|
---|
আজিম শেখ,নতুন গতি: রাজ্যের প্রায় ২ লক্ষ ৩২ হাজার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের স্বার্থরক্ষায় একাধিক মানবিক দাবি জানিয়ে গতকাল হাওড়ার পাঁচলায় প্রায় ঘন্টা চারেক রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করলেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা ঐক্যমঞ্চ। সংগঠনের তরফে অন্যতম উপদেষ্টা সুবীর সাহা, আহ্বায়িকা জয়ন্তী চক্রবর্তী, বন্দনা শুর, সুনিতা মন্ডল, সুস্মিতা দাস বা বিশাখা মাঝির সঙ্গে কথা বলে যা জানা গেল – তাতে স্পষ্ট বর্তমানে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের অবস্থা দিনদিন ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
সংগঠনের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল – অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের অবসর নিয়ে। কোথাও কোনো চাকরিতে অবসর হলে – তার সঙ্গে যুক্ত হয় ‘অবসরকালীন সুবিধা’। কিন্তু, বর্তমান রাজ্য সরকার ৬৫ বছর বয়স হলেই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বা সহায়িকাদের ‘অবসর গ্রহণে’ বাধ্য করছে। অথচ মিলছে না পিএফ, গ্র্যাচুইটি বা পেনশনের মত কোনো অবসরকালীন সুবিধাই! ফলে, সারা জীবন ধরে যাঁরা দেশের ভবিষ্যৎ অর্থাৎ শিশুদের পুষ্টি থেকে শিক্ষা সুনিশ্চিত করলেন, শেষ জীবনে গিয়ে তাঁদের কার্যত ভিক্ষাবৃত্তি করে দিনযাপন করতে হচ্ছে রাজ্য সরকারের ‘বদান্যতায়’!
এছাড়াও, জয়ন্তীদেবীরা তুলে ধরেন আরেকটি ‘জ্বলন্ত’ সমস্যা – অর্থাৎ জ্বালানি নিয়ে রাজ্য সরকারের পদক্ষেপ! অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা শিশুদের জন্য যে খাবার রান্না করেন, তার জ্বালানি খরচ হিসাবে দেওয়া হয় মাত্র ২৩ টাকা! কিন্তু বর্তমান অগ্নিমূল্যের বাজারে ২৩ তাকে কি আদৌ কোনো জ্বালানি জোগাড় করা সম্ভব? এদিকে, এই নিয়ে বিভিন্ন অফিসে বারবার দরবার করে – অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা একটাই উত্তর পেয়েছেন – ‘ম্যানেজ’ করে নিন! ‘ম্যানেজ’ মানে কি? আদতে কি ‘চুরি’ করে কাজ চালাতে বলা হচ্ছে? কিভাবে এই জ্বালানির জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব – যদি না রাজ্য সরকার মান্ধাতা আমলের ২৩ টাকার ‘ফর্মুলা’ থেকে বেরিয়ে না আসতে চায়!
এছাড়াও, জানা গেছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে যে চালের বস্তা পৌঁছায় তা হিসেবে মত ৫০ কেজির। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দাবি, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে পৌঁছায় ৫০ কেজির বদলে মাত্র ১০-১৫ কেজি! বাকি চাল হয়ে যায় ‘গায়েব’! এই চাল দেয় কেন্দ্র, যায় রাজ্যের হাতে, তারপর পৌঁছায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে। অর্থাৎ এফসিআইএর গোডাউন থেকে বেরিয়ে রাজ্য সরকারের কন্ট্রাক্টরের হাত হয়ে তা পৌঁছায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে – তাহলে এই চাল গায়েব হচ্ছে কোথায়? এর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দেখার জন্যও আন্দোলনকারীদের তরফে ডাক দেওয়া হয়।
এছাড়াও, রাজ্য সরকার রাজ্যের ১ লক্ষ ১৬ হাজার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছে সাধ থেকে অন্নপ্রাশন পালনের জন্য। জয়ন্তীদেবীদের দাবি – তাঁরা মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করে এই সমস্ত কাজ অতিরিক্ত পরিশ্রম করে করতে রাজি। কিন্তু, এর জন্য যে খরচ বা পরিকাঠামো – তা দিতে হবে রাজ্য সরকারকেই। তাঁদের স্পষ্ট দাবি, ছবি তোলার জন্য থালা সাজিয়ে মুখের খাবার কেড়ে নেবার মত অমানবিক কাজ তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়! প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগেই নদীয়াতে এমনিই এক ঘটনার খবর প্রকাশ্যে আসায় রীতিমত ঝড় বয়ে গিয়েছিল রাজ্য জুড়ে। আর তাই অতিরিক্ত পরিশ্রম করে মানবিক হতে কোনো আপত্তি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের, কিন্তু মানবিকতার নামে অমানবিক হতে তাঁদের তীব্র আপত্তি।
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা এদিন আরও জানান, তাঁদের বেতন হয় ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। সেই বেতনের টাকাটা সব সময় তোলাও হয় না, অর্থাৎ শুধুমাত্র অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের বেতন সংক্রান্ত কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয় ব্যাঙ্কের। অথচ, তাঁরা যখন লোনের জন্য এইসব ব্যাঙ্কে আবেদন করেন, ব্যাঙ্কের তরফে জানানো হয়, রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁদের কোনো চুক্তি না থাকায় লং দেওয়া যাবে না! আর তাই প্রয়োজনের সময়, এই নিয়ে চূড়ান্ত অসুবিধায় পড়তে হয় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের। ফলে, এই ব্যাপারেও রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপের দাবি করে এর আশু সমাধান দাবি করেছেন তাঁরা।
পাশাপাশি, রাজ্য সরকারের চাকরি সংক্রান্ত বঞ্চনা নিয়েও সরব তাঁরা ,কিছুদিন আগেই ৩,৪০০ সুপারভাইজারের জন্য পরীক্ষা নেয় রাজ্য সরকার। সেখানে স্পষ্ট জানানো হয় ৫০% সংরক্ষন থাকবে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের জন্য। কিন্তু ১,৭০০ পদের জন্য অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সংরক্ষন থাকলেও, বাস্তবে সেখানে চাকরি দেওয়া হয় মাত্র ৪৩২ জনকে! কেন এই বঞ্চনা রাজ্য সরকারের – এই নিয়েও এদিন জবাবদিহি চান তাঁরা। সবমিলিয়ে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দাবি – একাধিক মানবিক ও ন্যায্য দাবি নিয়ে তাঁরা আপাতত প্রজেক্ট বা জেলা ধরে ধরে আন্দোলন কর্মসূচি নিচ্ছেন। কিন্তু, এইসব সমস্যার আশু সমাধান না হলে আগামী দিনে রাজ্যের ৪১৬ টি প্রজেক্টের ১ লক্ষ ১৬ হাজার কেন্দ্রের ২ লক্ষ ৩২ হাজার কর্মী একত্রে বৃহত্তর আন্দোলনের পথে নামতে বাধ্য হবেন।