লকডাউন কাড়ছে শিক্ষা, বাড়ছে বাল্যবিবাহ

মোহাম্মদ রিপন: ভারতের আকাশে করোনা ভাইরাসের ঘনঘটা, আর এই করোনা অতিমারীর চোখ রাঙানির মধ্যেই বেড়ে চলেছে বাল্যবিবাহ। করোনা মহামারীকে সামলানোর জন্য চলতে থাকা লকডাউন পর্যায়েই দেশজুড়ে বাল্যবিবাহের সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানানো হয়েছে নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের তরফে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা ভাইরাসের বিস্তারের এই সময় বাল্যবিবাহের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। প্রায় দুই বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রাম্য এলাকা গুলোতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছ। লকডাউনে কাজ হারিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক ঘরে ফিরে এসেছে। বর্তমান কাজ করা ছেলে পাত্রর চাহিদা বেশি। আর এই অবরুদ্ধ অবস্থায় বিয়ে দিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন অভিভাবকেরা। করোনা ভাইরাসের জন্য আইন শৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে আর সেই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে কেউ কেউ। পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম জেলাতে সংখ্যালঘু পরিযায়ী দরিদ্র শ্রমিকের সংখ্যা অনেক বেশি। এই তিনটি জেলাতে যথেষ্ট হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বাল্যবিবাহ। 25% শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে 18 বছরের আগেই। 2020 সালে লকডাউনের মধ্যে রাজ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। প্রধান বিচারপতি বলেন, এমন ঘটনা কি অর্থনৈতিক কারণে ঘটছে? না কি এটাও শিশুপাচারের পন্থা? – তা খতিয়ে দেখতে হবে জেলা পুলিশ সুপারদের। সেই সঙ্গে আদালতের নির্দেশ, বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে আইনি পদক্ষেপ করতে হবে।

    এদিকে বীরভূম জেলার পাইকর থানার ইদ্রাকপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে গ্রাম্যস্তরে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়েছে। আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষ বাল্যবিবাহের এরকম খবর পেয়ে প্রশাসনের সহায়তায় নিয়ে অনেক পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছি, বাড়ির কর্তাদের বুঝিয়েছি মেয়েদের শিক্ষা অত্যন্ত দরকার সমাজ ব্যবস্থায়। অনেক অভিভাবককে বোঝানোর পর বিয়ে থামাতে পেরেছি আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। তবে ব্যতিক্রম কিছু ঘটনা ঘটছে যারা লুকিয়ে বিয়ে দিচ্ছে। আমাদের আরও সচেতন হতে হবে যাতে , মানুষকে বোঝাতে হবে যাতে সমাজের এই ব্যাধি নির্মূল করতে পারি। খুব কম বয়সে বাল্যবিবাহের শিকার রাখি( নাম পরিবর্তিত) জানান মাধ্যমিক পাশ করার পর‌ই বাড়ি থেকে পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেয়, উচ্চ শিক্ষার ইচ্ছে থাকলেও হয়ে উঠেনি, এভাবেই আমার মতো কোটি কোটি মেয়ের স্বপ্ন পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই ক্যান্সার স্বরূপ বিবাহ ব্যাধি।

    বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাবার কারণ-

    লকডাউন পর্যায়ে দেশজুড়ে বাড়তে থাকা দারিদ্র্যতা এবং সরকারি আধিকারিকদের করোনা অতিমারী সামলাতেই অত্যধিক ব্যস্ত হয়ে পড়ার সুযোগ নিয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে বাল্যবিবাহ ।তবে কোনও ধরনেরই দুর্যোগ অথবা মহামারী এলে বাল্যবিবাহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে আগেও। দ্রুত সাবধান হওয়ার পরামর্শ খোঁজা উচিত।

    আবার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে , লকডাউনে ঘরের মধ্যে পরিচিত মানুষের মাধ্যমে মেয়ে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার বেশি হচ্ছে এই দিকটাও বাল্যবিবাহ দেওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে অনেক ক্ষেত্রে।

    লকডাউনের সময় দেশজুড়ে সমস্ত বিদ্যালয়গুলি বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল সরকারের তরফে। স্বাস্থ্যবিধির নিরিখে একান্তই প্রয়োজনীয় ছিল সেটা। লকডাউন বিধি মানতে জনস্বাস্থ্য কর্মীদেরও ফিল্ডওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। তবে এক নাগাড়ে প্রায় দেড় বছরের বেশি সময়ে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বাল্যবিবাহ প্রথা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেছে।

    আবার অনেক বাবা মায়ের ধারনা করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হতে পারে। এতে অর্থনৈতিক সংকট আরও দীর্ঘায়িত হবে, তাই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকলে দিয়ে দেওয়াই ভালো। বেশির ভাগ বাবা-মা এলাকায় বিদেশ থেকে আসা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে ইচ্ছুক। আর এ সময় তা পেয়েও যাচ্ছেন।

    আবার এখন করোনা ভাইরাসের কারণে দেশজুড়ে লকডাউন চলছে , জমায়েত করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে প্রশাসন থেকে। এই সুযোগে বিয়ে দিলে খরচ কম হচ্ছে ও জমায়েত এড়িয়ে বিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

    অন্যদিকে ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে মেয়েদের বিয়ে বাল্য অবস্থাতেই হয়ে থাকে, যাদের মধ্যে ১৫ বছর পার হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায় বিহার, রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলিতে।বাল্যবিবাহের ফলে শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক ভাবেও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কম বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েরা। অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের পর আসতে পারে গর্ভপাতের আশঙ্কা। বাচ্চার জন্ম দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারও অপরিণত এবং অপুষ্টির কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।বর্তমানে ভারতীয় আইন অনুযায়ী মেয়েদের ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছরের আগে বিয়ে হওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। বিয়ের পরেও গর্ভবতী হওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের সচেতন করতে আইন না থাকলেও, শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে স্লোগানই করা হয়েছে, আঠেরোর আগে বিয়ে নয়, একুশের আগে মা নয়। তবুও এত প্রচার, টিভিতে, কাগজে কিংবা লিফলেট জুড়ে বিজ্ঞাপনের পরেও কি বদলাচ্ছে ছবিটা সেভাবে? প্রদীপের নিচে অন্ধকার কিন্তু অন্য বার্তাই দিচ্ছে!