|
---|
নিজস্ব প্রতিবেদক:- অখণ্ড মেদিনীপুরের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। অসমীয়া ভাষায় ‘জোলা’ কথার অর্থ জল। ‘নাড়া’ বলতে আমরা বুঝি ধানের শিষসহ খড় কেটে নেওয়ার পর ধান গাছের যে অংশ জমিতে থাকে সেই গোড়া বা অবশিষ্ট অংশ। মিলিত অর্থ নাড়া + জোল = নাড়াজোল। পরগনা হিসেবে নাড়াজোল নামটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে। পূর্বতন মেদিনীপুর জেলার ৫৪টি পরগনার মধ্যে নাড়াজোল একটি উল্লেখযোগ্য পরগনা হিসেবে পরিচিত ছিল। নাড়াজোল একটি প্রাচীন জনপদ। এই জনপদের রাজকীয় গরিমা মেদিনীপুরের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে। সাক্ষী আছে ভগ্ন মন্দির, রাজবাড়ি, গড় দূর্গ ও পরিখার খাত। আজ থেকে পাঁচশো তিরানব্বই বছর আগে অরন্যাবৃত এই ভূমিখণ্ডের অধিপতি ছিলেন বর্ধমান নিবাসী উদয়নারায়ন ঘোষ। উদয়নারায়নের পর প্রতাপনারায়ন এই অঞ্চলের অধিপতি হন। পরবর্তীতে উত্তরাধিকারসুত্রে যোগেন্দ্রনারায়ন, ভরতনারায়ন ও কার্ত্তিকরাম ঘোষ এই অঞ্চলের অধিপতি হন। প্রসঙ্গত এই কার্ত্তিকরাম বাংলার অধীশ্বর সোলেমান করবানির কাছ থেকে ঘোষ ‘রায়’ উপাধি লাভ করেন। সেই থেকে নাড়াজোলের জমিদাররা রায় পদবি গ্রহন করেন। শাসন বাবস্থার সুবিধার জন্য মহামতি আকবর তাঁর সাম্রাজ্যকে অনেকগুলি সুবা ও প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। সুবার প্রধান শাসনকর্তা ছিলেন সুবাদার বা নাজিম। ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দে বলবন্ত রায় তদানীন্তন বাংলার নাজিমের কাছ থেকে খান উপাধি লাভ করেন। সেই থেকে নাড়াজোলের জমিদাররা খান পদবি গ্রহন করেন। বলবন্তের পর গুনবন্ত খান এবং কালক্রমে অভিরাম খান, যদুরাম খান, মতিরাম খান, সীতারাম খান, ও আনন্দলাল এই অঞ্চলের অধিপতি হন। এরপর অধিপতি হন মোহনলাল খান। মোহনলাল খানের সময়কাল থেকেই নাড়াজোলের স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাস শুরু। তাঁর আমলে তৈরি স্থাপত্য কীর্তিগুলিতে ইন্দো-ইউরোপীয় শিল্পরীতির এক অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে নাড়াজোলের খুব কাছেই লংকাগড়ে সাড়ে ষাট বিঘা জমিতে পুকুর খনন করে গৃহ নির্মাণ করেছিলেন, বর্তমানে এটি ‘জলহরি’ নামে পরিচিত। সেই সময় জলহরি নির্মাণ করতে খরচ হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ বাংলা ১২৩৭ সালের ফাল্গুন মাসে শ্মোহনলাল খান পরলোকগমন করেন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারত সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার জুবিলি উৎসব উপলক্ষে ইংরেজ সরকার মহেন্দ্রলাল খানকে ‘রাজা’ উপাধি প্রদান করেন। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ বাংলার ১২৯৯ বঙ্গাব্দে ১লা মাঘ শুক্রবার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মহেন্দ্রলাল কলকাতার বাসভবনে পরলোকগমন করেন। পিতার মৃত্যুর পর নরেন্দ্রলাল খান নাড়াজোলের অধীশ্বর হন। জমিদারির অধিকার পাওয়ার পর তিনি জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। নানা জনহিতকর কাজের জন্য ইংরেজ সরকার নরেন্দ্রলালকে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ২৯ নভেম্বর ‘রাজা’ উপাধি প্রদান করেন। বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের ইতিহাসে নরেন্দ্রলাল খান এক স্মরণীয় নাম। পরাধীন ভারতবর্ষের শৃঙ্খল মোচনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। একদা মেদিনীপুর গুপ্ত সমিতির কার্যকলাপ সারা বাংলায় বিস্তৃত হয়েছিল। এই সমিতির জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, হেমচন্দ্র কানুনগো, অরবিন্দ ঘোষ ও নরেন্দ্রলাল খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ১৬ অক্টোবর মেদিনীপুর, নাড়াজোল, ক্ষীরপাই প্রভৃতি অঞ্চলে অশৌচ দিবস পালন করে। তাই নরেন্দ্রলালের প্রতি ইংরেজ সরকারের দৃষ্টি সজাগ ছিল। ১৯০৮ সালের ২৮ আগস্ট নরেন্দ্রলালের গোপ প্রাসাদে পুলিশ তল্লাশি চালায় এবং মেদিনীপুর বোমা মামলায় নরেন্দ্রলালকে গ্রেপ্তার করে কনডেমড সেলে রাখা হয়। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে নরেন্দ্রলালকে মুক্তি দিতে হয়। নরেন্দ্রলাল খান পরলোকগমন করেন ১৯২১ সালে। এরপর দেবেন্দ্রলাল খান নাড়াজোলের অধিপতি হন। দেবেন্দ্রলাল জন্মগ্রহণ করেন বাংলার ১৩০০ সালের ২৪ ফাল্গুন। দেবেন্দ্রলাল খান ১৯২৬ সালে মেদিনীপুর জেলা বোর্ডের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির কার্যসমিতি গঠিত হলে সুভাষচন্দ্র বসু ওই কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৮ সালে মতিলাল নেহরুর সভাপতিত্বে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসে কলকাতায়। মতিলাল নেহরু দেবেন্দ্রলালের বাসভবন থেকে এই অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। অধিবেশনে নেহরু রিপোর্ট নিয়ে প্রবল বাদানুবাদ হয়। সুভাষচন্দ্র বসু ও জহরলাল নেহরু পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি সারা দেশের সঙ্গে নাড়াজোল রাজবাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন দেবেন্দ্রলাল। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এই দশ বছর দেবেন্দ্রলাল সরাসরি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি এই সময়ে গোটা মেদিনীপুর জেলাজুড়ে বিভিন্ন জনসভা করেন। তাঁর ভাষণ ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত করে মেদিনীপুরের গুপ্তসমিতির সদস্যদের। এরই ফলস্বরুপ তৎকালীন মেদিনীপুর জেলার তিন কুখ্যাত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বারজ, পেডি, ডগলাশকে তারা হত্যা করে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে নাড়াজোলের রাজবাড়ি প্রথমদিকে পরোক্ষ ও পরবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। প্রসঙ্গত, শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু নাড়াজোল রাজবাড়ির অধীনে তহশিলদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেই সূত্রে কিশোর ক্ষুদিরাম অচিরেই নাড়াজোল রাজবাড়ির সংস্পর্শ লাভ করেন। নাড়াজোল রাজবাড়ির অন্দরে ছিল বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা। সেখানে বিপ্লবীরা আত্মপগোপন করে থাকতেন। এই গোপন আস্তানায় চলতো অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও বোমা তৈরি করার কর্মকাণ্ড। যার প্রধান ছিলেন স্বয়ং হেমচন্দ্র কানুনগো। এছাড়া অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত সহ বহু গুপ্ত সমিতির সদস্যরাও এই গোপন আস্তানা থেকে গোপন সভা সংগঠিত করতেন। রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁদের এক অটুট বন্ধনের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৩৮ সালের ১৭ মে সুভাষচন্দ্র বসু মেদিনীপুর শহরে আসেন। ১৮ মে ঘাটাল মহকুমাকে কেন্দ্র করে তিনটি জনসভা করেন। সভাশেষে তিনি নাড়াজোল রাজবাড়িতে পদার্পণ করেন। নাড়াজোল রাজবাড়ির সিংহ দরজার কাছে দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুকে আপামর নাড়াজোলবাসী শাঁখ বাজিয়ে ফুল ছড়িয়ে অভ্যর্থনা জানায়। এখানে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘আপনারা প্রস্তুত থাকুন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তি খুব শীঘ্রই ঘটবে’। এরপর সুভাষচন্দ্র মেদিনীপুর শহরের বিভিন্ন জনসভায় বহুবার উপস্থিত হন এবং এই প্রতিটি জনসভায় মুখ্য বক্তা ছিলেন দেবেন্দ্রলাল খান। এছাড়া গান্ধীজী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশসহ বহু বিশিষ্টজনেরা বিভিন্ন সময়ে নাড়াজোল রাজবাড়িতে পদার্পণ করেন। গান্ধীজী ১৯২৫ সালের ৭ জুলাই নাড়াজোল রাজবাড়িতে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেন। ১৯২৯ সালে কাজী নজরুল ইসলাম নাড়াজোল রাজবাড়িতে পদার্পণ করেন। সময়টা ছিল এপ্রিল মাস। এই সময় তিনি সন্ধ্যায় রাজবাড়ির কাছারিতে জলসা চলাকালীন তাঁর বিখ্যাত গান ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ পরিবেশন করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও ছিল দেবেন্দ্রলাল খানের এক নিবিড় সম্পর্ক। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার তাঁকে দেশভক্ত সন্মান প্রদান করে। স্বাধীনতার পর দেবেন্দ্রলাল খান পরলোকগমন করেন। এরপর থেকেই নাড়াজোল রাজপরিবার ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। নাড়াজোল রাজপরিবারের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য নাম হল রানি অঞ্জলি খান। তিনি স্বাধীন ভারতবর্ষের মেদিনীপুর বিধানসভার পাঁচ বারের নির্বাচিত কংগ্রেস বিধায়ক ছিলেন। তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে মেদিনীপুরের গোপ রাজবাড়ি ও নাড়াজোল রাজবাড়ি কলেজ প্রতিস্থাপন করার জন্য দান করেন। যা বর্তমানে মহিলা (গোপ) কলেজ এবং নাড়াজোল রাজ কলেজ নামে পরিচিত। রানি অঞ্জলি খান ২০০৫ সালে কলকাতার বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং এরই সঙ্গে শেষ হয় নাড়াজোল রাজপরিবারের এক অনন্য ইতিহাসের কাহিনি। বর্তমানে নাড়াজোল রাজপরিবারের ভগ্ন প্রাসাদ এবং তাকে কেন্দ্র করে প্রাচীন স্থাপত্য ও মন্দির গুলির যথাযথ সংরক্ষণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। বিশিষ্ট লেখক দেবাশীষ ভট্টাচার্য ও রাজপরিবারের বর্তমান বংশধর সন্দীপ খান সহ বহু বিশিষ্টজনেরা মিলে গঠন করেন নাড়াজোল পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটি। এই কমিটি রাজ্য হেরিটেজ কমিশন, জেলা প্রশাসন সহ রাজ্য প্রশাসনের কাছে দরবার করে সমস্ত পুরাকীর্তিগুলিকে সংরক্ষণ করার। তাঁদের এই দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলস্বরুপ ২০০৮ সালে নাড়াজোল রাজবাড়ি ও কিছু নির্দিষ্ট পুরাকীর্তিকে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে এই কমিটি জাতীয় স্বীকৃতির তকমা ও সম্ভবনাময় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নাড়াজোলসহ সমগ্র রাজবাড়িকে ঘোষণা করার সমস্ত রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।