|
---|
বিদ্যাসাগর ও বিবেকানন্দ। বর্তমান অবস্থা ও আমরা
শেখ আরেফুল, পূর্ব মেদিনীপুর : ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশ ও সমাজ যখন গভীরভাবে সংকটাপন্ন, তখন বঙ্গ তথা ভারতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো যাদের আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অন্যজন স্বামী বিবেকানন্দ| একজন বিদ্যা, জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে সমাজ সংস্কার এবং সমাজ ও দেশের কল্যানে ব্রতী ছিলেন, আর একজন আধ্যাত্ম, ভক্তি ও সেবার মাধ্যমে একই লক্ষে ব্রতী ছিলেন| তৎকালীন সময়ে বঙ্গ ব্যাতিত ভারতবর্ষের কথা ভাবাই যাই না| তাই বঙ্গের নবজাগরণ সারা ভারতে আছড়ে পড়েছিল| আর এঁরাই ছিলেন সেই দুর্গম পথের নির্ভীক পথিক।
১৮৯৩ সালে (১১-২৭ সেপ্টেম্বর) স্বামী বিবেকান্দের বিশ্ব বিজয়ের অনেক আগেই তার গুরু শ্রীরামকৃষ্ণদেব বিদ্যাসাগরের সহিত সাক্ষাৎ করেন ১৮৮২ সালে (৫ আগস্ট)| শুধু তাই নয়, স্বামীজীর বিশ্ব জয়ের পূর্বেই বিদ্যাসাগর পরলোক গত হয়েছেন (২৯ জুলাই ১৮৯১)| কালক্রমে স্বামীজী দ্বার্থহীনভাবে স্বীকার করেন যে শ্রীরামকৃষ্ণদেব-এর পর তার গুরু ও মার্গ প্রদর্শক হলেন বিদ্যাসাগর, অর্থাৎ যদি তিনি শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে কোনো কারণে না পেতেন, তাহলে বিদ্যাসাগরই হতেন তাঁর গুরু|
বিদ্যাসাগর এবং স্বামীজী দ্বৈতরূপ ও দ্বৈতশক্তি লোকমানাসেএমনই সাহস, শক্তি ও অনুপ্রেরণার সঞ্চার করেছিল যার ঢেউ আটকে রাখা কোনোভাবে সম্ভব ছিল না তৎকালীন এস্টাব্লিশমেন্ট-এর পক্ষ্যে| সমাজ ও দেশকে অন্ধকার ও পরাধীনতা থেকে মুক্তির যে নিদান ওনারা রেখে গেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের স্বাধীনতা এলেও, তাকে যথাযথ পালন করলে সমাজ ও দেশের সর্বক্ষেত্রে যে চরম অবক্ষয় আজকের দিনে চলছে তার থেকে মুক্তি নিশ্চয়ই পাওয়া যেত| এনাদের চেয়ে বড় শিক্ষক আমরা কি আর কাউকে পেতে পারি? এর উত্তর বোধহয় “না”|
কিন্তু সমাজ ও দেশ রক্ষার্থে কে পালন ও বহন করবে তাঁহাদের সেই মহামূল্যবান নিদান?
মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থার সদস্যবৃন্দ বহুরকমভাবে বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত বিবরণ, রচনা সামগ্রীম ছবি, ভিডিও ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন সারা সেপ্টেম্বর মাসব্যাপী|
আশ্বিন মাস অথবা/বনাম সেপ্টেম্বর মাস
বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ (খ্রিস্টাব্দ) সোমবার, ১২ আশ্বিন, ১২২৭ (বঙ্গাব্দ)| উনি ছিলেন বাংলার নবজাগরণের দুর্বার ও মূর্ত প্রতীক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রকৃত রূপ ও সৃজনশীলতা আমাদের মুখে তুলে দেওয়ার অভিভাবক| তাই তাঁর নামে কোনো মাস ব্যাপী যদি কোনো কর্মকাণ্ড পালিত ও উদযাপিত হয়, তা সারা অশ্বিন (বাংলা) মাসব্যাপী হলে অনেক ভালো লাগবে মনে হয়|
সারা সেপ্টেম্বর মাসব্যাপী যে কর্মকাণ্ড চললো এই সংস্থার মাধ্যমে, তাতে কি বিদ্যাসাগরের অথবা স্বামীজীর একটু ছোট্ট কণা নিয়ে কেউ তাঁর জীবনের মন্ত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে? সেরকম কোনো আভাস দেখা গেলো না, কিন্তু| তাহলে এই সংস্থা, বা সমাজ বা দেশ প্রতিশ্রুতিহীন শুকনো তথ্যের আস্তাবলে কিছু পাবে কি? এর উত্তর কিন্তু লুকিয়ে আছে সবার কাছে এবং সবার মধ্যে|
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড| আমরা প্রত্যেকে নিজেরা নিজেদের শিক্ষক, আবার অপরেরও, সে প্রত্যক্ষভাবে হোক বা পরোক্ষভাবে| আবার কেউ কেউ আছেন যারা জীবিকা ভিত্তিক শিক্ষক| সবার কাছে বিদ্যাসাগর এবং বিবেকানন্দ হলেন আদর্শ গুরু বা শিক্ষক| এই গুরু-দ্বয়ের প্রকৃত মর্যাদা রক্ষায় শিক্ষককুল কি কিছু ভূমিকা নিয়েছে আজকের দিনে, এই সংকটময় মুহূর্তে? কোন জায়গায় অবস্থান করে এই শিক্ষকমণ্ডলী ?
কেউ কি এমন কোনো শিক্ষক পাবেন যিনি কোনোরকম কোনোদিন অন্যায় করেন নি, অন্যায় প্রশয় দেননি অথবা চোখের সামনে অন্যায় হচ্ছে দেখেও নীরব থাকেন নি অথবা অন্যায়ের সাথে সমঝোতা করেন নি| উত্তরটা প্রায় শূন্য বা খুবই নগন্য সংখ্যাক| সুতরাং, এক বালতি তেতো জলে একফোঁটা মিষ্টি জল দিলে কখনো বালতির জল মিষ্টি হয়ে যায় না; তেতোই থাকে|
কারখানা যেমন হয় সেখান থেকে প্রোডাক্টও সেই রকম উৎপন্ন হয়| সেজন্যে সমাজ ও দেশ তৈরির উদ্দেশ্যে মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবে যাদেরকে মনে করা হয়, সেই শিক্ষকগণই কি মূলত দ্বায়ী নয় এই সমাজ ও দেশ ধংসের মুলে? আশ্চর্যের বিষয় হলো যে এই জিনিটা সর্বৈব সত্য স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত| আর সেজন্যেই আমাদের এই সমাজ ও দেশের সুস্থ ও সাবলীলভাবে ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব যদি না দ্রুত ও সত্তর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এবং বিদ্যাসাগর ও স্বামীজীর বাণী ও আদর্শে ঝাঁপিয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর শিক্ষকগোষ্ঠী সর্বত্র তাদের মেরুদণ্ড সোজা রাখে| অন্যথায় বিদ্যাসাগর বা স্বামীজী আউড়াইয়া সমাজ ও দেশের কোনো হিতার্থ সাধিত হবে না|