|
---|
কলমে- মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ: বিশ্বে এখন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট ও মানবিক বিপর্যয় বিরাজ করছে সিরিয়ার মাটিতে।সিরিয়ার পবিত্র মাটি রক্তপিপাসুদের লোলুপ দৃষ্টিতে অপবিত্র হতে বসেছে।প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার শিরোনামে , টিভির পর্দায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চোখে পড়ছে নারী, বৃদ্ধ ,শিশুসহ অসংখ্য বেসামরিক নাগরিকের রক্তে রাঙা নিথর শবদেহ।সিরিয়ার যেখানে সেখানে রক্তের কালো দাগ পৃথিবীকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করছে তার পবিত্রতা নিয়ে।রাজনৈতিক ভাবে সিরিয়ার সাধারণ মানুষ পীড়ন শুরু হয়েছিল সিরিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি হাফিজ আল আসাদের হাত দিয়ে।বাথ পার্টির হাত ধরে ২২ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে এই রক্তপিপাসু হাফিজ আল আসাদ রাষ্ট্রপতি হন।বিশ্ব ইতিহাসের পাতা উলটালে নজরকৃত নিকৃষ্ট ২৫ টি ম্যাসাকারের মধ্যে একটি হচ্ছে ১৯৮২ সালে ঘটা মুসলিম ব্রাদারহুড সিরিয়া শাখার নেতা কর্মীদের উপর নৃশংস গনহত্যা। এই অমানুষিক গনহত্যা বিশ্ব ইতিহাসে হামা ম্যাসাকার নামে পরিচিত।সিরিয়ার সাবেক সেকুলার শিয়া হাফিজ আল আসাদ এই গনহত্যা সজ্ঞানে পরিচালনা করেন।ঐতিহাসিকদের মতে যদি সিরিয়ায় ১৯৮২ সালের এই নৃশংস গনহত্যা সংঘটিত না হত তাহলে আজ বিশ্বের ইতিহাস অন্যভাবে লিখা হত,এবং পৃথিবীর মানচিত্রে ইসরাইল নামক কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকতনা। ১৯২২ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে উসমানিয়া খেলাফতের বিলুপ্ত ঘোষনা করা হয় মধ্যপ্রচ্য জুড়ে।এই সময় সারা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে অসম্ভব দাপট নিয়ে বেড়ে উঠে ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা মুসলিম ব্রাদার হুড।সেই ব্রাদারহুডের উত্থানকে মিশর-ঈসরাইল-সিরিয়ার তৎকালীন শাসকরা পশ্চিমাদের সাহায্যে গলাটিপে হত্যাকরে মুসলিম জাতিকে পঙ্গু করে দেয়।এর ফলে ঐতিহাসিকদের ধারণা মুসলিম জাতিকে ৩৫ বছর পেছনে ফেলে দেয়। হাফিজ আল আসাদকে বার্ধক্য জড়িয়ে ধরলে তিনি উত্তরাধিকারী হিসেবে বড় ছেলে বাসিল আল-আসাদকে বেছে নেন ও তাকে সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন, কিন্তু ১৯৯৪ সালের ২১ জানুয়ারিতে একটি মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় দামেস্কে বাসিল আল-আসাদের মৃত্যু হয়। এই অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর পর হাফেজ আল-আসাদ বাসিলের ছোট বাশার আল-আসাদকে উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নেন। বাশার আল আসাদ এই সময় লন্ডনে অধ্যয়নরত ছিলেন যেখান থেকে তাকে পিতার অধীনে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের জন্য সিরিয়ায় ফিরিয়ে আসেন। এবং ২০০০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাফেজ আল-আসাদের দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তি ঘটলে ছেলে বাশার আল-আসাদ সর্বসম্মত ভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সিরিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সিরিয়ার বর্তমান রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদ ২০০১ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদে স্থায়িত্ব অর্জন করেন। আশা করা হয়েছিল যে বাশার দায়িত্ব নেয়ার পর সিরীয় প্রশাসন হাফেজ আল-আসাদের রক্ষণশীল নীতি থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসবে। দায়িত্ব নেয়ার পর বাশার আল-আসাদ এক সাক্ষাৎকারে জানান যে গণতন্ত্রই হতে পারে সিরিয়ার দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণের চাবিকাঠি। বাশার এও যোগ করেন যে গণতন্ত্রের ইতিবাচক প্রভাব একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং তাড়াহুড়ো করে এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাশার খুব সতর্কতার সাথে একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন শুরু করেন যা সিরিয়ার তথাকথিত ডেমাস্কাস স্প্রিং বিতর্কের মধ্য দিয়ে চালিত হয়েছিল। হাফেজ আল-আসাদের তুলনামূলক রক্ষণশীল রাজনৈতিক নীতিমালা থেকে বেরিয়ে এসে নব্য রাষ্ট্রপ্রধান কি কি উপায়ে সিরিয়ার প্রশাসনকে আরও উদারপন্থী করে ক্রমশ গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, এই বিষয়ে ২০০০ সাল থেকে প্রায় এক বছর যাবত একটি রাজনৈতিক বিতর্ক চলছিল যা ‘ডেমাস্কাস স্প্রিং’ নামে খ্যাতি লাভ করে। উল্লেখ্য যে ‘ডেমাস্কাস স্প্রিং’ বাশারের পিতার রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতির সামলোচনা করলেও তিনি এই বিতর্ক হতে উত্থাপিত বেশ কিছু প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছিলেন ও বাস্তবায়িত করেছেন।সামরিক, বৈদেশিক, অর্থনৈতিক কিছু উন্নতি সাধন করলেও,এটি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।২০১১ সালে রাষ্ট্রপতি আসাদের বিপক্ষে শুরু হয় আন্দোলন। এই আন্দোলন থেকে পরে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ ।এখন নানা দেশের জড়িত হওয়ায় এক জটিল সমীকরনে দাঁড়িয়েছে সিরিয়ার অবস্থান। প্রায় ৭ বছর ধরে চলা এ যুদ্ধে প্রায় ৬ লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ে এবং প্রায় ১০ লাখের বেশি মানুষ আহতের সারিতে নাম লেখায়। নিহতদের এক তৃতীয়াংশই নারী, বৃদ্ধ, শিশু ও বেসমারিক সাধারণ নাগরিক। যুদ্ধের ফল স্বরূপ ‘শরনার্থী’- এর সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখেরও বেশি।এ সংকট এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এই সংকটের সমাধান কখন হবে সেটা জানা নেই কারো।
রাজনৈতিক সংকটের সুচনাঃ
সালটা ছিল ২০১১।গণতন্ত্রের ভূত কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশের নাগরিকদের মস্তিষ্কের শিরা উপশিরায় নাড়া দিয়েছিল।গণতন্ত্রের দাবীতে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে, যা ইতিহাসের পাতায় ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত। ‘আরব বসন্ত’-কে অনুসরণ করে ২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার একনায়ক রাষ্ট্রপতি বাশার আল আসাদের পদত্যাগ ও দেশে একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবীতে সিরিয়ার বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ শুরু করে। রাজধানী দামেস্ক সহ বড় বড় শহরগুলোতে বিরোধী দল ও সাধারণ জনতার বড় অংশ রাস্তায় আসাদ-বিরোধী মিছিল ও জনসভা করতে শুরু করে।গণতন্ত্র ভুখা বিক্ষোভকারীদের দমন করতে রাষ্ট্রপতি বাসার আল আসাদ সেনাবাহিনী নামিয়ে দেয়। সেনাবাহিনী নির্মম ভাবে অত্যাচার করতে শুরু করে নিরীহ সিরিয়াবাসীদের উপর।সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে নিহত হতে থাকে বিক্ষোভকারীদের অনেকে। দিনের পর দিন নিহত ও আহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে সিরিয়া ভূমি জুড়ে। হত্যা ও নির্যাতন এতটাই বেড়ে যায় যে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো নিষেধাজ্ঞাজারি করে সিরিয়ার উপর।সিরিয়ার অলিগলি জুড়ে ৩ মাস একটানা বিদ্রোহ চলার পরে নিহত মানুষের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবুও বিদ্রোহীরা নিজেদের সিদ্ধান্তে সিদ্ধহস্ত ছিল,
রাস্তা ছাড়েনি বিক্ষোভকারীরা ,মাথা নত করেনি আসাদ বাহিনীর কাছে। সেনাবাহিনীর অনেকে বাহিনী ছেড়ে চলে আসে। আসাদ বিরোধী বিরোধীদল ও সুন্নি সমর্থকদের সাথে এক হয়ে তারা ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ নামে নতুন সামরিক বাহিনী গঠন করে। আল নুসরা , আল কায়েদার মত জঙ্গী গোষ্ঠীও যোগ দেয় এই বিরোধী বাহিনীতে। বাড়তে থাকে যুদ্ধের ব্যাপ্তি। আসাদের বাহিনী ও বিদ্রোহী বাহিনীর মাঝে চলতে থাকে তুমুল লড়াই।
এই যুদ্ধে ইন্ধন যোগাতে একনায়কতান্ত্রিক আসাদকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে রাশিয়া ও ইরান। লেবাননের গেরিলা গোষ্ঠী হিজবুল্লাহও আসাদের পক্ষে লড়তে এগিয়ে আসে।অন্য দিকে আসাদ বিরোধী বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা দিতে থাকে আমেরিকা, ইসরাইল, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স , সৌদি আরবের মতো দেশগুলি। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যোগ দেয় ইসলামিক স্টেট সংগঠন(আই.এস)। ইরাকের বিশাল এলাকা দখল করার পর পরাক্রমশালী আই.এস সিরিয়া দখল করতে অগ্রসর হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতি সময়ে আই.এস-এর সিরিয়াতে প্রবেশ পরিস্থিতি জটিল করে তোলে। আই.এস-এর প্রধান লক্ষ্য আসাদ ও তার বাহিনী নির্মূল , এদিকে আমেরিকাও চায় আসাদকে ও তার বাহিনীকে নির্মূল করতে কিন্তু আবার চায় আইএসকে নির্মূল করতে। যুদ্ধে আইএস এর জড়িত হওয়ার ফলে আমেরিকার মতিগতি পরিপর্তিত হয়। আমেরিকা আইএস দমনের কথা বলে যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে।
আমেরিকা, ইসরাইল, সৌদি আরব ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ বিদ্রোহী নেতাদের নিয়ে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে ‘জাতীয় পরিষদ’ নামে একটি কাউন্সিল গঠন করে কিন্তু আল কায়েদা ও আল নুসরা জঙ্গি গোষ্ঠির নেতাদের রাখা হয়নি এই পরিষদে।
রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের অভিযোগ এনে ও আই.এস দমনের কথা বলে কয়েকটি বিমান হামলা করে আমেরিকা।এই ভাবে
প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আমেরিকা।এদিকে আরেকটি পক্ষ হিসেবে যুদ্ধ ময়দানে নেমে পড়ে কুর্দিরা। এই যুদ্ধের ডামাডোলে কুর্দিরাও তৎপর হয়ে উঠে স্বাধীন আবাসভূমির স্বপ্নে। আমেরিকা তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কুর্দিদের সহায়তায়। ফলে ন্যাটাভুক্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও কুর্দিদের বিপক্ষে সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে তুরস্ক। কারন কুর্দিদের জন্য আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হতে দিতে রাজি নয় তুরস্ক।বিভিন্ন পক্ষের অপ্রাসঙ্গিক অংশগ্রহনে সিরিয়া পরিস্থিতি এখন জটিল আকার ধারন করেছে।
এবার দেখা যাক কোন দেশের কি স্বার্থ, কেনই বা তারা বিভিন্ন পক্ষকে সহায়তা দিচ্ছে?ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলি আগ্রাসনের জবাবে সাবেক সিরিয় রাষ্ট্রপতি হাফিজ আল আসাদ ৩০ হাজার সিরিয় সৈন্যকে বেকা উপতাকায় মোতায়েন করেন। এসময় ইসরাইলের সাথে কয়েকবার সংঘর্ষও বাঁধে সিরিয়ার সঙ্গে ইসরাইলের বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ বাঁধে।তাই ঐতিহাসিকভাবেই সিরিয়া ও ইসরাইলের মধ্যে শত্রুতা রয়েছে। হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসে বাশার আল আসাদ। পিতার মত সেও ইসরাইল বিরোধী নীতিতে অটল থাকেন। হিজবুল্লাহ ও হামাসকে সহায়তা করে আসাদ সরকার। তবে কোনবারই চুড়ান্ত সফলতা পায়নি। ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল এর জন্য মাত্র দুইটি দেশ হুমকি হয়ে আছে। ইরান ও সিরিয়া। ইরানকে নানা অবরোধ দিয়ে দাবিয়ে রাখায় চেষ্টা অব্যহত আছে। সিরিয়ায় আসাদ কে সরিয়ে নিজেদের পছন্দমত কাউকে বসাতে পারলে সিরিয়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। মূলত এ কারনেই স্বাভাবিকভাবেই ইসরাইল, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো আসাদ বিরোধী বিদ্রোহী বাহিনীকে সহায়তা করছে।
আমেরিকা ও ইসরাইলের মিত্র বলে পরিচিত সৌদি সরকার শিয়াপন্থী আসাদ সরকারকে সরাতে চায় ধর্মীয় মত বিরোধের কারনে ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বিরোধিতার কারনে। আবার ইরানের সাথে আসাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারনে স্বাভাবিক ভাবেই আসাদকে সরাতে চায় ইরানের শত্রু ও ওয়াহাবী পন্থী সৌদি আরব। তাই সৌদি আরব চায় আসাদ কে সরিয়ে তাদের মতাদর্শের ও অনুগত কাউকে ক্ষমতায় বসাতে। এ লক্ষ্যে সৌদি আরব বিলয়ন ডলার খরচ করছে বিদ্রোহীদের পক্ষে।অন্যদিকে কাতার পারস্য উপসাগর থেকে সিরিয়ার মধ্য দিয়ে তুরস্ক ও ইউরোপে গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে যেতে চায় । কিন্তু রাশিয়ার স্বার্থ চিন্তা করে আসাদ সিরিয়ার মধ্যে দিয়ে এই পাইপ লাইন নিয়ে যেতে অনুমতি দেয় নি। কারন এতে রাশিয়ার ওপর থেকে ইউরোপের প্রাকৃতিক গ্যাসনির্ভরতা কমে যাবে। ফলে কাতারও চায় আসাদের পতন। তাই কাতার আসাদের বিপক্ষে খরচ করেছে বিপুল অর্থ।আবার মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার দুই বিশ্বস্ত বন্ধু হচ্ছে ইরান ও সিরিয়া। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারনে পুতিন ও আসাদের সম্পর্কও এখন বেশ ঘনিষ্ঠ। আসাদের পতন হলে সিরিয়া চলে যাবে আমেরিকা , ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। তাই রাশিয়া সক্রিয়ভাবেই যুদ্ধের ময়দানে ও জাতিসংঘে আসাদের পক্ষে আছে। ২০১২ সালে যুদ্ধের এক পর্যায়ে যখন কোনঠাসা হয়ে গিয়েছিল আসাদ বাহিনী তখন রাশিয়া এগিয়ে না আসলে হয়ত আসাদের চরম সংকটেই পড়তে হতো। মূলত রাশিয়ার সহায়তার কারনেই আসাদের বাহিনী এখন তুলনামুলক ভালো অবস্থানে আছে।ইসরাইলের সবচেয়ে বড় শত্রু ইরান। আবার সৌদি আরবের সাথেও ইরানের ঐতিহাসিক শত্রুতা। আর আসাদ সরকার ইসরাইল ও সৌদি বিরোধী। এদিকে ইসরাইলকে চাপে রাখতে লেবাননের হিজবুল্লাহ গেরিলাকে দরকার ইরানের। আর সিরিয়া দিয়েই হিজবুল্লাহকে সহায়তা পাঠাতে হয় ইরানকে। ফলে রাশিয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বি ইরানও সমর্থন করে আসাদকে। ইরান আসাদের বাহিনীকে সামরিক সাহায্য ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করে আসছে। সাহায্য করছে হিজবুল্লাহও।
সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্কের অবস্থানও বেশ শক্ত। সিরিয়া যুদ্ধের শুরু থেকেই তুরস্ক আসাদবিরোধীদের সমর্থন করছে। এর একটি কারন হতে পারে সুন্নি ও শিয়া মতভেদ। আরেকটি কারন কাতার পারস্য উপসাগর থেকে সিরিয়া দিয়ে তুরস্কে প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে যেতে চায়, যা আসাদ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। আবার তুরস্ক আমেরিকা, ইংল্যান্ডের সাথে ন্যাটো জোটভুক্ত। ফলে শুরুর দিকে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মির’ সঙ্গে তারা আসাদবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।
তবে রাশিয়ার প্রভাবে ও এরদোগানের প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর আসাদ বিরোধী মনোভাব থেকে সরে এসেছে তুরস্ক। বর্তমানে সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্কের মূল লক্ষ্য স্বাধীন রাষ্ট্রকামী কুর্দিদের দমন করা। তুরস্ক চায় না কুর্দিরা নতুন এলাকার নিয়ন্ত্রণ পাক। কারন তুরস্কে কুর্দিরা দীর্ঘদিন ধরে তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য। সিরিয়ার যদি কুর্দিরা কোন স্বাধীন এলাকা পেয়ে যায় তাহলে সেটা তুরস্কের কুর্দিদের জন্য নিরাপদ স্থান হবে ও তুরস্কের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সুবিধা হবে।
উপরে বিভিন্ন পক্ষ তাদের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ থেকে এটা সহজের বুঝা যাচ্ছে সিরিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি জটিল আকার ধারন করেছে। এখানে নিরুঙ্কুশ ভাবে বিজয়ী পাওয়া মনে হয় সম্ভব নয়। আমরা সকলেই চাই এই ধ্বংসাত্নক যুদ্ধ বন্ধ হোক। অসহায় নারী, শিশুদের করুন মৃত্যু যেন আর না হয়। কিন্তু শান্তিপুর্ন সমাধানে আসা সহজ হবে না। আসাদ বাহিনী ও বিদ্রোহী পক্ষ দুই পক্ষেরই প্রায় দুই লক্ষ করে সদস্য নিহত হয়েছে। ফলে কোনপক্ষই আরেকপক্ষকে ছাড় দেয়ার মানসিকতায় নেই। আত্নসমর্পন করলেও পরাজিত পক্ষকে মেনে নিতে হবে দীর্ঘ কারাবাস ও নির্যাতন। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে নানা দেশের নানা স্বার্থ। এদিকে ১৮ মার্চ রাশিয়ার নির্বাচন। পুতিন চাইবে নির্বাচনের আগে সিরিয়ার নিজেদের ভাল অবস্থান নিশ্চিত করে জনগনকে আশ্বস্ত করতে।
বর্তমানে বিদ্রোহী বাহিনীর চেয়ে আসাদ বাহিনী যুদ্ধে তুলনামূলক ভাল অবস্থায় আছে। তারপরও আসাদ বাহিনীর বড় সমস্যা লোকবল। পুরো সিরিয়া নিয়ন্ত্রণ করার মত লোকবল আসাদ বাহিনীর এখন নেই। ফলে এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাশিয়া ও ইরানের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হতে পারে আসাদকে। বিদ্রোহী গ্রুপে নানা উপদল থাকায় তাদের মাঝে ঐক্যের অভাব আছে। প্রকৃতপক্ষে তাদের কোন একক নেতাও নেই। আবার আমেরিকাও বিদ্রোহীদের আগের মত প্রত্যক্ষ সহায়তা করছে না। ফলে কিছুটা কোনঠাসা অবস্থায় আছে বিদ্রোহীরা। আর আইএস এর অবস্থা একেবারেই নাজুক। যুদ্ধে মূলত সবচেয়ে বড় পরাজয় হয়েছে আইএসের। তবে কুর্দিদের অবস্থানও বেশ শক্ত। আইএসের শক্ত ঘাঁটি রাকা থেকে আইএস কে বিতাড়িত করে রাকা, হাসাকাহসহ বিস্তৃণ অঞ্চল এখন কুর্দিদের দখলে।
যুদ্ধে যদি আসাদ বাহিনী সকল এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েও নেয় তবুও মনে হচ্ছে এ এলাকায় শান্তি সহজে আসবে না। বিদ্রোহী পক্ষ ও আইএস পরাজয়ের পর শান্ত হয়ে যাবে এটা ভাবা যায় না। তারা তখন সম্মুখ যুদ্ধের বদলে হয়ত চোরাগোপ্তা বোমা হামলা চালাবে। আবার এদিকে কুর্দিদের দখলকৃত এলাকায় তুরস্কের অভিযান হয়ত অব্যহত থাকবে। যেমন কিছুদিন আগেই আফরিন এলাকায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে তুরস্ক। আবার আসাদও চাইবে না সিরিয়ার এত বড় এলাকা নিজের নিয়ন্ত্রণে না রেখে কুর্দিদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে।
ফলে জটিল এ পরিস্থিতিতে একমাত্র সমাধান হতে পারে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলের সদিচ্ছা। নইলে দীর্ঘমেয়াদি ‘গৃহযুদ্ধ’ এর অন্ধকারে ডুবে থাকবে এই দেশ। যদি সকল পক্ষ নিজেদের স্বার্থের চিন্তা ত্যাগ করে এ অঞ্চলের অসহায় মানুষের কথা ভেবে, নিষ্পাপ শিশুদের কথাভেবে সত্যি সমাধান চায় তাহলেই কেবল সমাধান আসবে। জাতিসংঘের নিতে হবে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, বিবদমান পক্ষের মাঝে একটি শান্তিচুক্তি করে মোতায়েন করতে হবে শান্তিরক্ষী বাহিনী। কিন্তু এটা মনে হয় শুধু কল্পনাতেই সম্ভব। নিজ নিজ স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে শান্তির কথা যতদিন না ভাববে এই রক্তপিপাসু দেশগুলো ততদিন এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতেই থাকবে।