্রেশন নাম্বার প্লেটের কোনো অবশেষ ছিল না এবং তার মালিকের সনাক্তকরণ করা যায় নি।
তবে এই এলাকায় কিছু লোকজনকে ১২ই মে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রসঙ্গে ‘ঠিক কী হয়েছিল’ জিজ্ঞেস করার পরে, সবারই কেমন সিঁটিয়ে থাকা অনীহায় উত্তর এসেছে “আমরা ওসব ব্যাপারে কিছু জানি না”, এমনকী এক স্থানীয় মুদি দোকান সামলানো এক মহিলার গলাতেও সেই তোতাপাখির বুলি। প্রশ্ন করা হয়েছিল – “এই পুড়ে যাওয়া গাড়িগুলোর মালিক কারা জানেন
এখানে প্রশ্ন অনেকগুলো, যেটা সচেতন মানুষের অবশ্যই তোলা উচিৎ বলে মনে হল-
১. এই করোনার বাজারে যেখানে পাড়ায় পাঁচজন একসাথে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিলে পুলিশ ধরপাকড় করে, সেখানে পুলিশ জানলো না কিন্তু ৫০০ লোক নদী পেরিয়ে এত বিপুল অস্ত্রসহ তেলিনিপাড়ায় পৌঁছালো কীভাবে?
২. দিনের আলোয় এত অস্ত্রশস্ত্র নৌকায় বোঝাই হল, পার হলো, নামানো হল, তাতে নিশ্চয়ই সময় লেগেছে বেশ খানিক, তার খবরও প্রশাসন একটুও পেল না?
৩. দুধেল গরু ভেবে মুসলিম দরদী তৃণমূল এবং তার বিধায়ক একবারও নিজের এলাকায় অসহায়দের কাছে গেলেন না কেন? তিনি কোনো মন্তব্যে বিজেপিকেও বিন্দুমাত্র বিঁধলেন না কেন? সেটিং??
৪. এর কোনো বিচারবিভাগীয় তদন্ত হলো না কেন?
৫. যে আনন্দবাজার তার স্টাফের মা হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না বলে, তার ওপর টক শো করে বাজার গরম করে, এতবড় ভাঁওতাবাজির পোর্টাল তার নামে খুলে এভাবে স্পর্শকাতর বিষয়ে এতদিন মিথ্যে প্রচার হয়েছে জেনেও, তারা প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবাদ বা নিদেনপক্ষে কাগজে এর বিরুদ্ধে একলাইনও লিখলো না কেন? বিজেপির ফান্ডিং না তৃণমূলের নির্দেশ?
এগুলো সামনে আসা খুব দরকার মনে হয়। যেহেতু আমি শুধু অনুবাদের কাজটাই করেছি, তাই মূল পোস্টে এই প্রশ্নগুলো রাখতে পারিনি। তবে এগুলোই এই আক্রমণের আঁতুড়ঘর, এতে যে রহস্য আছে সেটা সমাধান হোক বিজেপি বা তৃণমূল কেউই চায় না।