|
---|
নতুন গতি ওয়েব ডেস্ক: সময়টা ১৮৫৬ সাল। ভারতে তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। ব্রিটিশ সরকারের চক্রান্তেই লক্ষ্ণৌ শহরের রাজত্ব খুইয়ে চিরতরে কলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন তৎকালীন এক নামজাদা নবাব। নবাবী চলে গেলেও তাঁর চোখে জল নেই। কারণ তিনি মনে করতেন একমাত্র সঙ্গীত এবং কবিতাই প্রকৃত পুরুষের চোখে জল আনতে পারে।
তিনি অওয়ধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। বজরা ভাসল নদীর জলে বেনারস হয়ে ভিড়ল কলকাতার বিচালি ঘাটে। নবাব তখন সর্বহারা। জীবনের শেষ তিরিশ বছর কলকাতাই নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের শহর। কালক্রমে এই শহরের সঙ্গে জড়িয়ে শুরু হল নতুন এক ইতিহাস।
সে সময় সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালীন ইংরেজদের নজরবন্দি হয়ে ছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামে। বিদ্রোহ মিটে যাবার আট মাস পর মুক্তি পেয়ে নির্বাসিত নবাব মেটিয়াবুরুজে গড়ে তুললেন ‘ছোটা লক্ষ্ণৌ’।
ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত পেনশন মাসে এক লাখ টাকার সাহায্যে তিনি মেটিয়াবুরুজে একের পর এক প্রাসাদ বানাতে শুরু করেন – মুরাসা মঞ্জিল, নুর মঞ্জিল, অদালত মঞ্জিল। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রমে শিল্প সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠে এ অঞ্চল। ব্রিটিশ সরকার শুধুমাত্র এই তথ্যই পরিবেশন করে গেছে যে তাঁর ৩৭৫ জন স্ত্রী ছিল। নবাবের সংস্কৃতিমনষ্কতার কথা বিশেষ উল্লেখ করেনি।
অথচ সে সময় গুরুত্বপূর্ণ কবি, গায়ক, বাদকদের কাছে মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল এক অবধারিত গন্তব্য। লক্ষ্ণৌ ঠুমরির টানে পাথুরিয়াঘাটা থেকে রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর পাড়ি দিতেন মেটিয়াবুরুজ।
ধ্রুপদী ধারার কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের এই কেন্দ্রে হামেশাই আসতেন যদুভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তী। নবাব স্বয়ং কত্থক শিখেছিলেন মহারাজ ঠাকুর প্রসাদজীর কাছ থেকে। শোনা যায় ১৮৬৭ তে হোলির সময় মেটিয়াবুরুজের দরবারে তিনি নিজে নর্তকীর বেশে নৃত্য পরিবেশন করেন, ঠুমরিও শোনান। তাঁকে আবার আধুনিক উর্দু নাটকের পথিকৃৎও বলা যায়।
নবাব হওয়ার আগে ১৮৪৩ সালে তিনি স্বরচিত নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কি কিসসা’ মঞ্চস্থ করেছিলেন। ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৫-এর মধ্যে অন্তত তেইশটি জলসার আয়োজন করেছিলেন, তাতে নিয়মিত ঐ নাটকের পরিণত, পরিমার্জিত অভিনয় হতো।
কবি, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার হিসেবেও নবাবের খ্যাতি কিছু কম নয়, কত্থক নিয়ে লিখেছিলেন সচিত্র বই ‘মুসাম্মি কি বানি’। নিজে সেতার শিখেছিলেন ওস্তাদ কুতুব আলী খানের কাছে। মেটিয়াবুরুজে রবাব ও সুরশৃঙ্গার যন্ত্রদুটির প্রবর্তকও তিনিই। সানাই, এসরাজ, সুরবাহার, সরোদের সাথেও জড়িয়ে তাঁর নাম। কুস্তি, ঘুড়ি ওড়ানো, মুরগী লড়াই, পায়রা পোষা – এ সবে নবাবের আসক্তি ছিল প্রচুর।
কলকাতার প্রথম চিড়িয়াখানাও তাঁর সৃষ্টি। বাঘ, হরিণ, উটপাখি, ময়ুর তো ছিলই, ‘ওপেন এয়ার’ এই চিড়িয়াখানায় ছিল সাপে ভর্তি চৌবাচ্চাও। আর খাদ্যরসিক নবাবের হাত ধরে মেটিয়াবুরুজে প্রবেশ করে ‘দমপক্ত’ খাবার। নিয়মিত পাচকদের নানা নতুন স্বাদের রান্নার পরীক্ষানিরীক্ষা করতে উৎসাহ দিতেন তিনি।
পোলাও, কোর্মা, বিরিয়ানি, শিরমল, শাহী টুকরা থেকে শুরু করে জর্দা – কলকাতাবাসীর জিভে এসব সুখাদ্যের অনুপ্রবেশ ঘটে ওয়াজেদ আলী শাহের হাত ধরেই। তাঁর খিদমতগার, নাপিত, ধোপা, ওস্তাগর প্রমুখের সাথে সাথে লক্ষ্ণৌ থেকে মেটিয়াবুরুজ এসে পৌঁছোয় জারদৌসি শিল্প, মুশায়েরা ও মুজরো।
১৮৮৭ সালে নবাব যখন মারা যান, সমাজের নানা স্রোতের, নানা জাতের প্রায় দশ হাজার শোকাহত মানুষ ভিড় করেন তাঁর শেষ যাত্রায়। নবাবের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকার বহু প্রাসাদ, অট্টালিকা ধ্বংস করে ফেলে। কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট তৈরির সময় নবাবীর শেষ চিহ্ন প্রায় মুছে যায়। তবু অওধের তহজীব বা আদবকায়দা এখনো টিকে আছে মেটিয়াবুরুজে। তারই নিদর্শন মেলে শাহী ইমামবাড়ায়।
ইমামবাড়া হল এমন এক উপাসনালয় যেখানে ধর্ময়ালোচনা, পাঠ, এমনকি ছেলেদের শিক্ষাদানের কাজও চলে। সার্কুলার গার্ডেনরিচ রোডে (অতীতের আয়রন গেট রোড) অবস্থিত শাহী ইমামবাড়ায় (অন্য নাম সিবতাইনাবাদ ইমামবাড়া) শুয়ে আছেন হতভাগ্য নবাব, তাঁর দুই পুত্র ও অন্যন্য বংশধরেরা। স্বয়ং ওয়াজেদ আলী শাহ নির্মিত এই ইমামবাড়া লক্ষ্ণৌ ইমামবাড়ার ক্ষুদ্র সংস্করণ, অথচ সত্যিই শাহী অর্থাৎ রাজকীয়। আর্চ ও কড়িবরগার সমতল ছাদের বিশাল হলঘর। বাঁদিকে নবাবের সমাধি। ছাদের উচ্চতা দোতলার সমান। ওয়াজিদ আলি শাহের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকার তাঁর স্মৃতি মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল কিন্তু এই শহর যেন তাকে আগলে রেখে এখনো বেড়ে চলেছে।