জালিয়ানওয়ালা বাগের রক্তাক্ত ইতিহাস ও মোহাম্মদ আজাদ সিং

মোহাম্মদ রিপন: ইতিহাসের পাতায় এখনো একটি কালিমালিপ্ত অধ্যায় জালিয়ানওয়ালাবাগ। যে ইতিহাস এখনো ক্ষমা করেনি ব্রিটিশ সরকারের হিংস্রতাকে। আজ থেকে 102 দু’বছর আগে ঠিক এই দিনেই পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। দিনটি ছিল 1919 সালের 13 ই এপ্রিল শিখ সম্প্রদায়ের প্রায় পনেরো থেকে কুড়ি হাজার মানুষ পাঞ্জাবি নববর্ষ (বৈশাখী উৎসব) উদযাপন করতে ও ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়ন মূলক রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে জালিয়ানওয়ালাবাগে উপস্থিত হয়েছিলেন। রাওলাট আইনের ফলে খর্ব হয়েছিল ভারতীয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বিনা প্ররোচনায় গ্রেপ্তার। শিখ সম্প্রদায়ের বহু মানুষ রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদে সামিল হোন। জাতীয় স্তরের দুই নেতা সত্যপাল ও সাইফুদ্দিন কিচলুর নির্বাসন আদেশ প্রত্যাহারের দাবিও জানান তারা ।

     

     

    কি ছিল রাওলাট আইনে? – পরাধীন ভারতে বাংলা,বিহার, পাঞ্জাবে একের পর এক গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশের ভিত নাড়িয়ে দিতে এই গণআন্দোলন যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ঠিক সেই সময়ই 1919 সালে বিচারপতি সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটিকে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং সেই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক আন্দোলন এবং জনগণের মধ্যে বেড়ে ওঠা সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের প্রভাবকে দমন করার পথ খুঁজে বের করা৷ রাওলাট কমিটি 1915–র ভারত রক্ষা আইনকে আরও কঠোর এবং আক্রমণাত্মক করার সুপারিশ দিলে ভারতীয় সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, বাকস্বাধীনতা হরণ, যেকোনো সময় বাড়িতে তল্লাশি নেওয়া, রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া, বিনা বিচারে যে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে যত দিন খুশি আটক রাখার অধিকার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া সহ নানা ধরনের দমনমূলক ব্যবস্থা নেয় সরকার৷

    অন্যদিকে 1918 সালে পাঞ্জাবে অনাবৃষ্টিতে চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়৷ বিভিন্ন অঞ্চলে প্লেগ মহামারীর আকার নেয়, চার–পাঁচ মাসে ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা যায় অসংখ্য মানুষ৷ ঋণ মুকুব এর জন্য পাঞ্জাবের নেতৃত্বে গণ আন্দোলনে সামিল হন। লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ার পাঞ্জাব গণ আন্দোলনের নেতা লোকমান্য তিলক ও বিপিনচন্দ্র পালের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়৷ ব্রিটিশ সরকারের অকথ্য অত্যাচার এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হ‌ওয়া নিউ ইন্ডিয়া, অমৃতবাজার পত্রিকা, ইন্ডিপেন্ডেন্ট সহ অনেক সংবাদপত্র পাঞ্জাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

     

     

    প্রতিবাদে আগুনের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল সত্যাগ্রহ আন্দোলনে৷ 30 ই মার্চ, 1919 অমৃতসরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হল৷ 6 ই এপ্রিল দেশের হিন্দু ও মুসলমান সহ সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ একযোগে সারা ভারতজুড়ে হরতাল পালন করে৷ শ্রমিক কৃষক সহ সাধারণ মানুষ তীব্র আবেগ ও উন্মাদনা নিয়ে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে৷ হরতালে পাঞ্জাবের জনজীবন অচল হয়ে পড়ে৷ 10 ই এপ্রিল টেলিগ্রাফ পোস্ট, রেললাইন উপড়ে দিয়ে, রাস্তা কেটে মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে থাকে৷ 11 ই এপ্রিল শহরের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং ইউরোপীয়দের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে সুবিশাল বাহিনীসহ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারকে শহরের পাঠানো হয়েছিল। তিনি শহরে আসার পরে ভারতীয়দের সমস্ত সভা, জমায়েত নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং ব্রিটিশ সরকারের লাল চোখকে অগ্রাহ্য করে অমৃতসরে 13 ই এপ্রিল শিখ সম্প্রদায়ের প্রায় পনেরো থেকে কুড়ি হাজার মানুষ পাঞ্জাবি নববর্ষ (বৈশাখী উৎসব) উদযাপন করতে ও ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়ন মূলক রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে জালিয়ানওয়ালাবাগে উপস্থিত হয়েছিলেন। রাওলাট আইনের ফলে খর্ব হয়েছিল ভারতীয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বিনা প্ররোচনায় গ্রেপ্তার। শিখ সম্প্রদায়ের বহু মানুষ রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদে সামিল হোন। জাতীয় স্তরের দুই নেতা সত্যপাল ও সাইফুদ্দিন কিচলুর নির্বাসন আদেশ প্রত্যাহারের দাবিও জানান তারা ।হঠাৎই কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে জালিওনাবাগে ঢুকে পরে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনী। ভারতীয়রা কিছু বুঝে উঠার আগেই দশ মিনিট ধরে 1650 রাউন্ড গুলি চালিয়ে প্রায় 379 জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে(ভারতীয় ইতিহাসবিদদের মতে সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি ছিল)1200 জন মতো গুরুতর আহত হয় । আট থেকে আশি কেউ রেহাই পায়নি নিষ্ঠুর শাসকের হাত থেকে। বুলেটের আঘাত থেকে প্রান বাঁচতে অনেকে কুপের মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছিলেন কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। এই হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশজুড়ে শোরগোল পড়ে গেছিল কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই আন্দোলন সারা দেশজুড়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।কবিগুরু তখন অসুস্থ তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়েন ব্রিটিশের দেওয়া নাইট উপাধি ত্যাগ করেন, মহম্মদ আলি জিন্নাহ, মাজহার উল হক আইন পরিষদের সদস্য পদে ইস্তফা দেন । বাংলার মুকুটহীন সম্রাট সুরেন্দ্রনাথ সহ সকল নরমপন্থী নেতারা গর্জে ওঠেন।বিপ্লবী ভগৎ সিং ছিলেন তখন ছোট্ট কিশোর৷ তিনি খবর শুনে ছুটে গিয়েছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগে৷ শহিদের রক্তমাখা পবিত্র মাটি নিয়ে এসেছিলেন, তা মেখেছিলেন কপালে, শপথ নিয়েছিলেন, এর প্রতিশোধ একদিন নিতেই হবে৷ দেশটিতে ক্ষোভের এক প্রবাহ ছড়িয়ে পড়লে অহিংসবাদী মহাত্মা গান্ধী লিখেছিলেন “আমরা ডায়ারকে শাস্তি দিতে চাই না। প্রতিশোধ নেওয়ার আমাদের কোন ইচ্ছা নেই। আমরা ডায়ারদের সিস্টেমটি পরিবর্তন করতে চাই ”।

    চাপে পড়ে ব্রিটিশ সরকার তদন্ত কমিশন গঠন করে সেই তদন্ত কমিশনের সামনে কুখ্যাত কর্নেল ডায়ার তদন্ত কমিশনের সামনে বলেছিলেন, দেশ জুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য৷ বলশেভিক বিপ্লবের ভয়েই যে এমন উন্মত্ত আক্রমণ, তাও বিচারের সময় তিনি বলেছিলেন৷ ডায়ার নির্বিকার চিত্তে জানিয়েছিলেন, মেশিনগানগুলি গাড়ি থেকে নামিয়ে ভিতরে নিয়ে যেতে পারেননি বলে কম লোকের মৃত্যু হয়েছে৷ ‘আমি আরও চেয়েছিলাম’৷

     

    সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে উত্তর ভারতের বলশেভিক ব্যুরোর প্রধান এম অ্যালেক্সেই অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদককে চিঠিতে লিখেছিলেন গভীর উদ্বেগের বিষয় ও নিন্দনীয়। জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনা লেলিন পত্রিকায় পড়ে মর্মাহত হয়েছেন। তিনি ভারতীয়দের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। ন্যায় সঙ্গত এই লড়াইয়ে সর্বদা সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের সাথে থাকবে।

     

     

    জেনারেল ডায়ারের পরিনাম – পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে বৈশাখী উৎসব ও রাওলাট অ্যাক্টের প্রতিবাদে যখন শান্তিপূর্ণ জমায়েতে হাজার হাজার মানুষ যোগদান করেছে

    সেখানে আগত সকল মানুষের জন্য পানীয় জল বিতরণের কাজ করছিলেন বছর উনিশের এক তরুণ। ছেলেটির নাম উধম সিংহ, খুব অল্প বয়সেই বাবা মাকে হারিয়ে অনাথ আশ্রমে থাকতেন তিনি। কুখ্যাত জেনারেল ডায়ার যখন নির্বিচারে গুলি করে ভারতীয়দের হত্যা করছে তখন তিনি মাঠের এক প্রান্ত থেকে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখেছিলেন। ছেলেটির কানে তখন শুধু একটি শব্দ ভেঁসে উঠছিল ফায়ার— ‘ফায়ার’! বাকি কেবল বন্দুকের গর্জন, আর অজস্র মানুষের হাহাকার।নিয়তির যাত্রা যেন সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুতভাবে ওই গুলি এসে লাগেনি তরুণ উধম সিংয়ের গায়ে। আর লাগেনি বলেই তৈরি হয়েছিল ইতিহাস। জালিয়ানওয়ালাবাগ যেন উধম সিংয়ের জীবনে একটা ঝড় নিয়ে আসে। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন ডায়ারকে হত্যার। উধম সিংয়ের শিরায় শিরায় তখন প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। প্রতিশোধ তিনি নেবেনই। এইজন্য প্রথমে ভগৎ সিংয়ের সাথে পরে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরতে থাকেন। ভগৎ সিং এর নির্দেশে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। 1927 সালে অস্ত্র রাখার অপরাধে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করার পর 1931 সালে মুক্তি পান তিনি।হিন্দুস্তান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হওয়ার দরুন পুলিশ সর্বদা তার ওপর নজরদারি রাখতো , পুলিশের চোখে ধোঁকা দিয়ে তিনি প্রথমে কাশ্মীর তারপরে জার্মানি দিয়ে লন্ডনে পৌঁছান। লন্ডনে গিয়ে উধম সিং কাঠ মিস্ত্রী, মটর মেকানিক ও সাইন বোর্ড পেইন্টার এরকম বিভিন্ন পেশায় কাজ করতে শুরু করেন। এমনকি তিনি নায়ক আলেকজান্ডার কোর্ডার অতিরিক্ত শিল্পী হিসাবে – Elephant Boy ( ১৯৩৭) ও The Four Feathers (১৯৩৯) নামে দুটি চলচিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন

    ডায়ারের প্রাণ নেবার জন্য তিনি তাঁর রিভলবার একটা মোটা বইয়ের ভিতরের পাতাগুলি রিভলবারের আকারে কেটে তার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন।১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ কাক্সটন হিলসের রয়্যাল সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটিতে ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের এক বৈঠকে ও ডায়ারের উপর উধম সিং লুকোন রিভলবার থেকে গুলি চালান। তখনই তাঁকে গ্রেফতার করে ব্রিক্সটন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। জেলে উধম সিং ৩৬ দিন অনশন করেন। পুলিশের কাছে বিবৃতিতে এবং আদালতে, তিনি নিজেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম-শিখ সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে নিজের নাম বলেন মহম্মদ সিং আজাদ। উধম সিংয়ের মৃত্যুদণ্ড হয়। ১৯৪০ সালের ৩১ জুলাই পেন্টনভিল জেলে তাঁর ফাঁসি হয় , দেশমাতৃকার শৃংখলমুক্তির জন্য এক বীরসন্তানের বীরগতি প্রাপ্ত হয়। ইন্দিরা গান্ধী সরকারের তত্ত্বাবধানে ১৯৭৪ সালে নিজের গ্রাম সুনামে তাঁর দেহাবশেষ সমাধিস্থ করা হয়। অমর শহীদ ভগৎ সিং, রাজগুরু,সুকদেবের মতই তাঁর দেহভশ্ম পবিত্র শতদ্রু নদীতেও ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরই নামে উত্তরাখণ্ডের একটি জেলার নামকরণ করা হয়েছে । এভাবেই দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন উধাম সিংহ। চিরদিন তিনি ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষের মনের মনিকোঠায় বেঁচে থাকবেন।