একটি গাছে 300 রকমের আম ফলিয়ে, গিনিসের পথে কলিমউল্লাহ খান

 

    মোহাম্মদ রিপন, মুরার‌ই

    ফলের রাজা আম পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই হয়তো যেখানকার মানুষ আম খেতে থেকে বিরত থেকেছে। পৃথিবীর সব দেশে হয়তো আম গাছ পাওয়া যায় না এটা ঠিক। কিন্তু আম যে ব্যাক্তি খেয়েছে তার স্বাদ কখনোই ভোলার নয়।এশিয়া মহাদেশের আমের জন্ম হলেও পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশ গুলি কে আজ এশিয়ার এই সুস্বাদু ফল লোভনীয় করে তুলেছে।কথিত আছে চীনা পর্যটক হিউ এন সাং 632 থেকে 645 সালের মধ্যে ভারতের হিমালয় ও মায়ানমার অঞ্চলে এসে আমের সাথে বিশ্ববাসীর পরিচয় করিয়ে দেয়।সম্রাট আকবর এই লোভনীয় ফলের স্বাদ কখনোই ভুলতে পারেননি তিনি আম ভালোবেসে দিল্লির শাহবাগে প্রায় এক লক্ষ আম গাছের চারা রোপণ করেছিলেন(১৫৫৬-১৬০৫)। তিনি প্রথম ভারতীয় ব্যক্তি যিনি এই ভূভাগে একটি উন্নত মানের আমের বাগান তৈরি করে আমকে একটি উচ্চ মাত্রায় নিয়ে যান। তবে সম্প্রতি ভারতে সেই ধারাকে অক্ষুন্ন রেখে
    ম্যাঙ্গো ম্যান অফ ইন্ডিয়া নামে পরিচিত লখনও নিবাসী কলিমুল্লাহ খান ভদ্রলোক এক যাদুকরী আম গাছ তৈরী করে গোটা বিশ্বে সাড়া ফেলে
    দিয়েছেন। একটাই মাত্র গাছ তাতে -ল্যাংড়া, চৌসা, বেগুনফুলী, দশেরি, তোতামূখী, ফজলী সহ প্রায় ৩০০ রকমের ভিন্ন রঙের ভিন্ন স্বাদের ভিন্ন জাতীয় আম ফলিয়েছেন। ১৯৭৮ সাল থেকে কাজ শুরু করেন প্রায় ৩০ বছরের নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে সফল হয়েছেন তিনি। বর্তমানে তার ঝুলিতে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী পুরস্কার। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করেছে।আজ ভারত ,বাংলাদেশ ও ফিলিপিন্সের জাতীয় ফল আম। সারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আম নিয়ে নানা অনুষ্ঠান নানা উৎসব মুখরে মেতে উঠছে মানুষ।1757 সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে সিরাজদুল্লা যখন পরাস্ত হয় তখন‌ও কিন্তু সাক্ষী ছিলো নদীয়ার পলাশির আমবাগান।এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলায় মুখরিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি সেখানেও কিন্তু বাংলাদেশের শত শত কন্ঠ আজ ভেসে ওঠে”ও মা ফাগুনে তোর আমের বাগানে ঘ্রাণে পাগল করে”।একুশের ভাষা দিবস সারা বিশ্বের কাছে আজ কোলাহল রফিক ,বরকত , সালামদের বলিদান ভাষা বিপ্লবকে মহীয়ান করে তুলেছে সেই দিন ভাষা বিপ্লবীদের প্রথম সভাটি আম বাগানের নিচেই আয়োজিত হয়েছিল। বিজ্ঞানের পরিভাষায় আমের অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। উচ্চমাত্রার চিনি, ভিটামিন ‘এ’ এবং ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে এই ফলে। আমে রয়েছে ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স। এই ভিটামিন শরীরের স্নায়ুগুলোতে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। শরীরকে রাখে সতেজ। ঘুম আসতে সাহায্য করে। আমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ। আঁশ-জাতীয় ফল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, মুখের ব্রণ প্রতিরোধ করে। চিকিৎসকদের মতে, আমে খনিজ লবণের উপস্থিতিও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। দাঁত, নখ, চুল, মজবুত করার জন্য আমের খনিজ লবণ উপকারী ভূমিকা পালন করে। বুদ্ধি ও শরীরের শক্তি বাড়ানোর জন্য আম ভীষণ জরুরি ফল।
    ওদিকে গল্পের সূত্রে আমের রাজা ল্যাংড়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এক খোঁড়া ফকির। ফকির থাকতেন হাজিপুরের একটি আমগাছের তলায়। সে গাছটি আবিষ্কার করেছিলেন পটনার ডিভিশনাল কমিশনার ককবার্ন সাহেব। তার পরে সাড়া পড়ে গেল সে গাছকে ঘিরে। চার দিকে সান্ত্রী-সেপাই, মাঝখানে একটি আমগাছ। আর সেই ফকির বাবার নাম থেকেই সেই আমের নামকরণ ল্যাংড়া আম। এই নিয়ে শ্রীপান্থ লিখেছেন সে গল্প, ‘বোধিদ্রুমের প্রতিটি শাখা নিয়ে যেমন কাড়াকাড়ি, তেমনি হাজিপুরের এই আমগাছের ডাল নিয়েও। হাথুয়া, বেতিয়া, দ্বারভাঙ্গা, ডুমরাও-এর মহারাজারা বরং হাজার হাজার টাকার খাজনা হারাতেও রাজি আছেন, কিন্তু হাজিপুরের আমের ডাল নয়।’
    ল্যাংড়ার নেপথ্যে যদি এক ফকির ফজলি তবে এক রমণীর স্মৃতিবিলাস। গৌড়ের পথে বিস্তীর্ণ এক বনের ধারে ছোট একটি কুটির ছিল। সেখানে থাক থাকতেন একাকী এক মুসলমান মেয়ে। তাঁর উঠোনে তাঁরই মতো একা একটি আমগাছ। জ্যৈষ্ঠের এক দারুণ দাহনবেলায় মালদহের বিখ্যাত কালেক্টর র‌্যাভেনশ সাহেব সেই বনের ভিতর দিয়ে চলেছেন গৌড়ের দিকে। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে সাহেব সেই গাছের তলায় দাঁড় করালেন ঘোড়া। ভয় পেয়ে মেয়েটি তড়িঘড়ি পিঁড়ি পেতে দিলেন। সাহেব জল চাইলেন। শুধু জল কি আর দেওয়া যায়, মেয়েটি তাই দিলেন একঘটি জল আর রেকাবিতে সেই গাছের একটি আম। সাহেব খেতে গিয়ে চমকে উঠলেন। মালদহের কালেক্টর তিনি, আম খেয়েছেন বহু, কিন্তু এমন আম কখনও খাননি। মেয়েটিকে কাছে ডাকলেন, জিগ্যেস করলেন নাম। আর সেই মেয়ের নামেই নাম হয়ে গেল সেই গাছের আমের নাম ফজলি।
    পৌরাণিক যুগেও আমের ইতিহাস বর্ণিত আছে স্বর্ণাক্ষরে মহাভারতে আম নিয়ে মজার এক গল্প রয়েছে। সীতাকে রাবণ অপহরণ করে নিয়ে যায় লঙ্কায়। বন্দী অবস্থায় সীতাকে ফল খাওয়ানো হয়। নাম না-জানা ফল খেয়ে খুব মজা পায় সীতা। নিজের ভাগের অংশ থেকে সীতা কয়েকটা ফল রাম, লক্ষ্মণ ও হনুমানের জন্য রেখে দেয়। কদিন পর সীতার খোঁজে হনুমান গেল লঙ্কায়। ঠিক ঠিক হাজির হয় বন্দী সীতার কাছে।
    সীতা হনুমানকে ওই ফল দিয়ে বলে, এগুলো তোমার, রাম ও লক্ষ্মণের জন্য। তোমরা খেয়ো।
    হনুমান সেই ফলগুলো থেকে একটা ফল খেয়ে আর লোভ সামলাতে পারেনি। সব ফল একাই খেয়ে ফেলে।
    ফিরে যায় সীতার কাছে। বলে, মা, আমি অপরাধ করেছি। ফলগুলো রাম ও লক্ষ্মণকে না দিয়ে একাই খেয়েছি। এখন বলো এই ফলের নাম কী? কোথায় পাওয়া যায়?
    সীতা বলে, আমি তো এখানে বন্দী। কোথায় কী আছে আমি বলতে পারব না। এই ফলের কী নাম, তা-ও জানি না। তবে আশপাশেই পাওয়া যাবে হয়তো। খোঁজ করে দেখতে পারো।
    হনুমান ফলের সন্ধানে বের হয়।
    এত স্বাদের ফল, কী নাম এর? খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় আমবাগান। গাছ থেকে একটি আম খেয়ে হনুমান বুঝতে পারল, সীতার দেওয়া ফলের মতো এই ফলেরও একই রকম স্বাদ। আমগাছে উঠে হনুমান ইচ্ছেমতো খেতে থাকে আর আমের আঁটি এদিক-সেদিক ছুড়ে মারতে থাকে। কথায় বলে, হনুমানের ছুড়ে দেওয়া আমের আঁটি থেকেই এই ভারত উপমহাদেশে জন্ম হয়েছে আমগাছের। তবে এখন গ্রাম বাংলার গাছে আমের ছড়াছড়ি। গ্রীষ্মের দাবদাহে ছেলের দল হো হো করে ছুটে চলেছে আম বাগানের দিকে মুখে তাদের একটাই গান

    চৈত্র মাসে আমের গাছে
    কত আমের মুকুল ধরে।
    বৈশাখে কাঁচা আমের গন্ধে
    সবার পরাণ পাগল করে।