|
---|
অনল আবেদিন: তাঁদের সমাজে একজনও রামমোহন ও বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেননি বলে বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে যাঁরা আফসোস করেন, তাঁরা লিখিত ও সম্পাদিত মিলিয়ে মইনুল হাসানের প্রায় অর্ধশত পুস্তক সম্ভারে ডুব দিতে পারেন। মইনুল বাঙালি মুসলমানের রামমোহন, বা বিদ্যাসাগর নন ঠিকই। তবে সেই মহাজনদের মানসিক ও আত্মীক বাঙালি মুসলমান সংস্করণের সঙ্গত প্রতিনিধি বলে মইনুলকে ভাবা যেতেই পারে। বাঙালি সমাজের এই অংশের সময়োচিত সংস্কারের ভাবনায় তিনি অনেক দিন ধরে ভাবিত। সেই সঙ্গত ভাবনার প্রসার ঘটাতে চেয়ে ০১.০৫.২০০২ তারিখে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন মইনুল। ‘মুসলিম সমাজঃ কয়েকটি প্রাসঙ্গিক আলোচনা’ নামের ক্ষীণ অবয়বের সেই পুস্তিকা প্রকাশ করার ‘অপরাধ’- এ তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কঠোর শাস্তিও পেতে হয়েছে। অন্যায় ভাবে, বিরোধীদের মিথ্যাকথনের কারণে সেই অন্যায় শাস্তি নেমে এসেছিল।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো মোট ২০-২২টি মুসলিমপ্রধান দেশের দেওয়ানি আইনে যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত সংস্কার অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে, এ দেশে সেই সংস্কার চেয়ে মইনুল তাঁর সেই অতিক্ষূদ্র পুস্তিকায় প্রস্তাব রেখেছিলেন মাত্র। তাতেই তাঁকে স্বসম্প্রদায়ের (বাঙালি মুসলমান) অনেক কাঠমোল্লা ধর্মীয় শূলে চাপিয়েছেন, অনেক কুৎসা রটিয়েছেন। আবার আজকের আলোচ্য ‘বাঙালি ও মুসলমান’ গ্রন্থটি নিয়ে কাঠমোল্লাদের মতোই কোনও কোনও বাঙালি হিন্দু মইনুলের গায়ে বিশেষ অর্থে ‘মুসলমান’ তকমা সেঁটে দিতে পারেন। অনেকে হককথা সইতে পারেন না। সত্য কথায় তাঁদের গায়ে জ্বালা ধরে। এই গ্রন্থের লেখক মইনুল হিন্দু নন। মুসলমানও নন। তিনি বঙ্গভাষি একজন বাঙালি মাত্র। তাঁর আদিপুরষরাও সবাই আজন্ম এই বাংলার পানি-মাটি-বাতাস মাখা বাঙালি। সাম্প্রদায়িকতদাবাদীরা বরাবর মুক্তবুদ্ধিচর্চাকারীদের কোনও না কোনও ধর্ম সম্প্রদায়ের গর্তে ঠেলে ফেলে দিতে ভালোবাসে। তাই আলোচ্য গ্রন্থে প্রবেশের আগে ‘সেফটি ভালব’ হিসাবে এই কথা ক’টি বলা হল। রাজনীতিক, তার্কিক, প্রবন্ধিক মইনুল হাসানের ‘বাঙালি ও মুসলমান’ নামের প্রবন্ধ সংকলনটি পড়ার সময় বার বার এক বাঙালি মুসলমানের মুখ ভেসে আসছিল। তাই তাঁকে দিয়েই গ্রন্থটির আলেচনা শুরু করা যাক।
গোস্ত না বলে মাংস বলায় তাঁর কাছ থেকে অনেক বার ধমক খেয়েছি। পানি না বলে জল বলায় বকুনি পেয়েছি বিস্তর। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম না বলে ভাতের গ্রাস তুলতেই তিনি মুখের সামনে থেকে থালা টেনে নিয়েছেন প্রায় রপ্ত বার। নাস্তার বদলে টিফিন বললে জলখাবারের প্লেট মুখের সামনে থেকে উধাও হয়েগিয়েছে। বাড়ি থেকে বাইরে যাওয়ার সময় খোদা হাফিজ না বললে তিনি কানমলা দিয়ে বলতেন, “হিন্দুর দেশে থেকে থেকে তোরা হিন্দুর মতো কাফের হয়ে গিয়েছিস! তোদের গুনাহের সীমা নেই। আল্লা তোদের দোজখেও ঠাঁই দেবেন না!” গত শতাব্দীর আশির দশকে তাঁর এই রকম ‘ধর্মীয়’ শাসনে মাস চারেক আমাদের প্রায় সবাইকে শায়েস্তা হতে হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে কি তবে আল্লাচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলব? আমাদের তোলা এই প্রশ্নের প্যাঁচে পড়ে সেই তিনিই আবার হাবুডুবু খেয়েছিলেন। তাঁর আরও দুটো আক্ষেপ ছিল। কয়েক মাস তাঁর চিকিৎসক ছিলেন বহরমপুর শহরের লালদিঘি এলাকার রনজিৎ চক্রবর্তী। তাঁর আড্ডার প্রায় নিয়মিত সঙ্গী ছিলেন বহরমপুরের এসইউসি কর্মী রবীন বিশ্বাস। তাঁরা সবাই আজ প্রয়াত। তিনি আক্ষেপ করে, আল্লার উদ্দেশ্যে দু হাত তুলে প্রায়ই মোনাজাত করার ভঙ্গিতে বলতেন, “হায় খোাদা! এত ভাল দুটো মানুষকে তুমি কাফের করে পাঠিয়েছ? আল্লা তুমি ওঁদের গুনাহ মাফ করে এঁদের জান্নাতবাসী কোরো!” এ সবই প্রায় সাড়ে তিন দশক আগের ঘটনা।
লম্বায় তিনি ছিলেন প্রায় পৌনে ছ’ ফুট। দোহারা সুঠাম দেহ। জীবনের পড়ন্ত বেলাতেও তাঁর দেহের দুধে-আলতা রং অবিকৃত ছিল। অবিবাহিত, ষাটোর্ধ বৃদ্ধার শরীর দিয়ে লাবণ্য যেন ঝরে পড়ত। তাকালেই শ্রদ্ধায় সমীহে মাথা নত হয়ে যেত।। ইরাজি, উর্দু, আরবি ও ফারসি ভাষায় তিনি মাতৃভাষা বাংলার মতো সড়গড় ছিলেন। তবুও উচ্চারণ বিভ্রাটে কারণে কোরান শরিফের কোনও আয়াতের বিকৃত অর্থ নির্গত হলে গুনাহের শেষ থাকবে না! এই বোধে তিনি প্রতিদিন সকালে কোরান শরিফ পড়তেন ইংরেজি ভাষায়। বাইরেটা পাকা নারকেলের মতো নীরস গাম্ভীর্যে মোড়া ছিল তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্ব। আবার এই তিনিই ছিলেন স্নেহের সমুদ্র। তিনি বাংলাদেশের রাজশাহি বিভাগের শিক্ষা দফতরের ডিপিও ছিলেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এদেশে, আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন গত শতাব্দীর আশির দশকে। আমরা তাঁকে টুনি খালাম্মা বলতাম। তিনি আমাদের রক্তের সম্পর্কের, বা বৈবাহিক সম্পর্কের কেউ না। তবু তাঁরা ছিলেন তার থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি আত্মীয়। তাঁদের মতো নিকট আত্মীয় আমাদের আর কেউ ছিল না। আজও নেই।
তাঁর সরকারি নাম আমেনা বেগম। তাঁর আব্বার নাম খান বাহাদুর একরামুল হক। তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলিম জমিদার। আদিবাড়ি বহরমপুর শহরের গোরাবাজার এলাকায় আব্দুস সামাদ রোডে। মুর্শিদাবাদ কংগ্রেসের জেলানেতা প্রয়াত আলি হোসেন মণ্ডলের গোরাবাজার এলাকার বর্তমান বাড়িটা ছিল টুনি খালাম্মাদের আদিবাড়ি। সেই বাড়িতে জায়গির থেকে আমার আব্বা কৃষ্ণনাাথ কলেজে পড়েছেন। দেশ ভাগের সময় তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পর টুনি খালাম্মা এ দেশে বেড়াতে এসেছিলেন। বেড়াতে আসার সুবাদে তাঁর বাঙালি সত্ত্বা ও মুসলমান সত্ত্বার দোলাচল প্রকট হয়ে উঠতে দেখি। আবার তাঁর অন্তরে হিন্দু-মুসলমান সত্ত্বা ও মানব সত্ত্বার মধ্যেও দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রাত্যহিক আচার ব্যবহারে একই রকম অন্তর্দাহ কি বাঙালি হিন্দুর মনেও জ্বালা ধরায়? ঠিক উপরের ৩-৪টি অনুচ্ছেদে জান্নাত, খালাম্মা ও আয়াত- এর মতো আরবি, উর্দু, ফারসি, তুর্কি গন্ধমাখা কয়েকটি শব্দ নিয়ে বাঙালি হিন্দু পাঠকদের বৃহৎ অংশ হোচট খেতে পারেন। ফলে বন্ধনীর ভিতর সহজবোধ্য সমার্থক শব্দ দেওয়া যেতেই পারত। কিন্তু ইচ্ছা করেই দিইনি। সঙ্গত অহংকার থেকেই দিইনি। সেই অহংকার থেকেই মইনুল হাসানের ‘বাঙালি ও মুসলমান’ গ্রন্থটির জন্ম।
ভারতবর্ষকে দুশো বছর ধরে শাসন, শোষণ ও লুণ্ঠন করেছে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ। অথচ আপনারা ড্যাডি, মাম্মি, আন্টি ও কাজিন গর্বের সঙ্গে বুঝতে পারেন ও প্রয়োগ করতে পারেন। পাশাপাশি ৮০০ বছর বসবাস করা মুসলমান শাসকদের কল্যাণে এদেশের সঙ্গীত, চিত্রশিল্প, শাসন পদ্ধতি ও সুফিবাদের সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতিতে অসামান্য সমৃদ্ধি ঘটেছে। ইংরেজদের মতো লুণ্ঠন করে বিদেশে পাড়ি না দেওয়া এই মুসলমানদের খালা, ফুফু, আপা, নানি, নানা বুঝবেন না কোন মেকী অস্মিতার অহংকারে? গোমাংস ভক্ষণকারী মুসলমান অচ্ছুৎ। একই সঙ্গে গোমাংস ও শুয়োরের মাংস ভক্ষণকোরী খ্রিস্টানরা গলার মালা হয় কোন ঠুনকো অস্মিতার কারণে? ‘বাঙালি ও মুসলমান’ নামের প্রবন্ধ সংকলনে সেই মেকী অহংকারের দিকে সঙ্গত কারণেই আঙুল তুলেছেন মইনুল হাসান।
মৌসুমী বিশ্বাসের প্রচ্ছদ ভাবনার দু’ মলাটের এই গ্রন্থে মোট ৬টি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রবন্ধগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘উদার আকাশ’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থের ১২০ পৃষ্ঠায় বিধৃত রয়েছে প্রাক্তন সাংসদ, তথা রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক মইনুল হাসানের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভব। ভুল হল। এই অভিজ্ঞতা ও অনুভব কোনও না কোনও ভাবে এই বঙ্গের বাংলাভাষি প্রায় সব মুসলমানেরই। সংখ্যায় নগন্য হলেও এই অনুভব ও অভিজ্ঞতা বাংলাভাষি কোনও কোনও হিন্দুরও বটে!
বাঙালি হিন্দু এলাকায় বাঙালি মুসলমানের জন্য সাধারণত বাড়ি ভাড়া মেলে না। ডানপন্থীদের কথা থাক। মার্কসবাদ কপচানো ‘বামপন্থী’ নামধারী ‘রামরেড’দের বাড়িতেও ভাড়া মিলে না। এখানে জনান্তিকে বলে রাখি, ২০১৯ সালের লোকসভার ভোট থেকে কমরেডরা ‘রামরেড’–এ নিজেদের চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। ০৪.০৪.২১ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মানিক সরকারের ভাষণটা পড়লেই চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হবে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে অবশ্য ‘কংরেড’ হওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। মাত্র কয়েক দিনের সেই চেষ্টা সফল হয় নাই। কংরেডরা তাই আবারও রামরেডেই নিজেদের স্বস্তি খুঁজে নিয়েছেন। লোকলজ্জায় বাইরে ও কথনে ‘কংরেড’ থাকলেও অন্তরে ও কর্মে তারা ‘রামরেড’!
মুসলমানকে বাড়ি ভাড়া দিতে না পারার কারণ হিসাবে রামরেডদের মুখেও ‘ঠাকুরমা’, ‘পিসিমা’ নামের সনাতনী অজুহাত সদা সর্বদা প্রস্তুত। “ও পিসিমা! ও ঠাকমা! ওদের হাতে তৈরি আখের গুড়ে বা, নলেনগুড়ের পাটালি ও আতপ চাল দিয়ে তোমার দেবপুজোর ভোগের পায়েস রান্না হয় গো! ওদের ফলানো গোবিন্দভোগ চাল ও মুগডালে রান্না করা মা-দুগ্গার অষ্টমীর ভোগ, মা-রক্ষাকালীর ভোগের খিচুড়ি, আহা মন মাতানো সেই সুবাসের কোনও তুলনা হয় নাকি গো! ওদের তৈরি মণ্ডপেই আমাদের দেবদেবীরা অধিষ্ঠান করেন। বেলডাঙার মুসলমানদের সংগ্রহ করা চুল দিয়ে তৈরি নকল চুল কেমন শাভা পায় মা-ভগবতীর মাথায়! কলকাতার খিদিরপুরের মুসলমান দর্জিদের সেলাই করা চুড়িদার পুজোর দিনগুলোয় আমাদের মেয়েদের শরীর কী পরম মমতায় জড়িয়ে থাকে গো! ওদের বরজের পান চিবিয়ে মুখ কেমন রাঙা কর মাসিমা, তোমরা! তবু ওদের ঘরভাড়া দেবে না! ওরা তো পাশের ঘরে থাকবে। আমাদের রান্নাঘরে, ঠাকুরঘরে, শোয়ারঘরে ওরা ঠুকবে না। ওদের বাড়ি ভাড়া দিলে, ফ্লাট বিক্রি করলে কী অসুবিধা হবে গো তোমার?” এইটুকু যারা শত বছরেও ঠাকমা, পিসিমা, মাসিমাকে বোঝাতে পারেনি তারাই আবার আমজমনতাকে দাস ক্যাপিটাল, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, শ্রেণি সংগ্রাম, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বোঝানোর দুরূহ দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে! হায় কপাল! বঙ্গজীবনে এর চেয়ে ট্রাজেডিমূলক করুণ রঙ্গ-রসিকতা আর কী-ই বা হতে পারে? মইনুল হাসান তাঁর গ্রন্থে সেই সঙ্গত প্রশ্নটাই তুলেছেন।
পত্রিকা সম্পাদনা করা, গল্প-কবিতা লেখা, চুন-কালি মেখে নাটমঞ্চে বিপ্লবী বকুনির তুফান তোলা, গণসঙ্গীতের মূর্ছনায় সাম্যবাদী বিবেক জাগ্রত করার মহড়া দেওয়া, চিত্রচর্চায় জয়নুল আবেদীন হওয়ার স্বপ্ন দেখা, কাব্যপাঠের আসরে ‘গুরুর গা ধুইয়ে’ দেওয়া, ও ‘এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান…’ আবৃত্তি করা উচ্চমার্গীয় সাংস্কৃতিক বোদ্ধাদের ক্ষেত্রেও রামরেডদের বিধবা ‘ঠাকমা’, ‘পিসিমা’র ফর্মুলায় সম্প্রীতির অঙ্ক দিব্বি মিলে যায়, রামরেড! বিশেষ এলাকায় মুসলমানদের জন্য বাড়ি ভাড়া নেই, ফ্ল্যাট ও জমি বিক্রি নেই। এ ক্ষেত্রে ডানপন্থী গাঁধীবাদী ও বামপন্থী মার্কসবাদীদের মধ্যে মঞ্চের ভাষণ, মিছিলের স্লোগান আর পতাকার রং- এর ভিন্নতা ছাড়া ব্যবহারিক জীবনে একচুলও ফারাক নেই। আণুবীক্ষণিক যন্ত্র দিয়ে কোনও বিরল ব্যতিক্রম হয়তো মিলতে পারে। এই ব্যতিক্রম তো বাস্তবের সর্বজনীনতাকেই প্রতিষ্ঠা করে। এ সবের সঙ্গত উপস্থাপনা আছে মইনুলের প্রবন্ধে।
এই বিষবৃক্ষ যে শতবর্ষেরও আগে বাংলার মাটিতে পোঁতা হয়েছিল, সে কথার সাবুদ মইনুল দিয়েছেন কংগ্রেসের হুগলি জেলা সভাপতি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ (১৯১৭) উপন্যাসের প্রথম পাতা থেকে উদ্ধৃত করে। সেখানে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বামুন শরৎচন্দ্র বঙ্গভাষিকে মুসলমান ও বাঙালি, এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন। অর্থাৎ তাঁর মতে বঙ্গভাষি মুসলমানরা বাঙালি নয়। ৮০০ বছর পাশাপাশি বাস করেও বঙ্গভাষি মুসলমানরা বঙ্গভাষি হিন্দুর চোখে উর্দুভাষি মুসলমান হয়েই রইল। এর নেপথ্যে রয়েছে অষ্টাদশ শতক ও উনবিংশ শতকে মাদ্রাসা ও মক্তব নির্ভর বাঙালি মুসলমানের ইংরেজি ও বাংলা শিখতে না চাওয়ার আত্মঘাতী মুর্খামি। পাশাপাশি রয়েছে প্রতিবেশী উভয় সম্প্রদায়ের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির মধ্যে সম্পৃক্ত হয়ে থাকা প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন সাম্প্রদায়িক চেতনার অভিমুখ। হিন্দু জাতীয়তাবাদী শরৎচন্দ্র অন্যত্র লিখেছেন, “হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ। সুতরাং এ দেশকে অধীনতার শৃৃ্ঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই।”
কিন্তু একা হিন্দু তো এ দেশ স্বাধীন করেনি। আসফাকুল্লা, তীতু মির ও অনুশীলন সমিতির রাহিলা খাতুনদের মতো অনেক মুসলমান শামিল ছিলেন স্বাধীনতাযজ্ঞে। এ তো গেল হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু মইনুল তো তাঁর জীবনের স্বর্ণোজ্বল অধ্যায়ের সবটাই ব্যয় করেছেন শতাব্দী প্রাচীন ‘মার্কসবাদী’দের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, লড়াই সংগ্রামের ময়দানে ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে। তবুও একই সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার করা তাঁর ‘রামরেড’দের কাছ থেকে বাঙালি মইনুলকে শুনতে হয়, তাঁর মাতৃভাষা উর্দু হওয়া সত্ত্বেও ‘বাংলা ভালোই বলেন’! এমএ পাস ছেলের চাকরির একান্ত আব্দার জানাতে লুঙ্গি-দাড়ির প্রৌঢ় অপেক্ষা করেন ‘ঘরের ছেলে’ মইনুলের ‘অসাম্প্রদায়িক মঞ্চ’ থেকে নেমে আসা পর্যন্ত। দীর্ঘক্ষণ মঞ্চ আলো করে থাকা ‘সাম্যবাদী’ ব্যানার্জি-ভট্টাচার্যদের মতো বড় নেতারা শতবর্ষ পরেও লুঙ্গি-দাড়ির ‘ঘরের লোক’ হতে পারেননি। মইনুলের তখন মর্ম বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। বাস্তব কারণেই, রক্তক্ষরণের এই যাতনা বাস্তব পরিস্থিতির কারণে অনল আবেদিনের পক্ষে যতটা উপলব্ধি করা সম্ভব, ততটা অনল অধিকারীর পক্ষে সম্ভব নয়।
জীবনের প্রায় ছয় দশক খরচ করার পর মইনুল বুঝতে পেরেছেন তাঁর আজন্মলালিত দলের সাম্প্রদায়িক চর্চার নিভৃতকথা। হয়তো আরও আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। সে কথা তিনি স্বল্পাক্ষরে উল্লেখও করেছেন এই গ্রন্থে। সেই নির্দয় বাস্তব কিন্তু আরও বৃহৎ, আরও ব্যাপক ও আরও মর্মভেদী। ছাপানো পার্টি পুস্তিকায়, পার্টি দলিলে, মঞ্চে ও মিছিলে ঘোষণা যা-ই করা হোক না কেন, বাস্তবে বামুন-কায়েতের বগলদাবা থাকা তাঁর প্রাক্তন দল ব্যবহারিক জীবনে আরএসএসের সহোদর। নইলে, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মুখ্যমন্ত্রীত্বের আমলের সংখ্যালঘুদের ১০% সরকারি চাকরি ২৭% এর দিকে এগিয়ে না গিয়ে সিপিএমের ৩৪ বছরে শাসনে উল্টোপথে ৪.২%- এ (২০১১ সালের সরকারি পরিসংখ্যান) নেমে গিয়েছে কোন সাম্প্রদায়িক যাদুর গুণে? সাচার কমিটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার পরও রাজ্যের ২৭% মুসলমানের জন্য আনুপাতিক হারে মাধ্যমিক পাশ কন্সটেবলের চাকরিটুকুও জোটেনি। এই সঙ্গত প্রশ্ন তুললেই সাম্প্রদায়িক বলে দাগিয়ে দেবেন রামরেডরা? মনুবাদী ভারতীয় কমিউনিস্ট দলের শতবর্ষের ইতিহাস আসলে মহিলা, দলিত, তপশিলি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বঞ্চনার ইতিহাস।
জাতীয়তাবাদী দল কংগ্রেস থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ইন্দিরা গাঁধী, রাষ্ট্রপতি হয়েছেন প্রতিভা পাতিল, রাজ্যপাল হয়েছেন পদ্মজা নাইডু, মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন শীলা দীক্ষিত, সুচেতা কৃপালিনী, নন্দিনী শতপথি ও আনোয়ার তৈমুর। মুর্শিদাবাদ জেলাপরিষদের সভাধিপতি হয়েছেন সিদ্দিকা বেগম। আঞ্চলিক দল তৃণমূল থেকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এআইএডিএমকে থেকে জয়ললিতা, বিএসপি থেকে মায়াবতী, লালুপ্রসাদের দল থেকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন রাবড়ি দেবী। মনুবাদী দল বিজেপি থেকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন সুষমা স্বরাজ, উমা ভারতী, বসুন্ধরাজে সিন্ধিয়া, আনন্দিবেন প্যাটেল। কাশ্মীরের মুসলিম দল থেকে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মেহবুবা মুফতি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হয়েছেন রেজাউল করিম। দলের রাজ্য ও জেলা কমিটির সভাপতি এবং জেলাপরিষদের সভাধিপতি পদ মুসলিমরা অলঙ্কৃত করেছেন, কংগ্রেস ও তৃণমূলের পকেটে এ রকম আরও উদাহরণ মজুত আছে।
এবার আসি ‘ইন্টার ন্যাশানাল’ গাওয়া ‘আন্তর্জাতিকতাবাদী’ মাকর্সবাদী কমিউনিস্টদের মুখস্থ সিলেবাসে ও তার প্রয়োগে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও ত্রিপুরা মিলিয়ে মোট ২২ বার সিপিএমের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। প্রতিবারই কিন্তু পুরুষ। এবং বলাই বাহুল্য, তাঁরা প্রায় সবাই বামুন কায়েত। একবারও কোনও মহিলার জন্য শিঁকে ছেড়েনি। তিনটি রাজ্যে জেলাপরিষদের কয়েক ডজন সভাধিপতি পদের মধ্যে সংরক্ষণের জন্য বাধ্য হয়ে মাত্র ২ বার ব্যতিক্রম হয়েছে। দুই মহিলা— নদিয়ায় রমা বিশ্বাস ও মুর্শিদাবাদে পূর্ণিমা দাস। আর এক বার ধর্মীয় সংখ্যালঘু। তিনি বর্ধমানের মেহেবুব জাহেদি। সংখ্যালঘু ও দলিতদের ক্ষেত্রে বরাবর একই রকম বৈষম্যমূলক বিচারবোধ দেখিয়েছে সিপিএম। দলের রাজ্য কমিটির ও জেলা কমিটির সম্পাদক পদগুলোর ক্ষেত্রেও বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে শতবর্ষেও বামুন-কায়েত-বদ্দ্যিদের পুরুষতান্ত্রিক মনুবাদী গণ্ডীর বাইরে যেতে পারেনি এদেশের ‘কমিউনিস্ট’রা! ফলে বিজেপি ও সিপিএমকে এক লাইনের মনুবাদী দল বললে কিছুটা ভুলই বলা হবে। বাস্তব বিচারে সহোদর আরএসএস-বিজেপির থেকেও ‘বামপন্থী’রা এ ক্ষেত্রে অধিকতর কট্টোর ব্রাহ্মণ্যবাদী। অধিকতর কট্টর মনুবাদী।
হিসাব-তথ্য-পরিসংখ্যান-ইতিহাস তাই তো বলছে। সিপিআই-এর মতে ১৯২৫ সালে আরএসএসের জন্মের প্রায় সমসময়ে কানপুরে পার্টি কনফারেন্সে এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম। সিপিএমের মত, সোভিয়েত রাশিয়ার তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২০ সালে। মানবেন্দ্রনাথ রায় ও তাঁর স্ত্রী, অবনী মুখোপাধ্যায় ও স্ত্রী এবং মহম্মদ শাফিক সিদ্দিকী- সহ মোট ৯ জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের মধ্যে রফিক আহমেদ, মহম্মদ আলি ও সুলতান আহমেদ খান তারিন মিলে মোট ৪ জন ছিলেন মুসলিম পরিবারের সন্তান। এর পর এমএন রায়ের উদ্যোগে দেশের ৬টি প্রদেশে ৫ নেতার নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক কাজ শুরু হয়। ওই ৫ জনের মধ্যে মুজফ্ফর আহমেদ, শৌকত উসমানি ও গুলাম হোসেন মিলে মোট ৩ জনই মুসলিম পরিবারোর সন্তান। বামুন-কায়েত-বদ্দ্যি নিয়ন্ত্রিত শতবর্ষ প্রাচীন ‘কমিউনিস্ট’ দলের নেতৃত্বকারী স্থান থেকে মুসলমান নামধারী নেতারা বজ ভ্যানিস। মার্কসবাদী ‘কমিউনিস্ট’দের এই মনুবাদী সংস্কৃতি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মেনেই বাঙালির জীবনচর্চায় সাম্প্রদায়িক ভাবনার প্রভাব ফেলেছে।
সেই সঙ্গে হাঁসজারু চরিত্রও অর্জন করেছে এই ‘মাকর্সবাদী’ দলটি। নিরীশ্বরবাদী এই ‘মার্কসবাদী’ দলের নেতামন্ত্রীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও তারাপীঠে পুজো দিতে যায়। বাবা বালক ব্রহ্মচারীর শিষ্যদের তাঁরা পাণ্ডা হতে পারেন। ডারউইনের বিবর্তনবাদের প্রচারের জন্য বিজ্ঞান মঞ্চের কর্তা হওয়ার পাশাপাশি আদম-ইভ থেকে মনুষ্য সৃষ্টির ধর্মীয় ব্যাখ্যা গেলানোর জন্য হজও করা যায়। ধার্মিক অথবা নাস্তিক হওয়া ব্যক্তির অভিরুচির বিষয়। তাতে কোনও অন্যায়ও দেখি না। কিন্তু হাঁসজারু বিষয়টির মতো ভণ্ডামির সঙ্গে সততার দূরতম কোনও যোগ দেখি না। অন্য রাজনৈতিক দলের মহিলা ও সংখ্যালঘুদের মাথায় ঘিলু থাকায় তাঁরা সেই সব দলের ও দল নিয়ন্ত্রিত সরকারি পদ অলঙ্কৃত করতে পারেন। অ্য দিকে সিপিএমের দলিত, তপশিল, মহিলা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মাথায় বুঝি গোবর পোরা থাকে! তাই না? তাই তাঁরা দল নিয়ন্ত্রিত সরকারের ও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ সহসা পায় না। বঙ্গের রামরেডদের শতাব্দী প্রাচীন এই অসম ও খিচুড়ি মার্কা রাজনৈতিক চর্চার কারণেই জন্মগত ভাবে বঙ্গভাষি দলীয় সতীর্থরা পারিবারিক ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে হয়ে যায় উর্দুভাষি।
এ বিষয়ে অবশ্য বাঙালি মুসলমানেরও দায় কম নেই। এ বিষয়ে নওয়াব আব্দুল লতিফ (১৮২৮-১৮৯৩) এর পথ অনুসরণ করেন জাস্টিস স্যার সৈয়দ আমির আলি (১৯৪৯-১৯২৮) ও তাঁর অনুগামীরা। তাঁদের উর্দু প্রীতি ছিল বেশ উগ্র। এই প্রসঙ্গে আলোচ্য গ্রন্থে যথার্থভাবে ভাবেই আমির আলির ভূমিকার উল্লেখ করেছেন প্রাবন্ধিক। তবে এই প্রসঙ্গটি আরও বেশ কিছুটা পরিসর দাবি করে। প্রাবন্ধিক এ ক্ষেত্রে বেশি তাড়াহুড়ো করেছেন। আব্দুল লতিফ, আমির আলি ও তাঁদের সহযোগীরা ছিলেন আশরাফ (অভিজাত) শ্রেণির মুসলমানদের শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধি। তাঁরা বাঙালিত্ব নয়, প্যান ইসলামের পুজারি ছিলেন। উর্দুকেই বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষার মর্যাদা দিতে তাঁরা তৎপর ছিলেন। বাঙালি মুসলমান জাতিসত্ত্বার গবেষক খাজিম আহমেদ তাঁর ‘বাঙালি মুসলমানঃ মর্যাদার সন্ধানে’ শীর্ষক গবেষণামূলক দীর্ঘ প্রবন্ধে তথ্য সহযোগে লিখেছেন, “আশরাফ মুসলমানরা কথা বলতেন উর্দু ভাষায়। লিখতেন ফার্সি ভাষায়। বাংলাভাষাকে তাঁরা ঘৃণা করতেন। কিন্তু সাধারণ বাঙালি মুসলমানরা বাংলা ভাষাকে ‘মুসলমানি বাংলা’ ভাষায় রূপান্তরিত করে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন।” এই বঙ্গে বর্তমানের ‘মুসলমানি বাংলা’র ক্ষীণ আভাস মিলবে ‘পুবের কলম’ পত্রিকায়। আজকের দিনে সেই ভাষা কতটা কাম্য, তা নিয়ে অবশ্য আলোচনার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। যে কোনও দেশে, যে কোনও ভাষার শরীরে, যে কোনও ধর্মের জোব্বা পরানোটা সুকর্ম হতে পারে না। তা আদতে বিদ্বেষ ও বিভেদ ডেকে আনে। মইনুলের মূল প্রতিপাদ্য এই জরুরি ভাবনাটিও।
মীর মোশারফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২), রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) ও এস ওয়াজেদ আলি (১৮৯০-১৯৫১)- দের মতো তৃতীয় ধারার লেখকরা সাম্প্রদায়িক ভাবনালালিত হিন্দুয়ানি ও মুসলমানি উভয় ধারা থেকেই দূরত্ব বজায় রেখে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবা করেছেন। ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৯৪), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৩-১৮৯৪), রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯)-দের মতো হিন্দু পুনরুত্থবাদীদের প্রতিষ্ঠিত ‘মহাহিন্দু সমিতি’র মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নেয় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ (১৯১১) ও মোহাম্মদ শহিদুল্লা (১৮৮৫-১৯৬৯) সম্পাদিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র মতো অনেক সংস্থা। ১৯১৮ সালে তৃতীয় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে ‘দৈনিক আজাদ’- এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) প্রশ্ন তোলেন, “দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কি? উর্দু না বাঙলা? এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত।” ‘আল ইসলাম’ পত্রিকার সম্পাদক ইসমাইল হোসেন সিরাজী ১৯২০ সালে লেখেন, “কিছু সংখ্যক হিন্দু লেখক যেমন মুসলিমবিরোধী মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি কতিপয় মুসলমান লেখক হিন্দুবিরোধী মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।”
আবার ভারতীয় মুসলমানদের সম্পর্কে ভারতীয় হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষত বাঙালি হিন্দুর দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে নীরদ সি চৌধুরী (১৮৯৭-১৯৯৯) বলেছেন, “রামমোহনের (১৭৭২-১৮৩৩) পর এমন একটি বাঙালি (হিন্দু) অধ্যাপক, ধর্মসংস্কারক বা রাষ্ট্রনেতার নাম জানিনে যার ইসলাম বা তার কোনও বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছিল। মুঘল শাসন শেষ হওয়ার পর হিন্দু সমাজ ইসলামের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে।” (আব্দুল মওদুদ লিখিত ‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর’ গ্রান্থে এই বক্তব্য ব্যবহৃত হয়েছে।) এই ভাষ্যের মধ্যে আংশিক বাস্তবতা থাকলেও পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। সংখ্যায় অপ্রতুল হলেও রামমোহন রায় ছাড়াও দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) ও ক্ষিতিমোহন সেনদের (১৮৮০-১৯৬০) মতো বেশ কিছু হিন্দু বাঙালি মনীষী আন্তরিকতার সঙ্গেই ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানি সংস্কৃতির চর্চা করেছেন। বরং বর্তমানেই সেই ধারাটি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর আকার নিয়েছে।
যাত্রা, নাটক, উপন্যাস, গল্প, টিভি, সিরিয়াল, সিনেমা ও স্কুল-কলেজের সিলেবাসের সৌজন্যে বাঙালি হিন্দুর ধর্ম-সংস্কৃতি বিষয়ে বাঙালি মুসলমান কিছুটা জানলেও, বাঙালি মুসলিম সম্পর্কে প্রতিবেশী সম্প্রদায় প্রায় কিছুই জানে না। বরং উল্টোটাই জানে। কামানো গোঁফের টুপি-দাড়ি-লুঙ্গি সমৃদ্ধ বাবুর্চি, দারোয়ান, গাড়ির চালক, নৌকার মাঝি খুনি ও পকেটমার মার্কা ভিলেন মানে খলচরিত্রের অভিনেতা ছাড়া আজও অন্য চরিত্রে বাঙালি হিন্দু পরিচালিত সিনেমা, নাটক, গল্পে ও টিভি সিরিয়ালে খুঁজে পাওয়া যাবে না। জীবনের উপান্তে ছেড়ে আসা তাঁর আকৈশোর লালিত ‘কমিউনিস্ট’ পার্টি অফিসের অভ্যন্তরে এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিষের বিষাক্ত প্রাকটিসের ব্যতিক্রম দেখেননি মইনুল হাসান। আবার আমরা ফিরে যাই মূলে।
মুসলিম সাহিত্য, নাকি হিন্দু সাহিত্য? মাতৃভাষা উর্দু, নাকি বাংলা? এ জাতীয় নানা বিষয় নিয়ে আঠারো শতকের অন্তিম পর্ব থেকে বিশ শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত তীব্র ভাঙাগড়া চলেছে। সেই ভাঙাগড়ার ইতিহাস আসলে মহানদী সমতুল। খাজিম আহমেদ বলছেন, “১৯০০-১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মুসলিম সম্পাদিত শতাধিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।” এই তথ্যেই সেই তুফান তোলা ভাঙাগড়ার কিঞ্চিৎ অনুভব করা যায়। এই তুচ্ছ পরিসরে ‘অন্ধের হস্তিদর্শন’- এর মতো গন্য হবে বলেই সম্ভবত এই গ্রন্থে সেই ভাঙাগড়া পর্বের আলোচনার গভীরে প্রবেশ করেননি মইনুল ইসলাম।
পূর্ব-পাকিস্তান এখন অবলুপ্ত। ৫০ বছর আগে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন স্বার্বভৌম স্বতন্ত্র বাংলাদেশ।। তারপর থেকে এপার বাঙলার বাঙালি মুসলমান সমাজের মনন জগতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। তারা বাংলাদেশের জন্মের আগের সময়ের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে বাংলা সংস্কৃতির মূল ধারায় মিলে যেতে চায়, মিশে যেতে চায়। আন্তরিক ভাবেই। আর্থ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা মেনেই। কিন্তু এ পার বাঙলার বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বৃহৎ অংশ কখনও জ্ঞাতসারে, কখনও অজ্ঞাতসারে প্রতিপদে বাঙালি মুসলমানকে মনে করিয়ে দেয়, ‘তুমি অপর’, ‘তুমি বাঙালি নও’, ‘তুমি অবাঙালি’। কয়েক শতাব্দী ধরে বংশ পরম্পরায় এই বাংলার মাটিত জন্ম নেওয়া, বেড়ে ওঠা বঙ্গভাষি মুসলমানকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, “তুমি এদেশের নও!” নাগরিক বাংলায় কথা বলা মইনুলের মতো অনেক বাঙালিকেই তাই পদে পদে শুনতে হয়, “ও আপনি মুসলমান! বুঝতেই পারিনি। আপনার কথাবার্তা এমন যেন আপনি বাঙালি!” এই অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে। এখনও হয়। একবার এমন অভিজ্ঞতার সামনে পড়ে ভদ্রতার আবরণ অক্ষত রাখতে পারিনি। আমি পাল্টা সটান বলেছিলাম, “বাঙালি মুসলমানদের মাথায় দুটো সিং থাকে বলে মনে করেন নাকি? জানেন, ওপার বাংলার বাঙালি মুসলমানের আত্মবলিদানের কারণেই আজ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাঁদের রক্তের বিনিময়ে আজ বিশ্বে বাংলাভাষার জন্য মহৎ আসনটি পাতা আছে। এই জরুরি কথাটি বাঙালিকে মনে করিয়ে দিয়েছে ‘বাঙালি ও মুসলমান’ গ্রন্থটি। মইনুলের এই অতি জরুরি গ্রন্থটির ঠিকঠাক সুতো আলগা করতে হলে, এই গ্রন্থের সমআয়তনের আরও ৩-৪টি পুস্তকের পরিসর প্রয়োজন। তিনি বাঙালি জাতিসত্ত্বা ও বাঙালির ধর্মসত্ত্বার নানা দিকের উৎসমুখ উন্মোচন করেছেন। সেই এক একটি উৎসমুখ ধরে এগিয়ে গেলে এক একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচিত হতে পারে। তাই আলোচনা অসম্পূর্ণ রেখেই ছেদ টানতে হবে। তবে তার আগে আর মাত্র দু একটি বিষয় ছুঁয়ে যাব।
কোনও মুসলমান নামের সঙ্গে জঙ্গিযোগের কথা উঠলেই, বাস্তব-অবাস্তব, সত্য-মিথ্যার কোনও রকম বাছ-বিচার না করেই এদেশের সংবাদমাধ্যম ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো হামলে পড়ে। যেন বহুদিন অভূক্ত থাকার পর হরিণের মাংসের ভুরিভোজের আয়োজন সামনে হাজির। সে ২০১৪ সালের খাগড়াগড় বিষ্ফোরণকাণ্ডই হোক, বা ২০২০ সালে ডোমকল মহকুমায় আল-কায়দা যোগের ‘আবিষ্কার’ই হোক না কেন! ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মালিক ও কর্মী নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার সচেতন অসততার দৌলতে রানিনগরের পারিবারিক শৌচালয়ের ৭-৮ ফুট দীর্ঘ সেপটিক ট্যাঙ্ক হয়ে যায় বাংলাদেশে যাওয়ার ২০-২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ গোপন সুড়ঙ্গপথ এবং লালগোলার মকিমনগর গ্রামের জনাকীর্ণ এলাকার বেসরকারি বালিকা মাদ্রাসা হয়ে যায় জঙ্গিদের আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ২০২০ সালে তবলিগ জামাতের সদস্যদের উপর দিল্লি- সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর মিথ্যা অভিযোগ প্রচার করতে তুমুল ব্যস্ত ছিল ভারতীয় মিডিয়ার এক বৃহৎ অংশ। নিজের পরিবার, নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকজন নারাজ হলে করোনা আক্রান্তের দেহ হিন্দু ধর্মের বিধান মেনে সৎকার করেন আদালতের রায়ে বেকসুর খালাস পাওয়া তবলিগ জামাতের সদস্যরা। আগের বাক্যে উল্লিখিত এই মিডিয়াকুল তখন অনুসরণযোগ্য, দৃষ্টান্তমূলক এই সৎকারের খবর কিন্তু করে না। ‘পুবের কলম’ না থাকলে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষ এই লোকহিতৈষণার কথা বাঙালিরা জানতেই পারতাম না। তাই জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক মনস্তত্ব বিভাগের প্রধান জেরাল্ড পোস্ট তাঁর ‘দ্যা মাইন্ড অব এ টেররিস্ট’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, “সন্ত্রাসবাদ মূলত গণমাধ্যমের বিষয়। গণমাধ্যমের মধ্য দিয়েই আপনি এর চেহারা দেখতে পান।” (বন্দিমুক্তি কমিটির নেতা ছোটন দাসের সৌজন্যে প্রাপ্ত) অনেকেই জানেন না, জঙ্গিযোগের ক্ষেত্রে অনেক সময় দুর্গম এলাকার গ্রাউন্ড জিরো থেকে পাঠানো সংবাদ পরিবেশন করা হয় না। শীততাপনিয়ন্ত্রিত দালানের ভিতরে ‘ডেস্ক’ নামের পাটাতনের সামনে বসে থাকা পরমেশ্বরতুল্য সাব-এডিটররা বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন খবর ‘তৈরি’ করে। এবং মহানন্দে তা পরিবেশন করে।
রাজ্যের ২৭% মুসলিম। অথচ দূুটো ইদ, একমাস রোজা, পক্ষকালের মহরম, বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম বিপ্লবী চিন্তানায়ক হজরত মহম্মদের জন্মমৃত্যু দিনের উৎসব-তাৎপর্যের কোনও চিহ্ন মেলে না এ রাজ্যের মিডিয়ায়। এ রাজ্যে খ্রিস্টানরা ০.৬% হওয়া সত্ত্বেও বড়দিন নিয়ে পক্ষকাল ধরে মিডিয়ার ব্যস্ততার অভাব থাকে না। এই হককথা তুললেই সাম্প্রদায়িক হতে হবে। এই প্রসঙ্গের পাশাপাশি মিডিয়ার কর্মী হিসাবে বাঙালি মুসলমানের প্রায় শূন্য উপস্থিতি। মুসলমান কবি গল্পকারদের অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের প্রসঙ্গ তুলে সত্যনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছেন মইনুল হাসান। মেধাবী পড়ুয়ারা এখন আর সরকারি জলপানি পান না। তার বদলে পান স্টাইপেন্ড। নিজেদের অনেকটা ভেঙেছেন বলেই বাঙালি মুসলমানের ঘরে আজ লক্ষ্মী বিবি, রাহুল শেখ, সুচিত্রা খাতুন, সুমন আবেদিন, বেহুলা বিবি, মিলন হক বাবু, জার্মান শেখ আকছার মিলবে। বাঙালি হিন্দুর ঘরে মিল্টন চক্রবর্তী, স্যামুয়েল ভট্টাচার্য ও বেবি চ্যাটার্জি মিললেও আব্বাস দত্ত, মিনারুল পুরাকায়স্থ, দিলখুসা ব্যানার্জি মিলবে না। ৮০০ বছর পাশাপাশি বাস করেও না। সেই প্রশ্নটিই জাগিয়ে দিয়েছে মইনুলের এই জরুরি গ্রন্থটি।
টুনি খালম্মার মতোই টুনি মাসিমার হৃদয় কন্দরে চেতনার সেই দ্বিধা, মানবিকতার সেই কম্পন সৃষ্টির জন্য খুবই প্রয়োজন, শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’র ৩ বছর আগে ১৯১৪ সালে ‘প্রকাশিত’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘লোকহিত’ প্রবন্ধটির নিবিড় চর্চা। ‘লোকহিত’ আত্মস্থ করলে বঙ্গভাষিকে শরৎচন্দ্র কখনও বাঙালি ও মুসলমানে বিভক্ত করতে পারতেন না। সমাজজীবনে, রাষ্ট্রজীবনে, পারিবারিক জীবনে ও ব্যক্তিজীবনে ‘লোকহিত’- এর মর্মার্থ আত্তীকরণ করা তাই বড়ই জরুরি। তবেই সাহিত্যের শৌখিন মজদুরি থেকে নয়, সমাজ সংস্কারের আত্মতাগিদ থেকে মৌলিক ও সম্পাদনা মিলিয়ে প্রায় অর্ধ শত গ্রন্থের কাণ্ডারী মইনুল হাসানের শ্রম ও মেধার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। তবেই ‘বাঙালি ও মুসলমান’ গ্রন্থটি লেখার উদ্দেশ্য সার্থক হবে।
পরিশেষে বিনীত অনুরোধ, প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলোর ফুটনোটে কোনটি, কবে, কোথা থেকে প্রকাশিত হয়েছে, তার উল্লেখ থাকলে পাঠকদের বাড়তি সুবিধা হয়। সুবিধা হয় গবেষকদেরও। রয়েছে কয়েকটি সাল গত বিভ্রান্তি। তবুও আত্মদর্শনের সুযোগ পেতে ‘বাঙালি ও মুসলমান’ গ্রন্থটি সব বাঙলির অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত। বিশেষত, সঙ্ঘ পরিবারের ৩৮% ভোট পাওয়া বাংলার বর্তমান জনমানসের পক্ষে তো বটেই। এই ৩৮% এখন চণ্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই…’ ও নজরুলের কাছ থেকে শেখা ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান…’ ভুলিয়ে দিতে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করছে। সভ্যতা বিধ্বংসী এই তাণ্ডব নৃত্যের গতি রুদ্ধ করতে অন্য অনেক সমিধের সহযোগীর ভূমিকা নেবে ‘বাঙালি ও মুসলমান’ নামের মেধা হাতিয়ার।