বিপ্লবী ইতিহাসকে বুকে করে প্রাচীন দুর্গাপুজো আজও রয়ে গিয়েছে অম্বিকানগরের রাজপ্রাসাদে

নিজস্ব সংবাদদাতা : জমিদারি প্রথায় অভাব-অভিযোগ কম ছিল না। কিন্তু ইংরেজ শাসকের খবরদারি মানতে পারেননি কেউই। তাই রাজা-প্রজা সব একজোট হয়েছিলেন। বিপ্লবীদের নিরাপদ আস্তানা গড়ে তুলেছিলেন খোদ রাজাই। অস্ত্রশস্ত্রের জোগানও দিতেন নিজেই। অমৃতকালে এমন কতশত কাহিনি আজ বিস্মৃত। কিন্তু বিপ্লবীদের স্মৃতি বহন করে আসছে অম্বিকানগরের রাজপ্রাসাদ। রাজপ্রাসাদ আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আগাছায় ভরে গিয়েছে চারিদিক। কিন্তু প্রতি বছর শারোদৎসবে প্রাণ ফিরে পায় ওই রাজপ্রাসাদ।

     

    বাঁকুড়ার দক্ষিণে অম্বিকানগরের বিখ্যাত রাজবাড়িই একসময় ছিল বিপ্লবীদের নিরাপদ আস্তানা। বিপ্লবীদের অস্ত্রশস্ত্র পর্যন্ত তৈরি হত সেখানে। রাতের অন্ধকারে বিশ্বস্ত লোকজনকে নিয়ে সেই সব অস্ত্রশস্ত্র, যাবতীয় রসদ বিপ্লবীদের গোপন ডেরায় পৌঁছে দিতেন রাজা। সেই রাজপ্রাসাদের অস্তিত্ব আজ মুছে যাওয়ার মুখে। কিন্তু ৪৫০ বছরের প্রাচীন দুর্গাপুজো আজও ইতিহাসের স্বাক্ষর হিসেবে টিকে রয়েছে সেখানে। প্রতি বছর তাতে শামিল হয়ে স্মৃতিচারণে ফিরে যান সকলে। 1

     

    বাঁকুড়ায় কুমারী নদীর তীরে অবস্থিত অম্বিকানগর। ষষ্ঠ এবং সপ্তম শতকে জঙ্গলে ঢাকা ছিল গোটা এলাকা। অধিবাসীদের সিংহভাগ ছিলেন সাঁওতাল-সহ আদি জাতির মানুষ। জৈন ধর্মও প্রসারিত হচ্ছিল ধীরে ধীরে। রাজস্থানের ঢোলপুর এলাকা থেকে পুরী যাওয়ার পথে অধুনা সুপুর এলাকা মনে ধরে যায় তীর্থযাত্রীদের। সেখানেই বসবাস গড়ে তোলেন জনৈক রাজপুত যোদ্ধা। পরবর্তী কালে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে সংযুক্ত করে নিজের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

     

    তার পর ওই এলাকাকে রাজধানী ঘোষণা করে বেশ কয়েক শতক রাজত্ব করে ধবল দেও পরিবার। আজ থেকে প্রায় ৪৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে পরিবারের দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বে ভাগ হয়ে যায় সেই রাজত্ব। শোনা যায়, খড়গেশ্বরের ধবল দেও কুমারী নদীর দক্ষিণের থাকা রাজত্বের অংশ নিয়ে অম্বিকানগরে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান। সেখানে কুলদেবী অম্বিকা এবং কুল দেবতা কালাচাঁদ জিউয়ের প্রতিষ্ঠা করেন। দেবি অম্বিকার নামেই ওই এলাকার নাম হয় অম্বিকানগর।

     

    ওই সময়ই অম্বিকানগরে রাজপরিবারের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় দুর্গার আরাধনা। রাজপরিবারের সদস্য চরণ ধবল দেও ইংরেজ আমলে সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর আমলে অম্বিকানগরের ছেঁদা পাথর এলাকার জঙ্গলে বিপ্লবীদের বারুদ এবং বারুদের কারখানা গড়ে তোলা হয়। গভঙীর রাতে ঘোড়া ছুটিয়ে পৌঁছে যেতেন সেখানে। নিজের উদ্যোগে সেখানে দু’টি সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি।

     

    রাজার সাহায্য পেয়ে রাজবাড়িতে আনাগোনা শুরু হয় ভূপেশ দত্ত, প্রফুল্ল চাকী, নরেন গোস্বামী-সহ অনামী বিপ্লবীদেরও। গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে অম্বিকানগরের রাজত্ব নিলাম করে দেয় তৎকালবীন ইংরেজ সরকার। প্রথমে কলকাতার এক জমিদার ওই রাজত্ব কিনে নেন। পরে বিহারের দ্বারভাঙার রাজার হাতে ওঠে অম্বিকানগর রাজত্ব। তবে তাতেও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে ইতি পড়েনি। এর পর, ইংরেজ সেনাপতি চার্স টেগাটের নেতৃত্বে রাজবাড়ি ঘিরে ধরে সেনা-পুলিশ। আলিপুর বোমা মামলায় গ্রেফতার হন রাজা চরণ ধবল দেও। প্রমাণের অভাবে যদিও পরে ছাড়া পেয়ে যান তিনি।

     

    এতদিনে কুমারী নদীর বুক দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। রাজত্ব ফিরে না পেয়ে জেল্লা হারিয়েছে অম্বিকানগরের রাজপরিবার। সংস্কারের অভাবে কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে কুমারী নদীর তীরে অবস্থিত সুবিশাল রাজপ্রাসাদ। তবে বিপ্লবী ইতিহাসকে বুকে করে প্রাচীন দুর্গাপুজো আজও রয়ে গিয়েছে অম্বিকানগরের ওই রাজপ্রাসাদে। একসনয় এই রাজবাড়ির পুজোই ছিল মূল আকর্ষণ। তবে গত দুই দশকে একাধিক নতুন পুজো শুরু হয়েছে। কিন্তু রাজবাড়ির ঐতিহ্যবাড়ির পুজোর প্রতি সম্মান আজও অটুট।