|
---|
আসাদুল ইসলাম,নতুন গতি : পশ্চিমবঙ্গের প্রতি যে গেরুয়া শিবির একটু বেশিই আশা করছে তা তাদের মরিয়া চেষ্টা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। কেন্দ্রের তাবড় তাবড় নেতানেত্রী তো বটেই খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জোরদার লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়েছেন। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই তিনি লড়াইয়ে নেমেছেন। তৃণমূল কংগ্রেস বনাম বিজেপি লড়াই এখন বদলে গেছে মোদি-মমতার লড়াইয়ে। পশ্চিমবঙ্গে মোদি -শাহ জুটি শুধু নিজেদের আসনই বাড়াতে চাইছেন না, তৃণমূলনেত্রীকে সবক শেখাতে এমন ধাক্কা দিতে চাইছেন যাতে বিজেপি বিরোধিতা করলে হাল কেমন হতে পারে বাকি ভারতের সামনে তা তুলে ধরা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল সেই কাজে গেরুয়া শিবির আদৌ কি সফল হতে পারবে? সফল হলেও কতটা সফল হবে?
আমরা সবাই জানি গত লোকসভা নির্বাচনে মোদি ঝড়ের ফলে প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে দুটো লোকসভা আসন জিতেছিল— দার্জিলিং ও আসানসোল। দার্জিলিং হিসেবের মধ্যে থাকলেও আসানসোল ছিল না। গো-বলয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে সেখানে ফল খারাপ হতে শুরু করায় পশ্চিমবঙ্গ সহ উত্তর-পূর্ব ভারতকে টার্গেট করে বিজেপি। উত্তর-পূর্ব ভারতে, যেখানে বিজেপি কী জিনিস নাগরিক তা ইতিপূর্বে স্বাদ পায়নি, সেখানে জমি তৈরিতে নেমে পড়ে। মূলত আর এস এস-এর সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের জমি তৈরি করেছে তারা। আর এস এস-এর হিন্দুত্ববাদী প্রচার এরাজ্যে নিঃসন্দেহে বিজেপিকে ভিতরে ভিতরে একটা জমি তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু সেই হিন্দুত্বের রাজনীতি যে পশ্চিমবঙ্গে ততটা কার্যকরী নয় তা গত বিধানসভা নির্বাচনে স্পষ্ট হয়েছে। তাছাড়া নারদা-সারদার মতো ভোটের মুখে তুমুল বিতর্কিত ইস্যু হাতে পেয়েও ভোটের ফলে দেখা গেল তার কোন প্রভাব পড়েনি। ফলে বাড়তি কিছু ভাবতে হয় গেরুয়া শিবিরকে। সেই ভাবনার ফসল মুকুল রায়, অর্জুন সিং, অনুপম হাজরা, সৌমিত্র খাঁ, নেতা ভাঙিয়ে দল শক্তিশালী করার খেলা। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝে গেছে বাংলায় দল ভাঙানোর খেলা যত জোরদার হবে বিজেপির আসন পাওয়ার সম্ভাবনা ততই বাড়বে। দেশে বিরোধী হাওয়া তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোদির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা যত কমেছে বিজেপি আদর্শ ভুলে শুধুমাত্র যেনতেন প্রকারে জেতাকে পাখির চোখ করেছে। বিজেপি সভাপতি সেটা খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছেন। সেই অঙ্ক মেনেই সংঘের বিরোধিতাকে পাশে সরিয়ে বিতর্কিত বহু ব্যক্তিত্বকে লোকসভা নির্বাচনে টিকিট দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও সেই ফর্মুলা মেনেই প্রার্থী দেওয়া হয়েছ। অমিত শাহরা পশ্চিমবঙ্গে ২২টি আসন পাওয়ার টার্গেট বেঁধে দিয়েছেন। মাত্র দুটো আসন থেকে ২২টা আসন পাওয়ার মতো পরিস্থিতি কি আদৌ তৈরি হয়েছে? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে অমিত শাহ বহুজাতিক সংস্থার ধাঁচে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিলেও তিনি নিজেও জানেন তা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অনেকে মনে করছেন বিজেপি আসলে খান দশেক আসন পেতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। বর্তমানের আসানসোল-দার্জিলিং আসন দুটির সঙ্গে বালুরঘাট, আলিপুরদুয়ার, পুরুলিয়া, ব্যারাকপুর, কৃষ্ণনগর, হাওড়া—- এমন বেশ কিছু আসনে জেতার ব্যাপারে আশাবাদী গেরুয়া শিবির। ১০টি আসন না হলেও অনেকে মনে করছেন বর্তমানের দুটি আসনের সঙ্গে আরও অন্তত চারটি আসন পেতে পারে বিজেপি। মোদি যেভাবে হাত ধুয়ে পড়েছেন তার ফলে এই প্রাপ্তি হতে পারে। দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় যে শ্রম দিচ্ছেন সে তুলনায় ফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম। বিগত নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে বিজেপির ভোট বাড়লেও তৃণমূলের ভোট কমছে না। সেই ঝোঁক থেকে স্পষ্ট বাম- কংগ্রেস ভোট বিজেপির দিকে যাচ্ছে। বাম-কংগ্রেস জোট হলে বিজেপির ভাসন পাওয়া সহজ হতো না। ভোট কাটাকুটি খেলায় প্রকারান্তরে বাম-কংগ্রেস দল বিজেপির সুবিধা করে দিল। কংগ্রেসের ভোট কয়েকটি কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় সামগ্রিক ভোটে শেয়ার কম হলেও অন্তত দুটো কেন্দ্রে কংগ্রেস জিতবে। অন্যদিকে কংগ্রেসের চেয়ে শতাংশের হিসেবে বেশি ভোট পেয়েও এর উল্টো কারণে বামেদের হাতে থাকা দুটো আসন হারানোর সম্ভাবনা ষোল আনা। তৃণমূল কংগ্রেসের আসন গতবারের চেয়ে বড়জোর দুটো কমবে। এই ক্ষতির চেয়েও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যেটা বেশি ভাবনার, তা হলো আরও বেশি শক্তি অর্জন করে বিজেপি আগের চেয়ে কঠিনতর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট চিন্তার। তবে মোদি-শাহ জুটি পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে ঝাঁপিয়েছেন তার উপযুক্ত প্রতিদান পাবেন না নিশ্চিত। প্রচুর অর্থ-শ্রম ব্যয় করে যদি মাত্র চার-পাঁচটা আসন বাড়ে তা তাঁদের ক্ষমতায় ফেরার কাজে কতটা সহায়ক হবে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। যদি বিজেপি ক্ষমতায় ফিরে আসে তাহলে এই কটা আসন মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে, আর যদি না পারে তখন হয়তো মনে হলেও হতে পারে যে এই সময়-শ্রম অন্যত্র দিলে ভালো ফল পাওয়া যেত। তাছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধাক্কা দিতে না পারলে দেশের বাকি অংশেও মোদি-শাহ জুটির নৈতিক পরাজয়ের বার্তা পৌঁছে যাবে, যা ধারে-ভারে বিরাট ক্ষমতাধর দল হিসেবে বিজেপির কাছেও ‘ইজ্জত কী সওয়াল’ হয়ে উঠতে পারে।