|
---|
ইন্টারনেট গেম ও তার ভয়াবহতা
নতুন গতির পাঠকের কলমে
বর্তমানে আমরা উন্নত প্রযুক্তির যুগে বসবাস করছি। প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রাকে করে দিয়েছে সহজ এবং আরামদায়ক তা বলার অবকাশ রাখে না। প্রযুক্তির এই ব্যাপক উৎকর্ষ একদিকে যেমন সুফল বয়ে এনেছে, তেমনি এর অতিরিক্ত ব্যবহারে রয়েছে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন দুনিয়া হাতের মুঠোয় বলা যায়। আর দুনিয়া হাতের মুঠোয় নিয়ে চলা যায় এমন সবচেয়ে ছোট ও পরিবহনযোগ্য ডিভাইস হলো স্মার্টফোন।
এই স্মার্টফোন এখন ছোট থেকে বড় সবার হাতেই রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্করা নিজেদেরও প্রয়োজনে স্মার্টফোন ব্যবহার করলেও উদ্বেগের বিষয় হল অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্মার্টফোনের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। ইন্টারনেট ব্রাউজ থেকে শুরু করে গেমের প্রতি তাদের চরম আসক্তি শিশু কিশোর মনকে বিনষ্ট করে দিচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের গেমের প্রতি নেশা মানসিক ও শারিরীক দুর্বলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যে সময় তাদের হাতে বই খাতা কলম থাকার কথা সেখানে দখল করেছে স্মার্টফোন। যে সময় তাদের অন্যান্য কিশোরদের সঙ্গে সবুজ মাঠে খেলাধূলার প্রয়োজন ছিল সেখানে দরজা বন্ধ করে পাবজি, ফ্রী ফায়ারের মত ধ্বংসাত্মক খেলায় মেতে ওঠেছে। মাঠে গিয়ে ধুলো কাদা মেখে, ঘেমে নেয়ে, রোজ বিকেলে খেলা শেষে বাড়ি ফেরা- এ দৃশ্য আজকাল যেন হারিয়ে যাচ্ছে। যত্রতত্র পাড়ার মোড়ে, চায়ের দোকানে, রাস্তার পাশে একদল কিশোরকে রাতদিন এই গেমে মত্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে।
১৩ বছরের আহসান। ক্লাস সেভেনে পড়ে। পড়ালেখায় ভালোই ছিল। একদিন তার বাবা তাকে একটি স্মার্টফোন উপহার দিল। এরপর থেকে শুরু হলো তার গেম খেলা। ধীরে ধীরে গেম খেলার পরিসর বাড়তে থাকল। অনলাইনে দেশি–বিদেশি নানা গেমারের সঙ্গে পরিচয়—ইয়ারফোনে কথা বলা শুরু হলো। ফলাফল, ক্লাস এইটে ওঠার সময় চার বিষয়ে ফেল!
সারা দিন গেম নিয়ে ব্যস্ত, মা–বাবার সঙ্গে কোনো কথা বলতে চায় না, বন্ধুদের সঙ্গে মেশে না, ক্লাসের বই পড়ে না। ক্রিকেট বা অন্য কোনো খেলাও খেলে না। ডিজিটাল পর্দার গেম ছাড়া তার আর কোনো কিছুতে আগ্রহ নেই। মা–বাবা রাগ করে তার মোবাইলটি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই শান্ত–সুবোধ আহসান অগ্নিমূর্তি হয়ে ধুমধাম করে ঘরের দরজা আটকে দেয়, মা-বাবাকে কটুবাক্য বলে, চিৎকার করে আবার তার মোবাইলটি নিজের কবজায় নিয়ে আসে। সারা দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকে, ইদানীং স্কুলেও যেতে চায় না।
আহসানের মতো এমন বৈশিষ্ট্যের কিশোর-কিশোরী আজ সবার ঘরে ঘরে।শুধু ভারতেই নয়, সারা পৃথিবীতেই এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ মনোস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দীর্ঘদিন জরিপ আর গবেষণার পর ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ ১১তম সংশোধিত সংস্করণে (আইসিডি-১১), ‘গেমিং অ্যাডিকশন’ হিসেবে একে মনোস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে ২০১৮ সালের জুন মাসে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে প্রকাশিতব্য আইসিডি-১১ শীর্ষক রোগ নির্ণয়ে গাইডবুকে এটি সংযুক্ত করা হযেছে।
অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অনলাইন গেম বা মোবাইল অতিরিক্ত ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এক কথায় ‘ইন্টারনেট গেমিং ডিজঅর্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বিশ্বজুড়ে এই বিষয়ে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে যেটা অ্যানালাইসিস করে দেখা গেছে, কিশোর ও তরুণরা এই ইন্টারনেট গেমিং এ সবচেয়ে বেশি আসক্তিতে ভুগছে। আমেরিকায় সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে একজন কলেজ স্টুডেন্ট দিনে গড়ে ১০ ঘন্টা ফোন ব্যবহার করে। হতে পারে সেটি ইন্টারনেট গেম, ব্রাউজিং করা বা সামাজিক মাধ্যমে মেসেজিংসহ বিভিন্ন কাজ। মজার বিষয় হলো দিনে তারা বিভিন্ন সোশ্যাল সাইট সহ যতগুলো মেসেজ আদান প্রদান করে তত কথা তারা সারাদিনে কারো সাথে বলেনা। আরেকটা গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার প্রতি পাঁচ জন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে তিন জনই ৬০ মিনিটের বেশি একবারও ফোন চেক না করে থাকতে পারে না।
পুরো বিশ্বেই স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের অবস্থা কম-বেশি এরকমই। কাউকে যদি বলা হয় ফোন ছাড়া থাকতে হবে তখন তার মাঝে একরকম ভয় দেখা দেয়, যাকে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন নোমোফোবিয়া।
ভয়ানক বিষয় হল ছাত্রজীবনে মোবাইল ও গেমের প্রতি আসক্তি ছাত্রসমাজকে মারাত্মক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। PLAYER UNKNOWN’S BATTLE GROUND বা সংক্ষেপে PUBG এবং ফ্রী ফায়ার গেমদুটোর নাম শুনেনি, এমন লোক বর্তমানে বিশ্বে খুব কমই আছে। আর গেম সম্পর্কে খবরাখবর রাখেন কিন্তু পাবজি চেনেন না, এমন লোক বোধ হয় একজনও নেই। পাবজি হচ্ছে একটি MMO (Massively Multiplayer Online) গেম, যেটা বর্তমানে সারা বিশ্বেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এই দুটো গেমের প্রতি অল্প বয়স্ক কিশোর কিশোরীদের নেশা খুব বেশি। ফলাফল হিসাবে অল্পবয়স্ক শিশুদের মধ্য গেমটির অত্যধিক সহিংসতা আক্রমণাত্মক দৃশ্য তাদের আগ্রাসী করে তুলছে। হিংসাত্মক কার্যক্রমে তাকে অভ্যস্ত করে তুলতে পারে। পাশাপাশি গেমারের আচার আচরণকেও বিষিয়ে তুলতে পারে। অতীতেও অনেকবার এ রকম উগ্র গেম খেলা গেমারদের নানারূপ সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়াতে দেখা গিয়েছে।
যার পুরোটা জুড়েই থাকে হিংস্রতা, মারামারি, যুদ্ধ, দখল এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। যত বেশি সহিংসতা তত বেশি পয়েন্ট। কোমলমতি শিশু কিশোররা নিজেরাও জানে না, কেন তারা এ মারণখেলা খেলছে! একের পর এক মানুষ খতম করছে। কখনো হাতুড়িপেটা করে মাথা থেতলে দিচ্ছে। মুহূর্তে রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। কখনো গ্রেনেড ছুঁড়ে প্রতিপক্ষের পা জখম করছে। এরপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে পলায়নপর মানুষটির উপর মারছে দ্বিতীয় গ্রেনেড। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার হাত পা। তারপর রক্তমাখা দেহটা লুটিয়ে পড়ছে খেলোয়াড়ের পায়ের উপর। এই রকম দৃশ্য হিংস্রাত্মক ছাপ ফেলছে শিশুদের কোমল মনে। অপরাধ প্রবনতা বাড়ছে। এছাড়াও সর্বদা মোবাইল ব্যবহারের ফলে দৃষ্টিশক্তির চরম ক্ষতি করছে।
স্মার্টফোনের নীল আলো চোখের রেটিনার জন্য ক্ষতিকর। টানা অনেকক্ষণ ধরে অতিরিক্ত পরিমাণ স্মার্টফোন ব্যবহার রেটিনার মারাত্নক ক্ষতি করতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে ম্যাকুলার ডিজেনারেশান বলা হয়। ম্যাকুলার ডিজেনারেশানে আক্রান্ত ব্যক্তি তার চোখের দৃষ্টি অনেকটাই হারিয়ে ফেলতে পারে এবং এটি আস্তে আস্তে যে কাউকে চিরতরে অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এর পাশাপাশি সারারাত ধরে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে গেমে মত্ত থাকায় বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়।
অনলাইন গেম যে শুধু শারীরিক বা মানসিক সমস্যা তৈরি করে তা নয়, এর অতিরিক্ত ব্যবহার মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন এবং হতাশ করে তুলে।
নিজের ব্যর্থতা মেনে নিয়ে আবার চেষ্টা করার শক্তি কমিয়ে দিয়ে হতাশ করে তুলে।
এছাড়া স্মার্টফোন এ অতিরিক্ত গেম খেলা অনেক প্রয়োজনীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে দেয় না। বরং এসব আসক্তি সামাজিকভাবে মানুষ থেকে দূরে রাখে, যা সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের পথে বড় বাঁধা।
মূলত ইন্টারনেট গেম আসক্তি অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের (মদ হেরোইন, গাঁজা, ইত্যাদি) আসক্তির মতোই। পার্থক্য হচ্ছে এটি আচরণগত আসক্তি, আর অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি, রাসায়নিক আসক্তি।
পরিশেষে বলাই যায়, অনলাইন গেমের প্রতি আসক্তি ছাত্রসমাজ ও যুবসমাজকে ধংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ।যেসব ছাত্ররা এই গেম খেলে, তাদের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দিনদিন তাদের ফলাফল নিচের দিকে যাচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সহ আচরনগত পরিবর্তন করে আক্রমনাত্মক করে তুলছে। ইন্টারনেট গেম আসক্তি মাদকাসক্তির মতোই একটি সমস্যা। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে এই আসক্তি দূর করতে হবে। পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। মাঠের খেলার প্রতি বাচ্চাদের উৎসাহ দিতে। শিশুদের মোবাইল থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে হবে।
তথ্যসুত্র – গুগল
লিখেছেন মোবারক মন্ডল করিমপুর , নদীয়া থেকে ।