|
---|
নিজস্ব সংবাদদাতা; ভোট পরবর্তী ‘হিংসা’ থেকে গরু, পাথর এবং বালি পাচার— গত কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার নজরে বীরভূম জেলা। আর এই প্রতিটি মামলায় নাম জড়িয়েছে বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা অনুব্রত মণ্ডল ওরফে কেষ্টর। শুধু বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতিই নন, তাঁর কন্যা থেকে কাছের মানুষ, ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী থেকে হিসাবরক্ষক, প্রত্যেকেই রয়েছেন সিবিআইয়ের (কোনও কোনও মামলায় ইডি) নজরে। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির তদন্তে এক দিকে অনুব্রত মণ্ডল ও তাঁর মেয়ে সুকন্যার নাম উঠে এসেছে, তেমনই খোঁজ ও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে আরও অনেকের।
অনুব্রত মণ্ডল বিধায়ক, মন্ত্রী বা সাংসদ নন। রাজ্যের শাসক দলের একটি জেলার সভাপতি। কিন্তু বীরভূম জুড়ে তাঁর প্রভাব বিস্তর। অনুব্রতের দাপট এমনই যে, বিরোধীরা তাঁকে বীরভূমের মুখ্যমন্ত্রী বলে কটাক্ষ করেন। কার্যত বীরভূমের ‘নিয়ন্ত্রক’ এখন গরু পাচার মামলায় আসানসোলের জেলে বন্দি। বার বার অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে জামিনের আবেদন করেছেন কেষ্ট। এখনও পর্যন্ত প্রতি বারই তা খারিজ হয়েছে।
তবে শুধু গরু পাচার মামলাই নয়, ভোট পরবর্তী হিংসা থেকে বালি এবং পাথর পাচার, সব মামলাতেই তিনি যুক্ত বলে দাবি সিবিআইয়ের। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল। বীরভূমের তৃণমূল বিধায়কদের নিদান দিয়েছেন বীরের মর্যাদা দিয়ে কেষ্টকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। আবার মঙ্গলকোট মামলায় বেকসুর খালাস হয়ে আত্মবিশ্বাসী কেষ্টও বলেছেন, সব ক’টি মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। কারণ, তিনি নাকি কোনও অপরাধ করেননি।
অনুব্রত মণ্ডলের এক মাত্র সন্তান সুকন্যা। পেশায় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা সুকন্যাকে কখনও রাজনৈতিক মঞ্চে দেখা যায়নি। অনুব্রতেরও তেমনই ইচ্ছা ছিল। তবে গরু পাচার মামলায় বাবার নাম জড়ানোর পরে সেই সুকন্যাকে নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনার অন্ত নেই। সিবিআই তদন্তে উঠে এসেছে শুধু মাত্র প্রাথমিক শিক্ষিকা হয়েও কোটি কোটি টাকার মালিক অনুব্রত-কন্যা। সরকারি চাকরি করেন। তা সত্ত্বেও দু’টি কোম্পানির যৌথ ডিরেক্টর সুকন্যা। চালকল, জমি-সহ তাঁর নামে একাধিক সম্পত্তির হদিস পেয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা।
সুকন্যা নিয়মমাফিক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকার চাকরি পেয়েছেন কি না, তা নিয়েও মামলা হয় হাই কোর্টে। যদিও তা খারিজ হয়ে যায়। অন্য দিকে, তাঁর বিপুল সম্পত্তির উৎস জানতে বাড়িতে গিয়েছে সিবিআই। টানা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাঁকে। তবে অনুব্রত-কন্যা সংবাদমাধ্যমের সামনে এক বারও মুখ খোলেননি।
অনুব্রতের ছায়াসঙ্গী ছিলেন সহগল হোসেন। তিনি বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতির ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছিলেন। সিবিআই দাবি করেছে, এই সহগলই নাকি গরু পাচারকারীদের সঙ্গে সমন্বয়সাধন করতেন। এমনকি, পাচার সংক্রান্ত টাকার লেনদেনও তিনি করতেন। তাঁর কোটি কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হদিস পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
এক জন দেহরক্ষীর এত সম্পত্তির উৎস কী, কোথা থেকে এত রোজগার— এ সব নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। অনুব্রতের আগেই সহগল গ্রেফতার হয়েছেন। আসানসোলে একই জেলে রয়েছেন দু’জন।
বাংলায় গরু পাচার মামলায় অন্যতম আলোচিত নাম এনামুল হক। অভিযোগ, সীমান্ত দিয়ে গরু পাচারের মূল কাণ্ডারি নাকি তিনিই। আদতে মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা এনামুল। কিন্তু তাঁর যোগাযোগ বিস্তৃত মালদহ হয়ে কোচবিহার পর্যন্ত। তদন্তে উঠে এসেছে, ভিন্দেশে গরুপাচারের তিনিই মূল হোতা।
সম্প্রতি এনামুলের ঘনিষ্ঠদের বাড়ি এবং অফিসেও হানা দিয়েছে সিআইডি। কিছু দিন আগে মুর্শিদাবাদে চালকলে হানা দেয় রাজ্য সিআইডি। সেখান থেকে বেশ কিছু নথিপত্র উদ্ধার হয়। চালকল থেকে কি গরু পাচারের নকশা তৈরি হত? উঠছে এই প্রশ্নও।
নিজস্ব সংবাদদাতা: বীরভূমের গরু ব্যবসার অন্যতম মাথার নাম আব্দুল লতিফ। জেলার দু’টি বড় গরুর হাটের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর হাতে। আবার অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এই ব্যবসায়ীর মার্বেল পাথরের ব্যবসাও রয়েছে। আপাতত তিনি ফেরার।
আব্দুলকেও গরু পাচার কাণ্ডে অন্যতম মাথা বলছেন তদন্তকারীরা। সহগলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও তাঁর নাম পাওয়া গিয়েছে বলে সিবিআই সূত্রে খবর। আবার সিবিআইয়ের অতিরিক্ত চার্জশিটেও নাম রয়েছে আব্দুল লতিফের। কিন্তু তাঁর নাগাল পাননি সিবিআই আধিকারিকরা। এ-ও শোনা যায়, লতিফ বাংলাদেশে ঘাঁটি গেড়েছেন।
বীরভূম জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ আব্দুল কেরিম খানের নামও জড়িয়েছে গরু পাচার মামলায়। শুধু তাই নয়, ভোট পরবর্তী হিংসার মামলাতেও তাঁর নাম রয়েছে। গত অগস্টে শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায় সিবিআই। তখনই এই কেরিম খানের বাড়িতে হানা দেয় ইডি এবং পরে সিবিআই। জেলার এই নেতার সম্পত্তির বহর দেখে বিস্মিত হয়েছে সিবিআই। নানুরের থুপসারা পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত সাঁতরা গ্রামে বাড়ি ছিল কেরিমের। সুচপুর গণহত্যা মামলার পর থেকে জেলায় কেরিমের নাম শোনা যেত। জেলা রাজনীতিতে তিনি বরাবরই অনুব্রত-অনুগামী বলে পরিচিত। ‘দাদা’ অনুব্রতের মতোও তিনিও এখন কেন্দ্রীয় সংস্থার নজরে রয়েছেন।
আবার কেরিম-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত জিয়ারুল হক। এই এলপিজি ডিলারের সঙ্গে অনুব্রত-যোগ আছে কি না তা নজরে রয়েছে তদন্তকারীদের। কেরিম খান ঘনিষ্ঠ জিয়ারুলের বাড়িতেও তল্লাশি চলায় ইডি।
বীরভূম জেলার পাথর কারবারের বেতাজ বাদশার নাম টুলু মণ্ডল। এই ব্যবসার সুবাদেই অনুব্রতের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ বলে খবর। অনুব্রতের একাধিক অনুষ্ঠানে টুলুকে দেখা গিয়েছে। সক্রিয় রাজনীতি না করলেও অনুব্রতের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক মঞ্চেও থাকতেন তিনি। ওই ব্যবসায়ীও সিবিআইয়ের নজরে রয়েছে।
অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ আর এক ব্যবসায়ীর নাম সুজিত দে। বোলপুরে একটি হার্ডওয়্যারের দোকান রয়েছে তাঁর। তা ছাড়া গুছিয়ে প্রোমোটিংয়ের ব্যবসা করেন সুজিত। অনুব্রতের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। গরু পাচার মামলার দৌলতে তিনিও তদন্তকারীদের স্ক্যানারে আছেন।
বোলপুর পুরসভার গাড়ি চালক বিদ্যুৎবরণ গায়েনের সম্পত্তি দেখে চমকে গিয়েছেন তদন্তরকারী অফিসাররা। অনুব্রতকে ‘বাবা’ বলে ডাকেন বিদ্যুৎ। সেই বিদ্যুৎ এবং অনুব্রতের মেয়ে সুকন্যা দু’টি কোম্পানির যৌথ ডিরেক্টর। বিদ্যুৎবরণের নামে বল্লভপুর, কালিকাপুর, বোলপুর, সুরুল, জলজলিয়া প্রভৃতি এলাকায় প্রচুর জমি রয়েছে। এর মধ্যে কালিকাপুর মৌজা এলাকাতে ৫৭টি জমি। এ ছাড়াও বোলপুর মৌজায় দু’টি, সুরুল মৌজায় দু’টি, বল্লভপুর মৌজায় সাতটি, কঙ্কালীতলা এলাকার জলজলিয়া মৌজায় ৪টি জমি রয়েছে বলে বোলপুর পুরসভার এই কর্মীর বিপুল সম্পত্তির হদিস পেয়েছে সিবিআই।
বোলপুরের কাউন্সিলর বিশ্বজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়কে আটক করেছে সিবিআই। বোলপুর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলরের কয়েক বছরে বেড়েছে বিপুল সম্পত্তি। গত ৩১ অগস্ট অনুব্রত মণ্ডল-ঘনিষ্ঠ কাউন্সিলর বিশ্বজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে মুনের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে আটক করে সিবিআই। অনুব্রতের বিভিন্ন কাজের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন এই কাউন্সিলর। তাঁকে অনুব্রতের বাড়িতেও প্রায়শই দেখা যেত। এ বারেই কাউন্সিলর নির্বাচিত হন বিশ্বজ্যোতি।
তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিত সুদীপ রায়। অনুব্রতের বাড়ি, দলীয় কার্যালয়ে তাঁর যাতায়াত ছিল। গত অগস্টে একই দিনে অনুব্রতের বাড়ির ঢিল ছোড়া দূরত্বে বোলপুরের শুঁড়িপাড়ায় তৃণমূল কাউন্সিলরের বাড়ি ছাড়াও তৃণমূল কর্মী সুদীপ রায় ও বোলপুরের উকিল পট্টির বাসিন্দা সুজিত দে-র বাড়িতে অভিযান চালায় সিবিআই।
অনুব্রতের হিসাবরক্ষক মণীশ কোঠারির সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা অনুব্রতের। নেতার সমস্ত আর্থিক লেনদেন দেখাশোনার দায়িত্ব এই মণীশের উপরে। বস্তুত, গরু পাচার মামলায় প্রথম বার বোলপুরে গিয়ে এই মণীশকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিবিআই। পাশাপাশি কলকাতার নিজাম প্যালেসে ডেকেও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। অনুব্রতের মেয়েকে সিবিআই সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। তিনি সরাসরি মণীশের নাম নিয়ে জানান, যা তথ্য দেওয়ার উনিই দেবেন।