|
---|
হালিম হক, মালদা: সারাদেশ মোব লিঞ্চিং এর শিকার। মুসলিমদের সাথে বাদ যায় না দলিত হিন্দুরাও।সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে অতীতের দিকে। মানুষ যত শিক্ষিত হচ্ছে ততটাই এই ভারতবর্ষে ধর্মে হানাহানি, মানুষে-মানুষে সম্প্রীতির অভাব কমে যাচ্ছে। মনীষীদের বাণী কে অগ্রাহ্য করে মানব আজ আইন কে নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।দিকে দিকে মোব লিঞ্চিং হচ্ছে আর মানুষ দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছে।
বিশেষ এক সম্প্রদায় কে কেন্দ্র করে ভারতের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন RSS ভারতবর্ষে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করার চেষ্টা করছে। আখলাক,জুনায়েদ,পেহেলু,তাবরেজের পর মালদা জেলার বৈষ্ণবনগর থানার অন্তর্গত চক শেহের্দি গ্রামের বাসিন্দা সেনাউল শেখ কে এলাকার কয়েকজন সমাজবিরোধী তথা আরএসএসের সক্রিয় কর্মী বাপ্পা ঘোষ,, প্রদীপ চৌধুরি,, পার্থ সারথি দাস,, মিঠুন চৌধুরিরা দলবল সহ পিটিয়ে হত্যা করে।
সেনাউল সেখের মা, স্ত্রী ও স্থানীয়দের বিবৃতি অনুযায়ী 26 শে জুন দুপুর 12 টা নাগাদ নিজ বাড়ি থেকে সেনাউলকে দুজন ডেকে নিয়ে যায়। কোনো বন্ধু হবে ভেবে কারা ছিলো সেদিকে বাড়ির লোকেরা ভ্রুক্ষেপ ও করেনি। হঠাৎ ঘন্টাখানেক পর তার মায়ের কাছে খবর আসে তার ছেলেকে রাস্তায় ধরে পেটানো হচ্ছে।
সেনাউলের মা-স্ত্রী ও স্থানীয়রা দৌড়তে দৌড়তে ছুটে যায়। ততক্ষনে আক্রমনকারীরা নিজেদের মনোবৃত্তি পুরন করে পালিয়ে গিয়েছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বাপ্পা ঘোষ ও তার দলবল সেনাউলকে পিটিয়ে চলেছে আর সভ্য সমাজ দেখেছে দাঁড়িয়ে দেখেছে কিন্তু কেউ বাধা দেয়নি। মুহুর্তের মধ্যে ভিডিও সোসিয়াল মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
পেটাতে পেটাতে আধমরা অবস্থায় বৈষ্ণবনগর থানার পুলিশ সেনাউলকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। সেনাউলের মায়ের কথায় তার ছেলেকে মাত্র একটা ব্যথার ইঞ্জেকশন দিয়ে টানা তিন-চার ঘন্টা থানায় ফেলে রাখা হয়। ছেলেকে দেখার জন্যে মা-স্ত্রী কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তার মা-স্ত্রী সেনাউলকে দেখতে চাইলে চাইলে থানা থেকে বলা হয় “চুরি করার সময় মনে থাকে না? কতদিন থেকে ছেলেকে দেখিস নি যে ছেলে ছেলে করছিস।”
ভাবুন এই আমাদের আইনের রক্ষক।
সেনাউলের অবস্থা মৃতপ্রায় হলে থানার কর্তব্যরত অফিসার তার মায়ের হাতে 2000 টাকা ধরিয়ে দিয়ে মালদা মেডিকেল হসপিটালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে বলেন। 1000 টাকা গাড়ির ড্রাইভারকে দিতে বলেন আর এক হাজার টাকা ছেলের ওষুধ পত্র কিনতে বলেন।
মালদা নিয়ে যাওয়ার আগে কর্তব্যরত অফিসার চিকিৎসার নাম করে সেনাউলের মায়ের কাছ থেকে সাদা পাতায় একটা সই নিয়ে পরবর্তীতে সেটাকে FIR করার ক্ষেত্রে অবৈধভাবে ব্যবহার করেন।
মালদা নিয়ে যাওয়ার পরে সেখানে জরুরি চিকিৎসার পর পরেই কলকাতায় রেফার করা হয়। কলকাতা নিয়ে যাওয়ার পরে ভর্তি করানো হলে কিছুক্ষণের মধ্যে সেনাউল মারা যায়।
৩০ জুন সকালে কলকাতা থেকে মৃতদেহ ফেতর এলে স্থানীয়রা NH 34 এ মৃতদেহ রেখে পথ অবরোধ করে প্রতিবাদ জানায়। বিক্ষোভের মুখে পড়ে দক্ষিন মালদার সাংসদ আবু হাসেম খাঁনের ছেলে ঈশা খাঁন চৌধুরী। অবশেষে দোষীদের শাস্তির আশ্বাস দিলে ঘন্টাখানেক পরে অবরোধ ওঠে। বিকেল ২ টা নাগাদ সেনাউলকে দাফন করা হয়।
৩০ জুন আমরা বাংলা সংস্কৃতির মঞ্চের পক্ষ থেকে চার জন সদস্য সেনাউলের বাড়ি গেলে উক্ত বিবৃতিগুলো উঠে আসে। সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি আইনি সহযোগিতা ও আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের মালদা জেলার কর্নধর নাজিবুর রহমান। পাশাপাশি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মালদা জেলার সভাপতি নজরুল ইসলাম সহ অন্যান্য সদস্যরা। জমিয়তের পক্ষ থেকে সেনাউলের স্ত্রীর হাতে ২৫০০০ টাকা তুলে দেওয়া হয় এবং আইনি সহযোগিতার পাশাপাশি আর্থিকভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। পাশাপাশি মালদা জেলার AIMIM সংগঠনের নেতৃত্বরা আইনি সহযোগিতার আশ্বাস দেন। উপস্থিত ছিলেন মালদা জেলার AIMIM প্রতিনিধি মাতিউর রহমান সহ অন্যান্য সদস্যরা।
সেনাউল সেখের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে খবর নিতে থাকি স্থানীয়দের থেকে। স্থানীয়দের মতে সেদিনের চুরির অপবাদ সম্পূর্ণ মিথ্যা। উনাদের মতে সেদিন বাইকে করে দুজন ডেকে নিয়ে যায় তার কিছুক্ষণের মধ্যে বৈষ্ণবনগর বাজারের পাশেই প্রকাশ্যে সেনাউল শেখকে হত্যা করে RSS সদস্যরা। হাতে নাতে কেউ চোর এর প্রমাণ দেখাতে পারেনি বা ধরতে পারেনি, সন্দেহের বশে তাকে হত্যা করা হয় বলে তারা দাবী করেন। আবার কয়েকজনের কথায় চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। জানা যায় মাস ছয়েক আগে পার্শ্ববর্তী পাড়ার সাথে পাশ্ববর্তী চাঁইদের এক ঝামেলার কারনে একজন হিন্দু চাঁই এর প্রান গিয়েছিলো। ছয়মাস পরে সেই হত্যার বদলা নিতেই আরএসএস কর্মীরা এই প্লান মাফিক হত্যা করেছে বলে তারা দাবী করেন।।
অনেকেই দাবী করেন লোকসভা ভোটের পরে স্থানীয় RSS সদস্যরা যেকোনো ভাবে সাম্প্রদায়িক ঝামেলা লাগানোর উদ্দেশ্যেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
এখন পর্যন্ত মাত্র একজনকে এরেষ্ট করা হলেও মুল অভিযুক্ত বাপ্পা ঘোষ সহ তিনজন পলাতক। সেনাউলের মা, স্ত্রী সহ স্থানীয় সকলেই দোষীদের আইনি শাস্তির দাবী তোলে।
সেনাউলকে কেউ সেদিন চুরি করতে দেখেনি এমনকি কেউ হাতেনাতে ধরতে পারেনি। বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে তাকে প্ল্যানমাফিক হত্যা করা হয়। আর যদি সে চুরি করতো বা করেও থাকতো তাহলে সেখান থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিটের রাস্তা বৈষ্ণবনগর থানায় তুলে দেওয়া যেত না??
ঘরে ছয় মাসের মেয়ে সন্তান নিয়ে বিধবা স্ত্রী, স্বামী-সন্তানহারা বৃদ্ধা মা….. কিভাবে চলবে তাদের সংসার?/
সেটাই এখন প্রশ্নের মুখে..
আর প্রশ্নের মুখে দাঁড়াচ্ছে আইনের রক্ষক দের ভূমিকা নিয়ে…
প্রশ্নের মুখে দাঁড়াচ্ছে আমার আপনার চুপ থাকা নিয়ে…
প্রশ্নের মুখে দাঁড়াচ্ছে ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে…
প্রশ্নের মুখে দাঁড়াচ্ছে মানবতা…
এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে সেদিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন আমার-আপনার ভারত তার ধর্মনিরপেক্ষতার স্বীকৃতি হারাবে।।