অসহায় মেয়ের দিন গুজরান! শাসক দলের তরফে নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। তীব্র কটাক্ষ বিজিপির, পাল্টা তৃণমূলের

অসহায় মেয়ের দিন গুজরান! শাসক দলের তরফে নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। তীব্র কটাক্ষ বিজিপির, পাল্টা তৃণমূলের

     

     

     

     

    মালদা : অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় গত হয়েছেন মা, মা-কে সাতমাস সন্তান সম্ভবা রেখে বাবাও সংসার ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন বছর ১৫ আগে। একমাত্র দাদা সেও পাশের গ্রামে বিয়ে করে নিজের সংসার বসিয়েছে। সেই থেকে প্রচন্ড অর্থাভাবে দিন মজুরের কাজ করে একা জীবন সংগ্রামের লড়াই চালাচ্ছে ১৫ বছরের মেয়ে দুলি খাতুন। ঢিল ছোড়া দূরত্বে তৃণমূল নেতা তথা শাসকদলের প্রার্থীর বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও মেলেনি কোনো সরকারি সুযোগ সুবিধা, মেলেনি আবাস যোজনার ঘর। শাসকদলের জন-প্রতিনিধিদের প্রতিবেশী এক মা-বাবা হারা সোমত্ত এক মেয়ে একা লড়াই করে যাচ্ছে অথচ শাসক দলের নেতাদের নজর পড়েনি সেইদিকে। এ নিয়ে রাজনৈতিক তরজার পারদ চড়েছে মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরে। বিজেপির তীব্র কটাক্ষ শাসকদলের দিকে। পাল্টা কটাক্ষ শাসকদলের।

     

    হরিশ্চন্দ্রপুর ১ ব্লকের মহেন্দ্রপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বাংরুয়া নয়াটলা এলাকার বাসিন্দা দুলি খাতুন(১৫)। পাঁচ মাস আগে মা রবিনা খাতুন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রবিনা খাতুনকে একা রেখে তার স্বামী বাড়ি ছাড়ে। সেই থেকে রবিনা খাতুনই এদিক ওদিক দিন মজুরের কাজ করে কোনো রকমে দুই ছেলে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিত। কিন্তু দূর্ভাগ্য বোধহয় কারো কারো পিছু ছাড়ে না। পাঁচ মাস আগে তিনিও গত হন। সেই থেকে একা লড়াই করে যাচ্ছে বছর পনেরোর দুলি খাতুন। তুলসীহাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী সে। দিন মজুরের কাজ করে কোনো রকমে পেটের ভাত জোটায় সে। যেদিন কাজ করতে পারেনা সেদিন জোটেনা ভাত। খাবারের মধ্যে থাকে হয়তো কচু পাতা বা শাক পাতা। এভাবেই কোনোরকমে খেয়ে পরে পড়াশোনার কাজ চালিয়ে যায় সে। ভাই মহম্মদ রুবেল পার্শ্ববর্তী গ্রামে মনোহর পুর গ্রামে বিয়ে করে তার নিজের সংসার শুরু করেছে। দুলী খাতুনের সাথে কথা বলে জানা যায়, একা মেয়ে ভয়ে রাত্রে ঘুমাতে পারেনা সে। ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় বাড়িঘর ভেঙে পড়ার পর থেকে ত্রীপল দিয়ে কোনোরকমে মাথা গুঁজে পড়ে থাকে সে। অনেকবার প্রশাসনের দ্বারস্থ হওয়ার পরও মেলেনি কোনো সাহায্য। রেশনের চাল ও সবুজ সাথী সাইকেল পেলেও মেলেনি আবাস যোজনার ঘর, অন্যান্ন সুযোগ-সুবিধা কিছুই পায়নি সে। এমনকি পায়নি স্বাস্থ্য সাথী কার্ডও। বিনা চিকিৎসায় চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু দেখেছেন সে। অন্যের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে পাছে মানুষ চরিত্রে দাগ লাগায় সেই ভয়ে একাই লড়ে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছে বছর ১৫ এই লড়াকু মেয়ে।

     

    উল্লেখ্য, দুলী খাতুনের বাড়ির ঢিল ছোড়া দূরত্বে বাড়ি তৃণমূল প্রার্থী তাজমুল হোসেনের। যিনি গত বিধানসভায় তৃণমূলের হয়ে লড়েছিলেন এবছরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, এমনকি দীর্ঘদিন হরিশ্চন্দ্রপুর ১ ব্লক প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এছাড়া ওই এলাকাতেই বাড়ি জেলা পরিষদের শিশু, নারী ও ত্রাণ কর্মাদক্ষ মর্জিনা খাতুনের। একজন জন-প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও চোখের সামনে বাবা-মা হারা এক মেয়ে কোনোরকম কোনো সরকারি সুযোগ সুবিধা পায়নি, যার মাথার উপর একটা ত্রীপল ছাড়া কিছুই নেই, সেই পরিবারের দিকে দৃষ্টি যায়নি কেন? প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়রা। যেখানে জন-প্রতিনিধিদের কাজ সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের খবর রাখা সেখানে ১৫ বছরের একটি মেয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছে অথচ নেতাদের চোখে পড়েনি। এলাকাবাসীর দুঃখ দূর্দশার খবরই যদি না রাখেন তাহলে সমগ্র এলাকার মানুষের কী দেখভাল করবেন তিনি? প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী সহ স্থানীয়রা।

     

    সংবাদ মাধ্যমের সামনে ভেঙ্গে পড়ে দুলী। হতাশা নিয়ে জানায়, “খাওয়ার মতো কিছু নেই। আমি মাঠে খেটে কাজ করি। যেদিন কাজ করতে পারিনা সেদিন না খেয়ে থাকতে হয়। মা ক্যান্সারে মারা গেছে। আমি জন্মানোর আগেই বাবাও ছেড়ে গেছে। মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়লে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু বাঁচাতে পারিনি। তাতে যতটুকু সম্বল ছিল তাও চলে গেছে। ২০১৭ সালের বন্যায় বাড়ি যেটুকু ছিল সেটাও চলে গেছে। বহুবার প্রশাসনের কাছে গিয়েছি কোনো সাহায্য পাইনি। তারা বলেছে আমরা কী করবো?”এইদিন এই ১৫ বছরের মেয়ের মুখে করুন আর্তনাদের সুর যেন স্পষ্ট, তার কথায়, “গরিবের জন্য এই পৃথিবীতে কেউ নেই। গরীবকে কেউ আপন বলে মানে না। যাদের কাছে পয়সা তারাই মানুষ। গরীবের কোনো মূল্য নেই। কেউ সাহায্য করার মতো নেই। সেই ভয়ে একা যতটুকু পারি সেটুকু করেই বাঁচি।”

     

    দুলী খাতুনের প্রতিবেশী নুরজাহান বিবি বলেন, “ওরা দুই ভাই বোন। ছেলেটা মাঠাঘাটে কাজ করে। মেয়েটা কোনো রকমে এখানে ওখানে চেয়ে চিন্তে দিন মজুরির কাজ করে দিন চালায়। বাড়ি ঘর বলতে প্লাস্টিকের একটা ত্রীপল। কখন কুকুর, গিদর হামলা করবে তার ঠিক নেই। একটা যুবতী মেয়ে একা একা থাকে, রাতে ভয়ে ঘুমাতে পারেনা। মেয়েটা কোনো সরকারি সাহায্য পায়নি। ওকে প্রশাসনের সাহায্য করা উচিত।”

     

    তীব্র কটাক্ষের সুর চড়িয়ে বিজেপি নেতা কিষান কেডিয়া বলেন, ” দুলি খাতুন যার বাবা মা কেউ নেই। তিনি শাসকদলের ক্যান্ডিডেট তার পাশেই থাকে। যদি ঐ ক্যান্ডিডেট তার নিজের এলাকার মানুষের দেখভাল না করে তখন আসে পাশের মানুষকে কী সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেবেন? তার মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। স্বাস্থ্য সাথী কার্ডেও কোনো সাহায্য পায়নি। বিজেপি ক্ষমতায় এলে সমস্ত মানুষ চিকিৎসার খাতায় আয়ুষ্মান ভারতের কার্ডের আওতায় পাঁচ লক্ষ টাকার সুবিধা পাবেন।”

     

    পাল্টা কটাক্ষ মালদা তৃণমূল সাধারণ সম্পাদক বুলবুল খান বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছি হরিশ্চন্দ্রপুরের যে কোনো মানুষের সাথে থাকার। ঐ জায়গাটা একটু দূরে আমার এলাকা থেকে। আগে আমি এই বিষয়ে জানতাম না, তবে আমি যাবো। তাদের যাবতীয় সমস্যাগুলো দেখে দেওয়ার চেষ্টা করব। সব সমস্যা তো চোখে পড়ে না, আর ঐ এলাকায় অন্য কেউ দায়িত্বে রয়েছেন। আমার ব্যক্তিগত দিক থেকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করব।”

     

    জন-প্রতিনিধিদের নির্বাচন করা হয় মানুষের সুখ দুঃখের বিষয়গুলো তত্বাবধান করার জন্য। দুঃখের বিষয় হলো তৃণমূল নেতা তথা শাসকদলের প্রার্থী তাজমুল হোসেন ও জেলা পরিষদ সদস্যার নাকের ডগায় চোখের জল ফেলছে দুলী, অথচ সেদিকে দৃষ্টি পড়েনি তাদের। চিকিৎসার অভাবে মারা গেলেন একজন অথচ তারা নির্বাক। জন-প্রতিনিধি হয়ে কেন জন-সাধারণের পাশে নেই তারা? উত্তর চাইছেন এলাকাবাসী। যত দ্রুত সম্ভব এই মেয়েটিকে সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছে সকলেই।