|
---|
নতুন গতি ওয়েব ডেস্ক : দেশে সদ্য পাস হওয়া বিতর্কিত তিনটি কৃষি বিলের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী কৃষক বিক্ষোভের আঁচ আজ এসে পৌঁছেছে রাজধানী দিল্লিতেও।
আজকে সকালে দিল্লির প্রাণকেন্দ্র রাজপথে, ইন্ডিয়া গেটের ঠিক সামনে একদল আন্দোলনকারী একটি ট্রাক্টর জ্বালিয়ে দিয়ে এই বিলগুলোর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
কৃষি বিলের বিরুদ্ধে এদিন অবস্থান বিক্ষোভে বসেছেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং, প্রতিবাদ হয়েছে দক্ষিণের কর্নাটক বা তামিলনাডুতেও।
কৃষিপণ্যের জন্য সরকারের ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’ বা এমএসপি বহাল থাকবে, সরকারের এই আশ্বাসের পরও কৃষক বিক্ষোভ কীভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে?
বস্তুত কৃষিখাতে সংস্কারের লক্ষ্যে আনা নতুন একগুচ্ছ বিলের বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন কৃষক সংগঠন একযোগে প্রতিবাদ শুরু করেছিল শুক্রবার থেকেই।
সেদিন বিক্ষোভকারীদের রাজধানীর সীমান্তে নয়ডাতে আটকে দেওয়া হলেও এদিন সকালে কিন্তু পাঞ্জাবের একদল যুব কংগ্রেস কর্মী কড়া নিরাপত্তার ফাঁক গলে দিল্লির ইন্ডিয়া গেটের সামনে হাজির হয়ে যান।
ট্রাকে করে তারা লুকিয়ে নিয়ে এসেছিলেন একটি ট্রাক্টর, সেটিকে রাজপথের ওপর নামিয়ে তারা আগুন ধরিয়ে দেন। দিল্লি পুলিশ পরে বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করলেও এই নিরাপত্তার গাফিলতি কীভাবে হল সে প্রশ্নও উঠছে – কারণ ঘটনাস্থল থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বেই ভারতের পার্লামেন্ট ও রাষ্ট্রপতি ভবন।
এবং আরও যে প্রশ্নটা বেশি করে উঠছে, তা হল দেশের কৃষক বিক্ষোভ কি আরও তীব্র আকার নেবে?
চাষীরা সরকারের সহায়ক মূল্য আর পাবেন না?সরকার দাবি করছে, স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়ন করে এবং কৃষিখাতের দালাল বা মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের ভূমিকাকে খর্ব করে এই বিল চাষীদের জন্য নানা সুবিধা বয়ে আনবে।
কিন্তু আন্দোলনরত চাষীদের আশঙ্কা, বিভিন্ন কৃষিপণ্যের জন্য তারা যে এতদিন সরকারের বেঁধে দেওয়া ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’ পেতেন, এই বিলগুলো পাস হওয়ার পর সেই নিশ্চয়তা আর থাকবে না।
বিজেপি-নেতৃত্বাধীন শাসক জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাদের সবচেয়ে পুরনো শরিক অকালি দলের সুখবীর সিং বাদলও ঠিক এই যুক্তিই দিচ্ছেন।
নতুন বিলে সরকার নিয়ন্ত্রিত এই কৃষি মান্ডিগুলো (AMPS) অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। ওনার কথায়, “দুমাস ধরে বিজেপিকে আমরা বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম এই বিলগুলো পাঞ্জাব-সহ সারা দেশের কৃষকদের চরম সর্বনাশ করবে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। ফলে ওই জোটে থাকা আমাদের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি।
অর্থনীতিবিদ সৈকত সিংহরায়ের মতে, “বিভিন্ন কৃষিপণ্যের জন্য সরকারের নির্ধারিত সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তার বদলে বৃহৎ পুঁজিপতি বা কর্পোরেটদের মর্জির ভরসায় থাকা – ভারতের কৃষকরা এটাই আসলে মেনে নিতে পারছেন না।
নীলকর সাহেবরা এক সময় যেভাবে দাদন দিয়ে কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করতেন, নতুন সিস্টেমে ছোট জমির মালিক ক্ষুদ্রচাষীরা অনেকটা একই রকম আশঙ্কায় ভুগছেন বলেও তার পর্যবেক্ষণ।
পার্লামেন্টে বিলগুলোর তীব্র প্রতিবাদ করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি দোলা সেন বিবিসিকে বলছিলেন, “দেশে খাদ্যাভাবের সময়, মহামারির সময় যখন আরও বেশি করে কৃষিতে প্রোটেকশন আর মনিটরিং দরকার, ঠিক তখনই এই বিলগুলোর মাধ্যমে কৃষিখাতকে ওপেন করে দিল, একেবারে খুলে দিল!”
“কর্পোরেট হাঙরদের হাতে দেশের কৃষিকে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা তো আমাদের করতেই হবে”, বলছিলেন তিনি।
মোবাইলের মতো কৃষির বাজারেও শুধু কর্পোরেটরা? – ভারতের পার্লামেন্টে পাস হওয়া বিতর্কিত এই তিনটি কৃষি বিলের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী কৃষকদের আন্দোলন শুরু হয়েছে শুক্রবার থেকেই।
অব্যাহত এই তুমুল বিক্ষোভে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে কৃষক সংগঠনগুলো সড়ক ও রেলপথও অবরোধ করেছেন।
বুলন্দশহরের এক ক্ষুদ্র চাষী রতন লাল বলছিলেন, “যে ছোট বা মাঝারি আড়তদাররা এখন আমাদের পণ্য কিনে নেন তাদের হঠিয়ে বড় কর্পোরেটদের নিয়ে আসতেই এই বিল।”
“ঠিক যেভাবে মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে জিও আর এয়ারটেল ছাড়া আর সব প্লেয়ার বাজার থেকে আজ উধাও, ঠিক সেভাবেই শুধুমাত্র বড় পুঁজিপতিদের কাছে ফসল বেচতে আমাদের বাধ্য করা হচ্ছে।”
মীরাটের কৃষক বলীরাম আবার মনে করেন, “বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চাপেই সরকারের এই পদক্ষেপ। বরং বিভিন্ন কৃষিপণ্যের জন্য মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বা এমএসপি দিতে সরকার পার্লামেন্টে কেন বিল আনছে না?”
রাজনীতিবিদ ও অ্যক্টিভিস্ট যোগেন্দ্র যাদব বলছিলেন, পাস হওয়ার মাত্র পাঁচদিনের বিরুদ্ধে সারা দেশের সব রাজ্যে ও সব কৃষক সংগঠন মিলে যেভাবে এই বিলের প্রতিবাদে নেমেছে তা ভারতে আগে কখনও হয়নি।
তার কথায়, “পাঞ্জাবের পাটিয়ালা থেকে তামিলনাডুর সালেম সর্বত্র কৃষকরা একটাই দাবি জানাচ্ছেন – আমাদের মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের গ্যারান্টি চাই।”
এই নতুন কৃষি বিলগুলোতে ঠিক আছেটা কী? – ঠিক আটদিন আগে পার্লামেন্টে পাস হওয়া যে তিনটি বিলকে ঘিরে এই ধুন্ধুমার – তার প্রথমটিতে সরকার নিয়ন্ত্রিত পাইকারি কৃষিবাজার বা মান্ডিগুলো কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় বিলটি ফসলের আগে থেকে ঠিক করে রাখা দামে চুক্তিভিত্তিক চাষ বা কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ের পথ প্রশস্ত করবে।
আর ব্যবসায়ী বা উৎপাদকরা চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ ইত্যাদি কতটা মজুত করতে পারবেন, এই মুহুর্তে তার ওপর যে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আছে তৃতীয় বিলটি সেটাই বিলোপ করবে।
বিলের স্বপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে সিনিয়র ক্যাবিনেট মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি আবার বলছিলেন, “কৃষিমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বারবার নানা মঞ্চে আশ্বস্ত করেছেন, এসএসপি থাকবে – চিন্তার কিছু নেই।”
“বস্তুত কৃষিবিজ্ঞানী এম এস স্বামীনাথনের রিপোর্টে চাষীদের যে উপযুক্ত এমএসপি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল, নতুন বিলগুলো সেটাই নিশ্চিত করবে এবং ভারতে কৃষির জন্য ‘এক দেশ, এক বাজার’ প্রতিষ্ঠা করবে।”
অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য মানছেন, এই বিলগুলো সংস্কারমুখী – এবং ভারতের কৃষিতে তা হয়তো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনও আনতে পারে। তবে বিলটা নিয়ে যথেষ্ঠ আলাপ-আলোচনা হয়নি, আর সমস্যা সেখানেই।
কৃষি অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ ড: হাসরাত আলি বিবিসিকে বলছিলেন, “বিলটা আনা হয়েছে তাড়াহুড়ো করে, এটা আনার আগে অনেক সেমিনার-সিম্পোসিয়াম-আলোচনা দরকার ছিল, কৃষকদের মত নেওয়া উচিত ছিল।”
“সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি একটা কথা বলতেন, সরকার হয়তো সংখ্যা দিয়েই গড়া যায়, কিন্তু সরকার চালাতে হয় সহমত দিয়ে, অর্থাৎ সব দলকে সঙ্গে নিয়ে। এখানে সেটা একেবারেই করা হয়নি।”
বিজেপি জোটের কাছে পার্লামেন্টে সংখ্যা থাকলেও এই বিলগুলো নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য তারা গড়তে পারেনি, তা স্পষ্ট।
ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ গত রাতে বিলগুলোতে সই করে তা আইনে পরিণত করে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার বাড়ির দোরগোড়ায় ট্রাক্টর জ্বালিয়ে কৃষকরাও বুঝিয়ে দিয়েছেন তাদের বিক্ষোভ সহজে থামছে না