পুজোয় গ্রন্থাগারে যেতে চান? আসতে হবে বাগনানে

নিজস্ব প্রতিবেদক : “পুজোয় গ্রন্থাগারে যেতে চান। কিন্তু ছুটি চলছে। তবে হতাশ হবেন না। আপনি গ্রন্থাগারেই প্রবেশ করেছেন।” মাইকে ঘোষণা শুনলেন। আর প্রবেশ পুজোর ভিড়েও গ্রন্থাগারে। আসলে গ্রন্থাগারের আদলে মণ্ডপ। মূলত গ্রন্থ সচেতনতার বার্তা দিতেই গ্রামের গ্রন্থাগারের আদলে অবিকল মণ্ডপ করেছেন গ্রামবাসীরা।
শহর কলকাতা থেকে অনেক দূরে। এলিট সোসাইটির ছোঁয়া কোনোদিন পায়নি উদ্যোক্তারা। বাগনানের আন্টিলার বাগাবেড়িয়া গ্রামে প্রগতিশীল পাঠাগারের আদলে এমনই এক মণ্ডপ করেছেন গ্রামবাসীরা। যা দেখলে কে বলবে প্রত্যন্ত গ্রামের পুজো। আসলে গ্রামেরই গ্রন্থাগার ভাবনাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ফুলচাষিরা এমন এক মণ্ডপ গড়েছেন। ঝাঁ চকচকে না হলেও গ্রন্থ সচেতনতার বার্তা বাহক মণ্ডপটি যথেষ্ট দাগ কাটছে। উদ্যোক্তা গ্রামবাসী স্বপন দাস জানালেন, গ্রামের মানুষকে সচেতন করেছে গ্রন্থাগার। আমাদের ঘরের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার পাঠ গ্রন্থাগারেই হয়। এখানকার গ্রন্থাগারিক হিসাবে দশ বছর কাজ করেছিলেন শাশ্বত পাড়ুই। তাঁর কাছ থেকেই আমরা রবীন্দ্রনাথের লাইব্রেরি ভাবনার পাঠ পাই। তাঁর চিন্তাধারাতে গ্রন্থাগারটি শৈশব থেকে আজ মহীরুহে। তিনি অন্যত্র সরকারী নির্দেশে চলে গেছেন। কিন্তু, তাঁর কাজ রয়ে গেছে। গ্রন্থাগারের সম্পদ থাকলেও গ্রন্থাগারটি রোজ এখন খোলে না। আমরা গ্রামবাসীরা গ্রন্থাগারটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিদিন খোলার দাবি করছি পূজা মণ্ডপে। মানুষের কাছে বই পড়ার জন্য আবেদনও করছি।
মণ্ডপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাগাবেড়িয়া গ্রামের প্রবীণ মানুষ রণজিৎ মণ্ডল জানালেন, গ্রামের বাসিন্দা কিশোরী ঘোড়ুই জমি দিয়েছিলেন গ্রন্থাগার ভবনের জন্য। ১৯৮২ সালে গ্রন্থাগারটি সরকারী অনুমোদন পায়। তবে শাশ্বত পাড়ুই গ্রন্থাগারিক থাকার সময়েই বহু উন্নতি হয়েছিল। গ্রন্থাগারের নিজস্ব সেমিনার হল, রবীন্দ্র মঞ্চ নির্মিত হয়। যুবক চিন্ময় ঘোড়ুই জানালেন, “এলাকার মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মক টেস্ট, কেরিয়ার কাউন্সেলিং নিয়মিত হত। অনেকেই চাকরি পেয়েছিল গ্রন্থাগারে পড়াশুনা করে। শাশ্বত বাবুকে সরকার অন্য গ্রন্থাগারে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর গ্রন্থাগারটিতে পাঠক কমে যাচ্ছে। তাই গ্রন্থাগার বাঁচানোর তাগিদ ও মানুষকে গ্রন্থমুখী করার উদ্যোগ নিতেই গ্রন্থাগারের আদলে বাগাবেড়িয়াতে দুর্গা পুজোর মণ্ডপ করেছি আমরা।”
বলতে গেলে উৎসবের সেরা মণ্ডপ। গ্রন্থাগার রক্ষার বার্তা দিয়ে উৎসব মণ্ডপ হয়েছে গ্রন্থাগার ভবনের আদলে। মানব ধর্মই শ্রেষ্ঠ। সত্যিকারের মানুষ হতে গেলে জীবন বোধ উন্নত করতে হবে। এই বোধ এলাকার মানুষ পেয়েছেন গ্রন্থাগার থেকে। কেবল মানুষ তৈরি নয়, গ্রন্থাগার স্বশিক্ষার পাঠশালা।

    ফুলচাষিদের গ্রাম বাগাবেড়িয়া দেখেছে কিভাবে গ্রন্থাগারের সমর্থন পেয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন যুবক-যুবতীরা। তাই গ্রন্থাগার বদলে দিয়েছে সমাজটাকেও। সামাজিক শিক্ষার পাঠশালা গ্রন্থাগার বন্ধ থাকা মানে সামাজিক শিক্ষার পাঠশালা হারিয়ে যাওয়া। প্রতিদিন গ্রন্থাগার খোলা রাখা ও গ্রন্থাগার সচেতনতার বার্তা দিতে বাগনানের বাগাবেড়িয়া গ্রামে গ্রামীণ গ্রন্থাগারের আদলে উৎসব মণ্ডপ করেছেন গ্রামবাসীরা।

    এলাকার ফুলচাষি কাশীনাথ সামন্ত জানালেন, গ্রন্থাগারের মাধ্যমে এলাকায় সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা ছিল আগে। এখন তা হচ্ছে না। আমাদের ঘরের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নাটক, গান, কবিতার নিয়ম করে চর্চা চলতো শাশ্বত পাড়ুই গ্রন্থাগারিক থাকার সময়ে। গ্রন্থাগারকে আমরা আগের মত দেখতে চাই। তাই গ্রামবাসীরা সবাই আলোচনা করে এবারের পুজোর মণ্ডপ প্রগতিশীল পাঠাগারের আদলে করেছি।
    প্রগতিশীল পাঠাগারের সভাপতি ও সম্পাদক যথাক্রমে কিশোরী মোহন ঘোড়ুই ও দীপঙ্কর সামন্ত স্বীকার করেছেন গ্রন্থাগারের সংকটের কথা। তাঁরাও মনে করেন প্রতিদিন গ্রন্থাগার খোলার দাবি পূজা মণ্ডপ থেকে করাটা সময়োচিত। কিশোরীবাবু বলেছেন, শাশ্বত পাড়ুই-এর মত ভালো গ্রন্থাগারিককে এলাকার মানুষের কাছ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় গ্রন্থাগার সংকটের মধ্যে পড়েছে। পুজোর সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত ইন্দ্রজিৎ সামন্ত জানালেন, আমরা গ্রামের মানুষের মধ্যে গ্রন্থ চেতনা গড়ে তুলতেই প্রতিদিন গ্রন্থাগার খোলার আওয়াজ গ্রন্থাগারের আদলে নির্মিত পূজা মণ্ডপ থেকে করতে গ্রামবাসীরা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এলাকার ভ্যান রিক্সা চালক রবীন মাঝি জানান, শাশ্বত বাবুর চিন্তা ভাবনাতেই গ্রন্থাগারের উন্নতি হয়। তাই তিনিই পুজো মণ্ডপের উদ্বোধন যেন করেন সেই আর্জি আমরা শাশ্বতবাবুর কাছে রেখেছিলাম। উনি সম্মত হওয়ায় আমরা খুশি।

    গ্রন্থাগারের আদলে দুর্গা পুজোর মণ্ডপ উদ্বোধন করে গ্রন্থাগারিক শাশ্বত পাড়ুই জানালেন, আমার কর্মজীবনের প্রথম দশটি বছর কেটেছিল ওই গ্রামে। আমরা চেষ্টা করেছি মানুষকে গ্রন্থমুখী করার। মানুষ নিজে থেকেই এখন উদ্যোগ নিচ্ছেন। ভালো লাগছে গ্রামের মানুষের জাগ্রত চেতনাকে। পড়াশোনার বিকল্প কোনো কিছুই হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর লাইব্রেরি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপর দাঁড়াইয়া আছি। ‘ ওরাই তো পথের দিশারী। যারা মানুষের মধ্যে গ্রন্থাগারে যাওয়ার কথা বলে। বই পড়ার কথা বলে। ধর্মের বেড়াজাল ভেঙ্গে মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষার চাইতে বড় কোনো ধর্ম নেই। একথা বাগাবেড়িয়ার মানুষ বুঝেছেন। এটা আমার কর্মজীবনের সার্থকতা। শুধু বলবো ভালোবাসার চাইতে আর কোনো বড় ধর্ম হতে পারে না। মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসবে।

    বাগাবেড়িয়াতে খুব বড় করে পুজো হয় না। মানুষ হওয়ার পাঠশালা গ্রন্থাগারকে কেন্দ্র করেই। গ্রামের মানুষ গ্রন্থাগারটিকে এতটাই ভালোবাসেন যে উৎসবের থিম করেছেন আস্ত গ্রন্থাগার ভবনকেই। গ্রামবাসীরা মণ্ডপের রূপ দিয়েছেন গ্রন্থাগার ভবনের আদলে। মণ্ডপে প্রতি দিন গ্রন্থাগারের নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজ চলবে বলে গ্রন্থাগারের সম্পাদক দীপঙ্কর সামন্ত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আগে গ্রন্থাগারের ৬০০ জন সদস্য ছিল। গত এক বছরে সদস্যরা সেইভাবে আসছে না। গ্রন্থাগারে ছয় হাজারের বেশি বই আছে। এটা সত্যি শাশ্বতবাবু যে চেতনাবোধ করেছিলেন গ্রামে গ্রন্থাগার নিয়ে তাতেই এলাকার মানুষের মধ্যে গ্রন্থাগার নিয়ে উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল। তাই গ্রন্থাগার ভাবনায় বাগাবেড়িয়া গ্রামে প্রগতিশীল পাঠাগারের আদলে মণ্ডপ অভিনব উদ্যোগ বলে মনে করছেন এলাকার গৃহবধূ ও শিক্ষিকা রূপালী ঘোড়ুই।

    প্রগতিশীল পাঠাগার এলাকার মানুষ নিজেদের হৃদয়ে ঠাঁই দিয়েছেন মানবতার ধর্মকে। সবার ওপর মানুষ সত্য, তাহার ওপর কেহ নাই। আবার মানুষের মত মানুষ করতে পারে বই। তাই হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণাকে সরাতে সবাই বইয়ের চেতনায় ঋদ্ধ হওয়ার বার্তা দিতেই উদ্যোগ গ্রন্থাগারের আদলে পূজা মণ্ডপ।